Alapon

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও কিছু বিরোধীতা

“অন্যান্য ব্যাংক সরাসরি খায় আর ইসলামী ব্যাংক একটু ঘুরায়া খায়। সবি এক জিনিস”। এটি বাজারে সর্বাধিক প্রচলিত কথা। আজ এই বিষয়ে কিছু কথা বলবো। 

সুদ কিঃ
সুদের সংজ্ঞা বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার ধারণা। ইসলামী অর্থনীতিতে টাকা বা মুদ্রা কোন পণ্য নয়, কারণ তা সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। একটি পণ্য (ধরি মোটরবাইক) এর সাথে টাকার পার্থক্য হল টাকা আপনি সরাসরি খেয়ে ফেলতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না। একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কোন পণ্যে পরিণত করে তবেই ব্যবহার করতে পারবেন।( টাকা দিয়ে এক প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে তারপর খেয়ে ফেললেন) আর যেহেতু মুদ্রা কোন পন্য নয়, তাই এটা আপনি বেচতে পারবেন না, বেচে কোন লাভও করতে পারবেন না। এই তত্ত্বের মাধ্যমে ইসলাম প্রচলিত অর্থনীতিতে সুদের যে সংজ্ঞা- Price of credit- তার মূলে আঘাত করেছে কারণ টাকা ধার দেয়া কোন পণ্য নয় যে তার দাম নিবেন।

টাকা বাড়ানোর একমাত্র এবং একমাত্র বৈধ উপায় হল একে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। নিচে এটা চিত্রের সাহায্যে দেখানো হল-

(১) টাকা-----পণ্য-----বিক্রি----টাকা

(২) টাকা-----পণ্য-----ভাড়া-----টাকা

এভাবে টাকাকে একটি চক্রের মাধ্যমে প্রবাহিত করে আপনি তাকে বাড়াতে কমাতে পারেন। তা না করে যদি আপনি সরাসরি টাকার লেনদেনে কম বেশি করেন, তবে তা হবে সুদ।

আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সঃ বলেন, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা পরিবর্তন করলে অবশ্যই তা যেন সমান সমান হয়। বেশী দিলে কিংবা বেশী নিলে হবে সুদের কারবার। যে দিবে এবং যে নিবে উভয়ই অপরাধী হবে। (সহীহ মুসলিম)

যখনই কোন মানুষকে প্রশ্ন করা হয় সুদ কি? তখনই তারা বলেন মাসে মাসে নির্ধারিত একটা পরিমাণ দেয়াই হল সুদ। প্রতিউত্তরে যদি প্রশ্ন করা হয় তাহলে বাড়িভাড়ার পরিমাণতো নির্ধারিত, সেটা কেন সুদ নয়? তখন যে বাক্যাংশটি যোগ করা হয় তা হল লাভ ক্ষতি যাই হোক, তারপরও যদি দিতে হয়, তবে তা সুদ। এগুলো আসলে সুদের কোন সংজ্ঞা নয়। এগুলো মনগড়া চিন্তা ভাবনা। 

ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে টাকা বৃদ্ধি করে?ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা বৃদ্ধি করে মূলত তিনটি উপায়ে-১) কেনা বেচা২) ভাড়া৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা

১) কেনাবেচাঃ কোন পণ্য কিনে তা লভ্যাংশ রেখে বিক্রয় করা।

২) ভাড়াঃএক্ষেত্রে ব্যাংক কোন মেশিনারীস বা অন্য কোন ভাড়া দেয়ার যোগ্য পণ্য কিনে তা গ্রাহকের কাছে ভাড়া দেয়।

৩) অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাঃইসলামী ব্যাংক মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রাহকের সাথে ব্যবসা করে থাকে। এই দুই পদ্ধতির সারমর্ম নিচে চিত্রের সাহায্যে নিচে দেখান হল-
ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়াঃঋণ দিয়ে যেহেতু অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না, তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর পক্ষে কার লোন, হোম লোন এগুলো দেয়া সম্ভব নয়। তারা যেটা করে সেটা হল ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়া। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক ও গ্রাহক অংশীদারী ভিত্তিতে কোন পণ্য কেনে। ধরুন একটি মোটর সাইকেলের দাম ২০০০০ টাকা। আপনি ১০০০০ টাকা দিলেন, ব্যাংক দিল ১০০০০ টাকা। মোটর সাইকেলটির মালিকানা ৫০% আপনার , আর বাকিটা গ্রাহকের। পুরো মোটর সাইকেলটা এখন আপনি যদি বাজার দরে কাউকে ভাড়া দেন, তাহলে এটার মাসিক ভাড়া হবে ধরুন ১০০০০ টাকা। ব্যাংক পুরো মোটর সাইকেলটি আপনাকেই ভাড়া দিবে। যেহেতু ব্যাংক এর ৫০% র মালিক সেহেতু আপনি তাকে ভাড়া দিবেন ৫০০০ টাকা। আর সাথে মাসে মাসে ব্যাংকের অংশের কিছু টাকা শোধ করবেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনার মালিকানার অনুপাত বাড়তে থাকবে, ফলে প্রদেয় ভাড়ার পরিমাণও কমতে থাকবে। আরেকটি ভিন্ন চুক্তিতে ব্যাংক এই মর্মে গ্রাহকের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে যে গ্রাহক যদি তার দায় নির্ধারিত সময়ের মাঝে পরিশোধ করে দেয়, তবে ব্যাংক বস্তুটির মালিকানা তাকে দিয়ে দেবে। অনেকের মনে হতে পারে যে এখানে শর্তযুক্তভাবে একাধিক চুক্তি একটি চুক্তির মাঝে করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়, এটি একই চুক্তির বিভিন্ন অংশ।

(১) আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পোর্টফোলিওর প্রায় পুরোটাই বাই মোড দ্বারা পূর্ণ। লাভ ক্ষতির ভিত্তিতে এই অংশীদারিত্বের ব্যবসার মাঝেই ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রাণশক্তি ও স্বাতন্ত্র্য নিহিত। কিন্তু তা খুব কম করাতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত বা সন্দিহান করা খুব সহজ হয়।

(২) মাল যে গ্রাহককেই ভাড়া দিতে হবে এমন নয়, তৃতীয় পক্ষকেও দেয়া যেতে পারে।

সঞ্চয়কারীদের সাথে ইসলামী ব্যাংকের সম্পর্কঃ
ইসলামী ব্যাংক নিয়ে দ্বিধা সংশয়ের অন্যতম মূল উৎস হল বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। সঞ্চয়কারীদের মূল অভিযোগ যে ইসলামী ব্যাংকও লাখে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ দেয়, প্রচলিত ব্যাংকও তাই করে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায় থাকল?ইসলামী ব্যাংকের সাথে অন্যান্য ব্যাংকের পার্থক্যটা নির্ধারিত পরিমাণ দেয়াতে নয়, বরং টাকাটা নিয়ে ব্যাংকগুলো কি করে, টাকার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটাতে। আর কিসের নির্ধারিত পরিমাণ সেটা হল বিবেচ্য। যদি লাভের নির্ধারিত অংশ হয় এবং মূলধন সুরক্ষার নিশ্চয়তা না দেয়া হয় তবে সমস্যা নেই। কারণ লাভ অনির্ধারিত, তাই তার নির্ধারিত অংশও অনির্ধারিত।

ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে মুদারাবা চুক্তি, অর্থ্যাৎ এখানে গ্রাহকরা পুঁজি সরবরাহ করেন, ব্যাংক সেটা বিনিয়োগের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে খাটিয়ে যে লাভ করে তা পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ করে নেয়। ব্যবসায়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা থেকে তারা একটি অনুমিত পরিমাণ গ্রাহকদের বলে দেয়। এখানে একটি বিষয় স্মর্তব্য যে গ্রাহকদের কাছে উল্লেখিত শতকরা অংশ একটি অনুমিত মান, যা বছর শেষে সমন্ব্য় সাধন করা হয়। এখন এই পরিমাণ যখন বছর বছর হেরফের হয়, তখন পার্থক্যটা এত সামান্য হয় যে তা অনেকসময় চোখেই পড়ে না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে একজন গ্রাহকের একাউন্ট ১০-১৫ টাকার কমবেশি আসলে বিপুল অংকের লাভ-ক্ষতির ফলাফল যা লাখ লাখ গ্রাহকের মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে সামান্য আকার ধারণ করেছে।

**ইসলামী ব্যাংকগুলো কি সম্পূর্ণ সুদমুক্ত হতে পেরেছে?

এই জনপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর হল, "না"। 
ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিধায় তারা দুটি ক্ষেত্রে সুদমুক্ত লেনদেন করতে পারে না-

১) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে যে বাধ্যতামূলক সঞ্চিতি (SRR) এবং Foreign Currency Clearing Account এ জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার উপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ দেয়।

২) বিদেশী ব্যাংকগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে Nostro Account থাকে, সেটা চলতি হিসাব হলেও Overnight lending থেকে তারা সেখান থেকে সুদ পায়।

তবে ইসলামী ব্যাংকগুলো কল মানি মার্কেটে অংশগ্রহণ করে না, দেশীয় সুদী ব্যাংকে একান্ত প্রয়োজনে আকাউন্ট খুলতে হলে চলতি হিসাবে লেনদেন করে, যথেষ্ট পরিমাণ তারল্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যেন আন্তঃব্যাংক ঋণ না করতে হয়। আর নিতান্ত অপরিহার্য হলে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করে অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের সাথে, মুদারাবা পদ্ধতিতে।

**ইসলামী ব্যাংকের ব্যাপারে আরেকটি অভিযোগ হল যে তারা খেলাপী গ্রাহকের উপর ক্ষতিপূরণ আদায় করে। 

এক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিবেচ্য যে গ্রাহক কি আসলেই অসমর্থ নাকি এটা তার স্বভাবগত সমস্যা। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা প্রবল। খেলাপী গ্রাহক, যারা গড়িমসি করে দেনা শোধ করছেন না, তাদের কাছ থেকে দ্রুত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক অস্থায়ীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। এটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার একটি প্রকার। শরীয়াহ বিশেষজ্ঞরা বা বিচারপতিরা পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য ব্যবস্থাও নিতে পারেন। তবে এধরণের ক্ষতিপূরণ আদায় করার এখতিয়ার ব্যাংকের হাতে না থেকে তৃতীয় পক্ষের হাতে থাকে যারা ঠিক করেন যে কে সঙ্গত কারণে দেন শোধে দেরী করেছে আর কে গড়িমসির কারণে করেছে।

কিন্তু এইসব উৎসের কোনটি থেকে আসা অর্থ ব্যাংক কখনো তার মূল আয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলে তা গ্রাহকদের বা শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বণ্টিত হয় না। এই আয় ব্যাংক শরীয়াহ কাউন্সিলের নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় করে।

এ সংক্রান্ত একটি জরিপে আমি দেখেছি যে গ্রাহকদের ইসলামী ব্যাংকের স্বাতন্ত্র্য জিজ্ঞেস করা হলে সাধারণ গ্রাহকরা সঠিক উত্তর দিতে পারেন না কিন্তু বিনিয়োগ গ্রাহকরা এ ব্যাপারে খুব স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করেন। এর একটি কারণ হল তারা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের সাথে সুপরিচিত।

আপনারা যারা ইসলামী ব্যাংকিং এর বিরোধীতা করেন তাদের উদ্দেশ্য... 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লা’নত করেছেন, সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও উহার সাক্ষীদ্বয়ের উপর এবং বলেছেন এরা সকলেই সমান । (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)

১)কোন স্কলাররা এমনটা অনুমোদন করেন কিনা আমার জানা নেই। সুদী ব্যাংকের দারোয়ানের চাকরিও যেখানে হারাম সেখানে তাদের সাথে লেনদেন কিভাবে বৈধ হতে পারে?

২) আপনি যদি ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিহার করে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন চালিয়ে যান, তাহলে আগামী ৫০ বছরেও সুদভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান হবে না।কিন্তু আমরা সবাই যদি ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হই তাহলে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন সম্ভব। সেক্ষেত্রে গ্রাহক চাহিদার চাপে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সেইসাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়ম বেছে নিতে বাধ্য হতে পারে।

৩) প্রচলিত ব্যাংকের চলতি হিসাবের(যাতে সুদের ব্যাপার নাই) সাথে লেনদেন সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে (যারা ব্যবসা করেন না)। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির কল্যাণে এটা কোন সমাধান নয়।

৪) আল্লাহ মুসলিমদের এমন একটি সময়ে রেখেছেন যখন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার সমতুল্য পাপ থেকে বাঁচার কোন উপায় রাখেন নি, এটা আল্লাহ নাম ও গুণাবলীর পরিপন্থী। কারণ আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না।

৫)আমরা অবশ্যই এমন পন্থা অনুসরণ করব যাতে আল্লাহকে পরকালে বলতে পারি যে আল্লাহ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম অনুধাবন, তাদের শরীয়াহ প্রতিপালনের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ, অন্যদের ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে উৎসাহিত করা——এগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টার উদাহরণ নাকি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে সন্দিহান হয়ে সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা সর্বোচ্চ চেষ্টা—-তা বিবেচনার ভার পাঠকদের উপর রইল।

৬) যারা হালাল হারামের কোন বাছ বিচার না করে অর্থ উপার্জনের নেশায় উন্মত্ত এবং আর যারা সুদী ব্যাংকের হাই প্রোফাইল চাকরি, শেয়ার বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ- সব কিছু থেকে বিরত থেকে নিজের অত্যন্ত কষ্টে উপার্জিত টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখছেন সুদ থেকে বাঁচার আশায়, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেনকে হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদেরকে যে একই কাতারে ফেলা হচ্ছে, আর বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যারা অর্থনীতির এত ঘোরপ্যাঁচ বুঝেন না, কিন্তু হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চান, তাদেরকে গোলকধাঁধার মাঝে ফেলা হচ্ছে, তার দায় কে নিবে?

বঙ্গসমাজে কিছু পন্ডিত ব্যাক্তি রয়েছেন যারা মনে করেন ব্যাংক ব্যবস্থা একটি কাফির / তাগূতী সিস্টেম, যা ইসলামীকরণই শরীয়াহসম্মত নয়। 

ইসলামী ব্যাংকের বিরোধিতাকারীদের মাঝে আরেকটি দল আছেন যারা মত পোষণ করেন যে “আংশিক তহবিল ব্যাংকিং” এর উপস্থিতি কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই একটি তাগূতী সিস্টেম, কেউ কেউ একে দাজ্জালের সিস্টেমের সাথে তুলনা করেন। 

কাগুজে মুদ্রার ধারণাকেই তারা সুদের একটি প্রকার বলে মনে করেন। শেষোক্ত এই মতটি (কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার নিজেই সুদ) ইসলামী অর্থনীতির আলোকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে যদি কেউ কাগুজে মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস পড়েন। 

ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার অন্তর্নিহিত মূল্য থাকা উচিৎ (যেমন সোনা, রূপা ইত্যাদি) এবং বাস্তব সম্পদ হওয়া উচিৎ। আজকের টাকার মত নয়, যার পুরো মূল্যটাই আরোপিত (সরকার বলছে এটি ১০০ টাকা তখনই ঐ কাগজের মূল্য ১০০ টাকা হয়ে যায়) ও তা একটি আর্থিক সম্পদ।

কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে যে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহারের মাঝে যে প্রচ্ছন্ন সুদ রয়েছে তা থেকে বাঁচার উপায় কি? ইসলামিক খিলাফাহকে যেমন আমরা শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করি, তেমনি সোনা রূপাকেই আমরা আসল মুদ্রা হিসেবে মনে করি। 

কিন্তু এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কি আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব? যেসব রাজনৈতিক দল ইসলামী ব্যাংককে তাগূতী সিস্টেম বলে তার সাথে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন, তারাও সুদী ব্যাংকের চলতি হিসাবের সাথে লেনদেন করার চাইতে উন্নততর কোন বিকল্প বা সমাধান দিতে পারেন নাই। 

অথচ “আংশিক তহবিল ব্যাংকিং” সম্পর্কে পড়াশোনা আমাকে এই ধারণাই দেয় যে বাজারে অর্থের (Fiat money) যোগান দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম নিয়ামক হল Current Account.

** আংশিক তহবিল ব্যাংকিং (Fractional-reserve banking) এক ধরনের ব্যাংকিং যাতে ব্যাংকসমূহ তাদের ডিপোজিটের অংশবিশেষ তহবিলে বা রিজার্ভে রাখে এবং বাকীটুকু ধার দিয়ে দেয়। তবে চাহিদার সময় ব্যাংককে সমস্ত ডিপোজিট ফেরত দিতে হয়। এই পদ্ধতিটি সারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত এবং এটিই প্রামাণ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত।

আমাদের করণীয়ঃ
এত লম্বা আলোচনা থেকে আমাদের করণীয় পরিষ্কার- ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তাদের মাঝে চাপ প্রয়োগ করা। একটি ইসলামী ব্যাংকের মান যাচাই এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত চলকগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-

১) শরীয়াহ বোর্ডের সদস্য কারা এবং শরীয়াহ প্রতিপালনের ব্যাপারে তারা কতটুকু কঠোর?

২) ব্যাংকের কর্মচারীরা কতটুকু ইসলামিক। তারা নিয়মিত সালাত আদায় করে নাকি, মহিলা কর্মচারীরা পর্দা মেনে চলেন নাকি, নারী পুরুষের অবাধ এবং অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা হয় নাকি এবং সবচেয়ে বড় কথা হল তারা সুদের পাপের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে নাকি! সুদের প্রতি ঘৃণা একজন ইসলামী ব্যাংকারের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। 

৩)ব্যাংকের কর্মচারীরা ইসলামী অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত কিনা এবং এটাকেই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি মনে করেন কি না।

৪) ব্যাংকের কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না।

উপসংহারে বলা যায় ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব। আর সেটার চরম অভাব আমাদের দেশে রয়েছে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতার কারণে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে সচেতনতা ব্যাংকগুলোকে সেবার মান বৃদ্ধি করতে বাধ্য করবে। 

আল্লাহ আমাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন, আর সেই সাথে অন্যের প্রচেষ্টাকে সমালোচনা না করে উদ্যোগী মুসলিম হবার মত মানসিকতা দান করুন। আমীন।

পঠিত : ১৮৩৭ বার

মন্তব্য: ০