Alapon

কবি নজরুলের জন্য এক তরুনীর আত্মাহত্যার কাহিনী

সাম্য-মানবতা প্রেমের কবি, জাগরণের, ও বিদ্রোহী কবি, কাজী নজরুল ইসলামের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি আমাদের জাতীয় কবি।

কবি কাজি নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রম ও নক্ষত্র সমউজ্জল প্রতিভা। তার প্রথম সাহিত্য কর্ম প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। সেই থেকে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অবদান রেখেছেন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। সে বছরই কবি অজ্ঞাত ও দূরারোগ্য ব্যাধিতে স্বাভাবিক কর্ম ক্ষমতা হারান। ফলে হিসেব করলে দেখা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত সাধনা মাত্র ২৩ বছরের। 

অথচ এই ২৩ বছরেই তিনি আমাদেরকে সাহিত্যে ও সংগীতের বিপুল ঐশ্বর্য উপহার দিয়েছেন।তার স্বল্প পরিসর সাহিত্য জীবনে লিখেছেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সঙ্গীত, নাটক-নাটিকা, কিশোর কাব্য, কাব্যানুবাদ, কিশোর নাটিকা প্রভৃতি। তিনি রচনা করেছেন চার হাজারেরও অধিক গান। অসুস্থ অবস্থায় কবি আরও ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন। অসুস্থ থাকা এই ৩৪ বছরে আরো কতো কিছুই না তিনি আমাদের দিতে পারতেন। তা হয়নি বলেই নজরুল আজ বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম এক ট্রাজেডি।

আজ আমি কবি কাজি নজরুল ইসলামের এক অজানা প্রেমের কাহিনী বলব, যার কারনে সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী দুটি গান। সেই দুটি গান রচনা করার ইতিহাস বলব। যা অতিব নাটকীয় ও চমকপ্রদ। আশা করি ঘটনাটি পাঠকদের সুখ পাঠ্য হবে।

ঘটনাটি আমি বেশ কয়েক বছর আগে এফ এম রেডিওতে নজরুল জন্ম বার্ষিকি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম।

কবি কাজি নজরুল ইসলাম প্রেমের কবি। উনার সাহিত্য ও গানের বিশাল অংশ জুড়ে আছে প্রেমের কবিতা আর গান । কবির গান গুলো এত বৈচিত্রময় যে শুনতে এক ঘেয়েমি লাগে না। মনে হয় প্রতিটি গানের বাণী ও সুর যেন আলাদা আলাদা। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের প্রেমিক পুরুষ। তাই নারীর রুপ ও ব্যাক্তিত্ব তাকে আকৃষ্ট করত।

তাইতো কবির জীবনে এসেছিল কয়েকজন নারী আসার খানম, ফজিলাতউন্নেসা, প্রমিলা। এরাই কবির জীবনের বিখ্যাত নারী। এর বাইরেও কিছু নারী কবির জীবনে এসেছিল ক্ষনিকের দখিনা হাওয়ার মত। আবার তারা সময়ে বারতায় হারিয়ে গেছে। তেমনই এক নারীকে নিয়ে আজ কবি কাজি নজরুল ইসলামের এক অজানা প্রেম কাহিনী।

কবি কাজি নজরুল ইসলাম রাজশাহী জেলায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজশাহীতে এক নজরুল ভক্ত ব্যাকুল হয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। কারন প্রানের চেয়ে প্রিয়তম কবি নজরুলকে নিজ চোখে দেখে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াকে সার্থক করবেন।

ভক্তটি ছিলেন একজন তরুনী। শুধু তরুনী বললে কম বলা হয় তিনি ছিলেন যেমন সুন্দরী তেমন ব্যাক্তিত্ববান,ও শিক্ষিত। তিনি যেদিন খবর পেয়েছেন তার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজশাহীতে আসবেন সেদিন থেকে তার অপেক্ষার প্রহর গুলি যেন হয়ে গেল দীর্ঘ ও অস্থিরময়। প্রতিটি ক্ষন যে আর ফুরাতে চায় না। কবে তার প্রিয় কবিকে দুই চোখ ভরে দেখবেন? কারন এতদিন কবিকে তার গল্প কবিতা, গানের মাঝে ও পত্রিকায় দেখেছেন। বাস্তবে দুই চোখ ভরে দেখা হয়নি।

তরুনী নির্দিষ্ট দিনে পদ্মার ঘাটে দাড়িয়ে থাকা স্টিমারে উঠলেন রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশে । পদ্মার পাক খাওয়া ঢেউয়ের ঘোলা জল কেটে এগিয়ে চলছে ষ্টিমার। তরুনি ষ্টিমারের রেলিংএ ঘেষে দাড়ি্যে আছেন । পদ্মার মাতাল বাতাসে তার দীঘল কালো চুল বেধে রাখা যাছ্ছে না। বার বার শাড়ির আচলের বাধন ছেড়ে নদীর মাতাল বাতাসের সাথে উড়ে যেতে চাইছে। তরুনী দুই হাতে অবাধ্য চুল গুলোকে বাধছেন আর ভাবছেন কিভাবে তার প্রিয় কবির সাথে দেখা করবে। দেখা হলে সে কি বলে কবিকে সম্ভাষন করবে। কবি কি তার সাথে কথা বলবে।

এই ভাবনার মাঝেই, হঠাৎ মেয়েলি অনুভূতিতে বুঝতে পারল, কে যেন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মধুর ভাবনায় ছন্দ-পতন হল। মাথা ঘুরিয়েই তাকাতেই দেখতে পেল এক তরুন ভাবালু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সুঠাম দেহ তার। বড় বড় দুই চোখে যেন রাজ্যর কাব্য ভেসে বেড়াছ্ছে। প্রশস্ত কাধের উপর ছড়ানো চুল তার পদ্মার বাতাসে উড়ছে। তরুনী নিজেকে সামলে নিল। যুবকটির অসভ্যতায় বিরক্ত বোধ করতে লাগল। তরুনী ঐ জায়গা থেকে সরে অন্য দিকে চলে গেলেন। সেখানে বসে আবার তার প্রিয় কবির ভাবনায় বিভোর হয়ে গেল। কবির সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে সারা মন শিহরীত হয়ে আছে।

এই সময় আবার যুবকটিকে দেখলেন। এবারও সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুনী এবার আর সরে গেল না। সাহস করে সোজা যুবকের দিকে এগিয়ে গেল। সরাসরি যুবকের সামনে এসে দাড়াল। তারপর যুবকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেনঃ আপনি এমন করছেন কেন? মেয়ে মানুষ কখনও দেখেননি? লজ্জা করে না এভাবে পথে ঘাটে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে?

যুবক কিছুই বললেন না। তরুনীর কথায় তার মোহনীয় মুখখানা পদ্মার নদীর পানির কালো রং ধারন করল। তারপর ধীর পায়ে তরুনির কাছ থেকে দুরে সরে গেল। এরপর আর সামনেও এল না তরুনীও সাছ্ছন্দ বোধ করল।

তরুনী যথা সময়ে অনুষ্ঠানে পৌছলেন। প্রিয় কবিকে দেখার জন্য সে সভার একেবারে সামনের দিকে বসলেন। কিছুক্ষন পর অনুষ্ঠান শুরু হল। অনুষ্ঠানের অতিথিবৃন্দ একজন একজন করে মঞ্চে উঠতে লাগল। এই সময় একটু হালকা শোরগোল শোনা গেল। দর্শকরা দেখতে পেল তাদের প্রিয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে মন্চে উঠে আসলেন। দর্শক সবাই দেখতে পেল সুঠাম দেহের অধিকারী, কাধ ছোয়া বাবড়ি চুল, বড় বড় টানা টানা দুই চোখ, সারা মুখ জুড়ে নিষ্পাপ হাসি মাখা কবি কাজি নজরুল ইসলাম তার নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। আর তরুনী দেখতে পেল তার কবি কাজি নজরুল ইসলাম আর কেউ নয়, পদ্মা নদীতে ঢেউ কেটে চলা ইষ্টিমারের তার সেই অসভ্য সহযাত্রী। যাকে সে অপমান করেছিল তার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে।

নজরুল মঞ্চে বসে সরাসরি তরুনীর দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হল দুজনের। চোখাচোখি হল কবি ও তার অচেনা ভক্তের। কবি নজরুলের চোখে চোখ পড়তেই তরুনী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। হায় হায় একি করেছে সে। যাকে সারা জীবন পুজা করেছে প্রিয় কবির বেদিতে রেখে, তার সাথে সে না জেনে না বুঝে একি আচরন করল।

এই সময় মঞ্চ থেকে ভেসে এল উপাস্থপকের ঘোষনা এখন সংগীত পরিবেশন করবেন আমাদের প্রিয় কবি কাজি নজরুল ইসালাম।

বেজে উঠল হারমোনিয়াম আর তবলার সম্মিলীত আওয়াজ। তার কিছু পড়েই যোগ হল কবির ভরাট কন্ঠের গান। সম্পূর্ন নতুন গন। কবির সব গান তরুনী কন্ঠস্থ, কিন্তু এই গান সম্পূর্ন নতুন যা আগে কখনও সে শুনেনি । তার মানে কবি এখনই এই গান খানা রচনা করেছেন। যা কবি কাজি নজরুল ইসলামের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার।

তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ?
চাদেরে হেরিয়া কাদে চকোরীনি ,
বলে নাত কিছু চাদ।
তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ।
চেয়ে চেয়ে দেখি ফোটে যবে ফুল ,
ফুল বলে নাত সে আমার ভুল.....

তরুনী বুঝতে পারল গান খানা তাকে নিয়ে কবি রচনা করেছেন। অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন, কবি তার দিকে তাকিয়েই গান গেয়ে যাছ্ছেন। কবির আশে পাশে তার বন্ধুরাও তাকিয়ে আছে আর মিটিমিটি হাসছে। এত সুন্দর গান শুনেও তরুনীর মনে হল হে ধরণী দ্বিধা হলে ভাল হত।

তরুনী এরপর ওভাবেই মাথা নিচু করে পুরো অনুষ্ঠানটা শেষ করল। অনুষ্ঠান শেষে, আর কিসের কবির সাথে দেখা করা আর কথা বলা, এখন পালাতে পারলেই সে যেন বেচে যায় ।

ষ্টিমারে ফিরতি পথে রওয়ানা দিল তরুনী। মনের মাঝে চলছে উথাল পাথাল আত্ম সমালোচনার ঢেউ। যার জন্য এত কিছু। যার সান্নিধ্য কিছু সময় কাটানোর জন্য কত প্রহর আর ক্ষন বিনিদ্র রজনী কেটেছে। তার সাথে প্রথম দেখায় সে একি আচরন করল। সেত পত্রিকায় কবির ছবিও দেখেছিল তারপরও কেন চিনতে পারল না ।কবির সাথে নিজকৃত আচরনের জন্য তরুনী কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। অনুতপ্ত হৃদয়খানি তার বার বার এর প্রায়শচিত্ত করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।

এই ঘটনায় তরুনী তার নিজের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। এক পর্যা্যে সে নিজের জীবন নিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তাকাল পদ্মা নদী পাক খাওয়া ঘোলা পানির দিকে। পৃথিবীর এই জমিনে যেন তার থাকার এতটুকু জায়গা নাই। পদ্মা নদীর বুকেই যেন সব শান্তি। নদীর অশান্ত জল যেন তার সকল গ্লানি মুছে দিয়ে তাকে দিবে চির শান্তির আস্বাদন।

কবি কাজি নজরুল রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় শুনতে পেলেন তার অচেনা সেই তরুনী ভক্তের পদ্মা নদীতে আত্মহত্যা করার করুন কাহিনী। সেই তরুনী ভক্তের মৃত্যুতে তার কবি হৃদয়ে হাহাকার করে উঠল।

জন্ম নিল আরেকটি কালজয়ি গান।

পদ্মার ঢেউরে __________এ 
মোর শুণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে,
পদ্মার ঢেউরে ,
এই পথও ছিলরে যার রাংগা পায়,
আমি হারায়েছি তারে,
আমি হারায়েছি তারে,
পদ্মার ঢেউরে __________এ 
মোর শুণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে,
পদ্মার ঢেউরে ,

পঠিত : ২৪৪০ বার

মন্তব্য: ০