Alapon

বিশ্বের সেরা দশ বই

অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। এই কথাটি যিনি বলেছিলেন তিনি ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের একজন জেনারেল, ফ্রান্সের সম্রাট এবং ইতালির রাজা। ইউরোপ কাঁপানো এই মানুষটির নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অনুধাবন করেছিলেন যে বই মননের বীজমন্ত্র। বই ঘুমন্ত মন ও চেতনাকে জেগে তোলার জিয়নকাঠি। বইয়ের পাতায় পাতায় চোখ রেখেই আমরা স্বপ্ন দেখি, কল্পনা করি অন্য এক ভুবনের। যে ভুবন আমাদের আগামী প্রজন্মকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। আমাদের পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলে। ষাট হাজার বই একজন মানুষের কাছে রাখার স্বপ্ন দেখাটা তখনকার সময়ে সহজ কথা ছিল না। এমন করে সবাই ভাবতেনও না। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বইয়ের গুরুত্বটা অনুধাবন করেছিলেন বিধায় বলেছেন। সে সময় সাধারণ মানুষের পক্ষে কাজটা অসম্ভব হলেও অন্তর্জালের এই যুগে মানুষ চাইলেই তার কাছে হাজার হাজার বই রাখতে পারে। মুদ্রণ কপি ব্যতিত অন্তর্জালে অথবা অমুদ্রিত অবস্থায় একটি বইও আদতে কেউ ভালো করে পড়ে শেষ করে কিনা সে নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে। যাই হোক, প্রাচীন রোমান লেখক মার্কাস টুলিয়াস সিসারো বইকে নিয়ে বলে গেছেন- আ রুম উইদআউট বুকস ইজ লাইক আ বডি উইদআউট আ সোল। বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মতো। কোন সেই বই? কেমন তার ধরন? দেহের জন্য পরিশুদ্ধ আত্মা থাকুক এমনটি চাইবেন না এমন মানুষ তো একজনও নেই। তাহলে সেই আত্মার ঘরে ভালো বই কেনও নয়? ষাট হাজার বই না হোক অন্তত নিজের বিবেচনার সেরা দশ বই তো রাখা চাই! সর্বকালের সেরা দশ বই নিয়ে একেকজনের একেক মত আছে। কারণ একেকজনের ভালো লাগার ধরনটা একেক রকমের।

টাইমসের জরিপে সেরা দশ বইয়ের শুরুতেই আছে রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের প্রথম উপন্যাস আন্না কারেনিনা। উপন্যাসটিতে সে সময়ের বাস্তবতা আর পারিবারিক জীবনে অবৈধ সম্পর্কের গল্প প্রকাশ পেয়েছে। আন্না কারেনিনা বিবাহ সম্পর্কের বন্ধনে অটুট মনোবলের থাকলেও এক সময় সে প্রেমে পড়ে যায়। আন্না কারেনিনা উপন্যাসটি এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প বলে।

তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে ফরাসি লেখক গুস্তাভে ফ্লভার্টের প্রথম উপন্যাস মাদাম বোভারি। এটি পরকীয়া প্রেমকে ঘিরে লেখা। নিজ কন্যাসন্তান বার্থকে আর স্বামীকে ভুলে নায়িকা এম্মা বোভারি মেতে ওঠে ত্রিভুজ প্রেমে। তার এক প্রেমিক মধ্যবয়সী। আর একজন এম্মা বোভারির চেয়ে বয়সে ছোট।

লিও তলস্তয়ের ওয়ার এন্ড পিস তালিকায় রাখবেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। টাইমস সেই ভুলটা করেনি। কারণ, সারা দুনিয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে এই উপন্যাসের বিশেষ গুরুত্ব আছে। ওয়ার এন্ড পিস উপন্যাসে ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের নির্মম ঘটনা, সমাজ ও সময় ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে। পাঁচটি রাশিয়ান রাজকীয় পরিবারকে ঘিরে পাঠক সেই সময়ের সমাজ ও সময়ের ছবি পায়।

রাশিয়ান-আমেরিকান লেখক ভøাদিমির নাবোকভের ভুবনবিখ্যাত উপন্যাস ললিতা আছে তালিকার চার নম্বরে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাম্বার্ট একজন লেখক যে কিনা তার বারো বছর বয়সী সৎ মেয়ে ললিতার প্রেমে পড়ে। বিধবা চারলতে হায, হাম্বার্টকে স্বামী হিসেবে পেলেও এক সময় ললিতার সঙ্গে হাম্বার্টের সম্পর্ক তার চোখে ধরা পড়ে। চারলতে হায ক্ষোভে গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। অন্যদিকে এই কথা গোপন রেখে হাম্বার্ট ললিতার যৌন সংসর্গ পেতে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এমনই এক নিষিদ্ধ গল্প আছে ললিতাতে। পাঁচে আছে মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন। বর্ণবাদ নিয়ে এমন স্যাটায়ার চোখে পাওয়া ভার। হাকলবেরি ফিন গল্পের একটি চরিত্র যে কিছুতেই অন্যদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলতে পারেন না। এক সময় জিম নামের এক ক্রীতদাসকে নিয়ে হাকলবেরি ফিন মুক্ত জীবনের সন্ধানে এগিয়ে যায়।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার রচিত নাটক হ্যামলেট আছে তালিকার ষষ্ট স্থানে। এই নাটকটি রচিত হয় ডেনমার্কের রাজা হ্যামলেটের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। হ্যামলেটের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্লুডিয়াস এই নাটকের খল চরিত্র যে কিনা হ্যামলেটের কানে বিষ ঢেলে তাকে হত্যা করেছে। অথচ প্রচার করেছে হ্যামলেট সাপের দংশনে মারা গেছে। ক্লুডিয়াস সিংহাসন নেয়ার পাশাপাশি হ্যামলেটের স্ত্রীর সঙ্গেও পরিণয়ে আবদ্ধ হয়। রাজা হ্যামলেটের ছেলে যুবরাজ হ্যামলেট এসবের কিছুই মেনে নিতে পারেনি। ঘটনার পরিক্রমায় যুবরাজ হ্যামলেটের হাতেই মারা পড়ে ক্লুডিয়াস। তার আগে ঘটে আরো মৃত্যু ঘটনা।

আমেরিকান লেখক স্কট ফিজেরাল্ডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই আছে টাইমের সপ্তমে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক ধনী যুবক যার নাম জে গ্যাটসবাই। সুন্দরী ডেইজি বুচানের প্রতি জে গ্যাটসবাইয়ের দুর্বলতা আর তার খামখেয়ালিপনার মধ্য দিয়ে সমাজের অবক্ষয় চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে।

ফরাসি লেখক মারসেল প্রুস্টের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম আছে অষ্টমে। এটি লেখকের জীবনের নিজের গল্প। বিশ্ববিখ্যাত এই বইটি ছাপতে লেখককে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কোনো প্রকাশক যখন তার বই ছাপতে চাইল না তখন তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে ছাপলেন ইন সার্চ অব লস্ট টাইম। এর পরের গল্প সবার জানা।

ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের কথক হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয় তিনি হলেন রাশিয়ার এনটভ শেকভ। তিনি প্রথম গল্প লিখেছিলেন নেহায়েত টাকা রোজগারের আশায়, কোনো শিল্প বাসনা থেকে না। অথচ এনটভ শেকভের দ্য স্টোরিজ অব এনটভ শেকভ আছে সর্বকালের সেরা বইয়ের তালিকার নবমে। এটি একটি ছোটগল্পের বই। এখানে তৎকালীন রাশিয়া সমাজের বিভিন্ন গল্প ফুটে উঠেছে।
আর তালিকার দশম স্থানে আছে ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ এলিয়টের অসামান্য উপন্যাস মিডলমার্চ আ স্টাডি অব প্রভিন্সিয়াল লাইফ। মিডলমার্চ উপন্যাস কল্পিত নগরী মিডল্যান্ডকে ঘিরে। মিডলমার্চে অনেক চরিত্র আছে যা আধুনিক উপন্যাসের জন্য আদর্শ স্বরূপ। ১৮৭১ থেকে ১৮৭২ সালে এটি মোট আট খণ্ডে প্রকাশিত হয়। মিডলমার্চ নারীর মর্যাদা, বিয়ের ধরন, আদর্শবাদ, স্বার্থপরতা, ধর্ম, কুটিলতা, রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিক্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে।

দ্য গ্রেটেস্ট বুকস ডট অর্গ পৃথিবীর সেরা একশ’ বইয়ের তালিকা করেছে। টাইমের সেরা দশ বইগুলোর সবকটিই আছে সেরা একশ’র তালিকায়। দ্য গ্রেটেস্ট বুকস ডট অর্গের তালিকায় আন্না কারেনিনা আছে চব্বিশতম স্থানে। অন্যান্য বইয়ের অবস্থান মাদাম বোভারি তেরোতম, ওয়ার অ্যান্ড পিস পঞ্চম, ললিতা উনিশতম, দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন নবম, হ্যামলেট অষ্টম, দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই দশম, ইন সার্চ অব লস্ট টাইম দ্বিতীয়, দ্য স্টোরিজ অব এনটভ শেকভ তৃতীয়, মিডলমার্চ ছাব্বিশ।

পঠিত : ১৪০৯ বার

মন্তব্য: ০