Alapon

কবি ফররুখ, শতবর্ষী এক দুঃসাহসী সিন্দাবাদ

কবি ফররুখ আহমদ। চল্লিশের দশকের কলকাতায় যে ক’জন শক্তিমান কবি’র আবির্ভাব ঘটেছিল ফররুখ আহমদ ছিলেন তাঁদের ভেতর অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কাব্য প্রতিভা শুধু কলকাতা নয়, পরবর্তীতে এদেশেও বিপুলভাবে খ্যাতি ও দীপ্তি লাভ করে।

ফররুখ আহমদ বেঁচে ছিলেন (১০ অক্টোবর ১৯৭৪] মাত্র ৫৬ বছর। জীবনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর বর্ণাঢ্য সাহিত্য সৃষ্টির সময়কাল প্রায় চার দশক। অর্থাৎ কবি ফররুখ আহমদ কৈশোর কাল থেকেই কবিতা লেখায় মগ্ন হন। কবি সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের দেয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ‘সাল তারিখ মিলিয়ে মনে হচ্ছে বাংলা ১৩৪৪, ইংরেজী ১৯৩৭-এই ফররুখ প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। এই বছরই ‘বুলবুল ও ‘মোহাম্মদী’তে তাঁর প্রথম রচনাবলী প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মনে হয়, ‘বুলবুলে’ প্রকাশিত ‘রাত্রি’ সনেটটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা [শ্রাবণ ১৩৪১]।

ফররুখ আহমদের চার দশকের সাহিত্যজীবনের এক দশকের কিছু বেশি সময় কলকাতায় এবং তিন দশকের কিছু কম সময় ঢাকায় অতিবাহিত হয়। তাঁর প্রথম এবং বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ [প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৪৪] কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

কলকাতার সাহিত্যজীবনেই কবি প্রভূত সাফল্য অর্জনে সম হন। এ সময় তাঁর কবিতা সুধীজনের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। তিনি সেখানকার প্রথম শ্রেণীর পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এসব পত্র-পত্রিকার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’, অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘দিগন্ত’, ‘বার্ষিকী’, ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’, ‘মৃত্তিকা’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত।

কবি ফররুখ আহমদ যাঁদের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন, তাঁদের ভেতর ছিলেন অনেকেই বড় কবি, মহৎ প্রাণ এবং উদার ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল হাশেম, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। অন্যদিকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ সত্যজিত রায়, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ফতেহ লোহানী প্রমুখকে। ধারণা করা যায়, ফররুখ আহমদ এঁদের সাহচর্যে এসে সাহিত্য জীবনে প্রয়োজনীয় প্রচুর উৎসাহ এবং প্রেরণা পেয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ফররুখের সমগ্র কাব্য বিচারেও এটা আদৌ প্রমাণিত হয় না যে, এসব কবি-সাহিত্যিকের কোনো ছাপ তাঁর কাব্যকে কিংবা তাঁর কাব্যবিশ্বাসকে সামান্যতমও স্পর্শ করতে পেরেছিল।  বরং তিনি তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম থেকেই একটি স্বতন্ত্র কাব্যবিশ্বাস লালন করে এসেছেন। একজন মৌলিক বড় মাপের কবির জন্য যে সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকা অত্যন্ত জরুরি, ফররুখের চারিত্রে সেই বিশ্বাসের দৃঢ়তা ছিল। কবি ফররুখের এই স্বতন্ত্র কাব্যবিশ্বাসের পূর্ণ প্রতিফলন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’র মধ্য দিয়ে প্রবলভাবে প্রকাশিত হয় এবং এর ধারাবাহিকতা তিনি অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর সর্বশেষ কবিতার মধ্যেও।

শুধু ‘সাত সাগরের মাঝি’ কেন, ফররুখের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘রাত্রি’ [মাসিক বুলবুল, শ্রাবণ ১৩৪৪] এবং তাঁর সর্বশেষ লেখা ‘১৯৭৪’ [একটি আলেখ্য] কবিতার মধ্যেও আমরা কবির সেই অভিন্ন চরিত্র লক্ষ্য করে থাকি। ‘অভিন্ন চরিত্র’ বলতে কবির কাব্যবিশ্বাস সঙ্গে তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যবৈশিষ্ট্যের কথা বলতে চেয়েছি। এ কথা তো স্বীকার্য যে, তাঁর কবিতা সময়ের ব্যবধানে আরও বেশি শাণিত এবং আরও বেশি সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্ত হয়েছে। সেই সাথে, কবি যে স্বপ্নের উদ্দামতা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাঁর শেষ লেখার ভেতর সেই স্বপ্নের গ্রন্থি ছিঁড়ে দু:স্বপ্নের দীর্ঘশ্বাসও প্রকাশিত হতে দেখি।

কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কাব্য যাত্রা শুরু করেছিলেন দূর যাত্রার এক অসম্ভব গতিময়তার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ‘রাত্রি’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছিল কবির সুদূর যাত্রার এক শুভ উদ্বোধন :

“ওরে পাখি, জেগে ওঠ, জেগে ওঠ রাত্রি এল বুঝি,

ঘুমাবার কাল এল জাগিবার সময় যে যায়

ওরে জাগ্ জাগ্ তবু অকারণে। রাত্রির ভেলায়

কোন অন্ধ তিমিরের স্রোত আশা নিরুদ্দেশে যূঝি

হে বিহঙ্গ, দিকভ্রষ্ট নাহি হোয়া যেন পথ খুঁজি অবেলায়।

এখনো সম্মুখে আছে ঝড় আছে ভয়

এখনো আনন্দ আছে খুঁজিবার দূরন্ত বিস্ময়”

[‘রাত্রি’ কবিতার অংশবিশেষ। কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতা। মাসিক ‘বুলবুল’, শ্রাবণ ১৩৪৪]

কবি ফররুখ আহমদের প্রথম প্রকাশিত কবিতার ‘জেগে ওঠ, জেগে ওঠ; ‘ওরে জাগ্ জাগ্ তবু অকারণে।’ কিংবা ‘হে বিহঙ্গ, দিকভ্রষ্ট নাজি হোয়া যেন পথ খুঁজি/অবেলায়’ এই প্রত্যাশিত সুরধ্বনি আরও তীর্যক, তীক্ষ্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থের ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটিই এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। যেখানে কবি বলেছেন :

“হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,

হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;

তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে

দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে।

নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ

মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙ্গে চলে সব বাঁধ।

তবে তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা

এখনো তোমর ঘুম ভাঙলো না?

তবু তুমি জাগলে না?”

[সাত সাগরের মাঝি]

কিংবা :

“আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,

ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,

ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি

তবুও জাহাহ আজ ছোটাতেই হবে।”

[সাত সাগরের মাঝি]

কবি ফররুখের মধ্যে ‘জাগরণ’ এবং ‘স্বপ্নের’ যে অসম্ভব তেজ ও শক্তি ছিল তা এক অসাধারণ ব্যঞ্জনায় তাঁর কাব্যকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। এই শক্তি অর্থাৎ ‘জাগরণ’ ক্ষয়ে ‘স্বপ্নই’ কবিকে করে তুলেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই দু’টো বিষয়কে তিনি তাঁর কাব্যের একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহার না করলেও অন্যতম বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। কবির এই দু’টো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে, ফররুখ কাব্যের একটি মূল সুর এবং তাঁর অগ্রযাত্রার একটি সদর গন্তব্য বা গতিধারা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। সেটা হলো কবি ফররুখের অনন্ত পরিভ্রমণ এবং স্বাধীনতাপ্রিয়তা। সন্দেহ নেই, ব্যক্তি হিসেবে কবি ফররুখ আহমদ যেমন ছিলেন মার্জিত এবং সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তেমনি তাঁর কাব্যেও কবির সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতার স্বপ্নকে বারবার আমরা ঝলসে উঠতে দেখি।

আরব্য উপন্যাসের দুঃসাহসী সার্থক নাবিক সিন্দাবাদ কঠিন বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে জাহাজের হাল ধরে যেমনি জাহাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন, জাহাজকে নিরাপদে সমুদ্রবন্দরে নোঙর করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি অসহায়তা, অলসতা ও পশ্চাদপদতার অন্ধকার ঘূর্ণাবর্তে নিপতিত মানবতা রক্ষার্থে ‘নোনা দরিয়ার ডাক’ শুনে দরিয়ার সাদা তাজী নিয়ে নতুন সফরে বেরিয়ে পড়লেন আমাদের সাহিত্য ভূবনের অহঙ্কার সিন্দাবাদ কবি ফররুখ আহমদ। কবির ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সিন্দাবাদ’-এর শুরুর স্তবকটির উচ্চারণের মাধ্যমে জাতি উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, জাগে জাতির প্রাণে জীবনের স্পন্দন।

সময় ও কাল বদলে যায়, তবুও কালোত্তীর্ণ, কালজয়ী কবিতা বেঁচে থাকে অনন্তকাল। আর সেই কবিতার সাথে বেঁচে থাকেন কবিও। ফররুখ আহমদ নিঃসন্দেহে তেমনি একজন কালজয়ী, মৌলিক মহাকবি। আমাদের সাহিত্যঅনুষঙ্গে তিনি অমর, অনিঃশেষ।

পঠিত : ১৭৬৮ বার

মন্তব্য: ০