Alapon

ইন্দোনেশিয়ায় ধ্বংসস্তূপে চলছে প্রাণের আহাজারি

ইন্দোনেশিয়ায় ২৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেখানে কম্পনের পর আছড়ে পড়ে প্রলয়ঙ্করী সুনামির ঢেউ। সুউচ্চ ঢেউ লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলীয় এলাকা। শুক্রবারের কম্পন ও সুনামির পর শনিবার উপকূলে সন্ধান মিলেছে বহু মরদেহের। শুক্রবারের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ৮৩২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন দেশটির কর্মকর্তারা। কয়েক দফা আফটার শকের কারণে ভবনের ধ্বংসাবশেষ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় উদ্ধারকারীরা ভারী যন্ত্রপাতির অপেক্ষায় রয়েছেন। আটকে পড়াদের আর্তনাদে সাড়া দিয়ে চেষ্টা চলছে খাবার আর পানি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা।

সুলাবেসি প্রদেশের রাজধানী পালু শহরে ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এই প্রদেশের বেশ কয়েকটি উপজেলা ও গ্রাম সুনামির ফলে সৃষ্ট ভূমিধ্বসে মাটির নিচে চলে গেছে। ভূমিকম্পের দুই দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও পালুর ধ্বংসস্তুপের মাঝে বসে ত্রাণ ও খাবারের অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে ত্রাণ যথাসময়ে না পৌঁছানোয় অনেকে নিজেরাই শপিং মলগুলোতে ঢুকে ট্রলিতে করে খাবার ও পানি লুট করে নিয়ে আসছে।  


ধ্বসে পড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে একজন জীবিত নারীকে 

ভুমিকম্পের সময় মিয়া নামের ৪০ বছরের এক নারী তার দুই মেয়েকে নিয়ে শপিং মলে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার কেনাকাটা শেষ করে ক্যাশিয়ারের কাছে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই সব অন্ধকার হয়ে যায় ও দেয়ালগুলো ধসে পড়তে শুরু করে। সেটা খুবই ভয়ংকর ছিলো।’ সেসময় ভাঙা এতটি এসকেলেটর দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে নেমে গিয়ে বেঁচে যান বলে জানান তিনি।

আটকে পড়া রাস্তা, ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দর এবং ভেঙে পড়া টেলিযোগাযোগ দুর্গত এলাকায় সাহায্য পৌঁছানো কঠিন করে তুলেছে। সুনামির কারণে সৃষ্ট প্রাণঘাতী ভূমিধসের কারণে দক্ষিণ পালুর পেতোবো উপজেলায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভূমিধস তাদের বাড়িঘর পুরোপুরি ধুয়ে নিয়ে গেছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জাকার্তা পোস্টকে বলেছেন, ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসছিল ভূমিধস। পশ্চিম পালুর আরেক উপজেলাও মাটির নিচে ডুবে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

কেন্দ্রীয় সুলাবেসি উপকূল থেকে দূরবর্তী দ্বীপ দংগালা। এর রাজধানী বানাওয়া। পালু থেকে সেখানে যেতে সাধারণত সময় লাগে ৩০ মিনিট। ৩ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে। দংগালায় এখনও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে পারেনি উদ্ধারকারীরা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে পালু থেকে নৌপথে ৩০ মিনিট দূরত্বের দংগালা দ্বীপে এখনও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা যায়নি। ইন্দোনেশিয়ান রেডক্রসের এক ভিডিওতে দেখা গেছে সুনামির পর সেখানে টিকে থাকা বাড়ি দেখতে পাওয়াই কষ্টকর। ধ্বসংস্তূপের মধ্য থেকে বেঁচে থাকার মতো উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টায় রয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা।


পালুতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মসজিদ 

পালুতে যে পরিমাণ মরদেহের স্তুপ তৈরি হচ্ছে তার সৎকার নিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র সুতোপো পুরও নুগরোহো রবিবার রাতে আপাতভাবে মরদেহগুলিকে গণকবরে মাটি চাপা দেওয়ার কথা জানান। তিনি জানান পরে ওই মরদেহগুলিকে ভালোভাবে সৎকার করা হবে। সোমবার সকালে টুইটারে পাবোয়া কবরস্থান পরিদর্শনের ছবি পোস্ট করেন। এই কবরস্থানের মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়ার কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দ্রুতভাবে মাটি চাপা দেওয়ার কাজ শুরু হবে। মৃতদেহ গণকবর দেওয়ার জন্য পালুতে ১০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার প্রস্থের একটি গণকবর  খোঁড়ার কথা বলেছেন তিনি। সেখানে ৩০০টি মরদেহ মাটি চাপা দেওয়া হবে। তবে প্রয়োজন পড়লে গণকবরের আয়তন আরও বাড়ানো হবে।

জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়া চলছেসংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি থেকে দেখা যায়, বিমাবন্দরে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সবার অপেক্ষা কখন হারকিউলিস ফ্লাইট এসে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে  জীবিতদের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডো। রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি বলেন, ত্রাণকর্মীরা যেন বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সরবরাহ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও সহায়তা অনুরোধ জানিয়েছেন ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেন্ট। ইতোমধ্যে এগিয়ে এসেছে বিশ্ব সম্প্রদায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৭ লাখ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়া ১০ লাখ ডলার অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর অস্ট্রেলীয় সরকার জানায় তারা ইন্দোনেশিয়াকে কিভাবে সহায়তা করা যায় সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।


ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়া সেতু 

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো বলেছেন, দুর্যোগে আন্তর্জাতিক ত্রাণ গ্রহণ গত রাতে অনুমোদন করেছে তার দেশ। গতকাল পর্যন্ত ‘প্রাদেশিক পর্যায়ের দুর্যোগ’ ঘোষিত থাকাই মাঠ পর্যায়ের উদ্ধারকর্মীরা খানিক হতাশ ছিলেন। তবে এই আন্তর্জাতিক ত্রাণ গ্রহণের অনুমোদনের খবর তাদের খানিক স্বস্তি দিয়েছে। সুলাসেবেসি প্রদেশে ১৪ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে এই দুর্যোগকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণায় অস্বীকৃতি জানিয়েছেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসোফ কাল্লা। সুলাসেলির প্রাদেশিক সরকার পুরোপুরি কাজ করতে পারাকেই এই অস্বীকৃতির কারণ জানিয়েছেন তিনি।

খোলা আকাশের নিচে চলছে আহতদের চিকিৎসাধ্বংসস্তূপ সরাতে প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি এখনও দুর্গত এলাকায় পৌঁছায়নি। ফলে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে এখনও উদ্ধারকারীদের হাত-পায়ের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। পালুর রোয়া রোয়া হোটেলের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সোমবার সকালেও ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মানুষের আর্তনাদ শোনা গেছে। সুনামি সতর্কতা প্রত্যাহার করে তোপের মুখে থাকা ইন্দোনেশিয়ার ভূতাত্ত্বিক সংস্থা অবশ্য এখনও নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। তাদের দাবি যেভাবে অভিযোগ তোলা হচ্ছে ঘটনা তেমন নয়। বরং সুনামির তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পরই তারা সতর্কতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল বলে দাবি করছে তারা। ভেঙে পড়া টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা কয়েকটি এলাকায় আবারও পুনর্বহাল করা সম্ভব হয়েছে। তবে পালুতে এখনও বিদ্যুত সরবরাহ শুরু হয়নি।

ভূমিকম্প ও সুনামির কবলিত সুলয়াওয়েসির কারাগার থেকে ১২০০ আসামি পালিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ইন্দোনেশীয় আইন মন্ত্রণালয়। এদিকে এখনও পাঁচজন বিদেশি নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন ফরাসি, একজন মালয়েশীয় ও একজন দক্ষিণ কোরীয় রয়েছেন। ইন্দোনেশীয় সরকার জানায়, এখন পর্যন্ত ১১৪ জন বিদেশি নাগরিককে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

পঠিত : ৬৬৫ বার

মন্তব্য: ০