Alapon

অপেক্ষা

অপেক্ষা


একঃ


-‘আমার মতামত জানতে চাও? নাকি তোমাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে চাও?’ চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে মা তামান্না শহীদকে প্রশ্ন করলো তাহিয়া সাফা।


- ‘তুই ‘তোমাদের সিদ্ধান্ত’ বলে আমাকেও তোর বাবার সাথে মিলিয়ে চিন্তা করছিস কেন মা? আমি তো এই ব্যাপারে তোর বাবার সাথে একমত নই, তুইও জানিস।’


-‘তাহলে বাবাকে জানিয়ে দিও আমি ওনার সিদ্ধান্তের বাহিরে যাব না। সাথে এটাও জানিয়ে রেখো, আমার মতামত জানতে চাইলে বলতাম, হাসিব ভাইকে আমার পছন্দ হয়েছে।শুধুমাত্র আদর্শিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে এই প্রস্তাব বাতিল করা হলে, আমি কেবল ধৈর্যধারণ করব। বাবা যে কারণে হাসিব ভাইকে প্রত্যাখ্যান করছে, ঠিক একই কারণে তো আমাকেও প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ। আমি হাসিব ভাইয়ের আদর্শিক অবস্থানকে কেবল সম্মানই করিনা; নিজেকেও সেই আদর্শের ধাঁচে গড়ে তুলছি। ঠিক আছে, বাবার অমতে কিছুই হবে না।’ কথাগুলো বলেই ওড়নাতে মুখ ঢেকে পাশের রুমে চলে গেল তাহিয়া।


 দুপুর গড়িয়ে যায়। তাহিয়া দরজা খোলে না। মা অনেক্ষণ দরজায় ডাকাডাকি করলেন। ভেতর থেকে তাহিয়া বলে- ‘মা, তুমি যাও। আমি কোন দূর্ঘটনার দিকে যাব না। আমি একটু একা থাকতে চাই কিছুক্ষণ।’


মায়ের মন। স্বামীর ঘরে গিয়ে রাগ উগড়িয়ে দিলেন।


বললেন-‘ আমার মেয়ের কিছু হলে, তবে তুমি জিদ ছাড়বে। ভাল একটা ছেলেকে তুমি কেবল একটা মামুলী বিষয়ে প্রত্যাখ্যান করছো। এই জামানায় কয়জন ছেলে নামায পড়ে, হ্যাঁ? কয়জন সিগারেট খায় না? কয়জন পর্দা ঠিকঠাক করে? হাসিব ছেলেটার এইসব গুন থাকা স্বত্তেও তুমি এমন করছো কেন?’


ভদ্রলোক নিরুত্তর। কি যেন ভাবছেন। চশমা খুলে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন- ‘তাহিয়াকে গিয়ে বল- জোহরের ওয়াক্ত শেষের দিকে। দেখবে, ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে গোসল করে নামায পড়তে বসবে।’


মিসেস তামান্না ভ্রু কুঁচকিয়ে বলেন- ‘মেয়ের প্রতি এমন আস্থা; অথচ বিয়ের ব্যাপারে তার মতামতও নিতে চাইছো না!’


ভদ্রলোক-জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন। কি যেন বুঝতে চাইছেন!


 


 


 


দুইঃ


বাড়িতে সপ্তাহজুড়েই মান-অভিমানের আবহ। ডাঃ সাদিকুল ইসলাম শহীদ সাহেব একমাত্র মেয়েকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করানোর পর থেকে টেনশনে আছেন। গাইবান্দা থেকে রাজশাহীতে প্রতি সপ্তাহে গিয়ে দেখে আসেন। না পারেন নিজের চেম্বার ফেলে মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে, না পারেন স্বস্তি নিয়ে চেম্বার করতে। মাত্র ছয় মাস হল তাহিয়া বাড়ি ছেড়ে রাজশাহী আছে। তাতেই হাঁপিয়ে উঠেছেন দুজনেই। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সপ্তাহান্তে মেয়েকে দেখে কিছুটা প্রশান্তি আসে। কিন্তু জামানার বালিয়াড়িতে কতটা ভাল থাকা যায়? কখন কি হয়ে যায়? তাহিয়া ছাড়া তো আর কেউ নাই। মেয়ে যত বড় হয়েছে, পাল্লা দিয়ে রাজপূত্র পাওয়ার টেনশনও বেড়েছে। এবার সিদ্ধান্ত ফাইনাল। মেয়েকে একা রাখবেন না। জামাইয়ের সাথেই মেয়ের গাঁটছাড়া বেঁধে দিবেন। মেডিকেলের পাশে ঘোষপাড়া মোড়ে দুই রুমের ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে যেন শহীদ সাহেব নিজের কনফিডেন্স বাড়িয়ে নিয়ে ভাবছেন জামাই এবার আসছেই।


মুশকিল হল চাইলেই তো আর জামাই মেলে না। ঢাকাই নাকি বউবাজার আছে। বউবাজার শুনলেই মাথায় আসে সেখানে বুঝি বর তার বউ খুঁজতে যান। বাজার কমিটি বেরসিক বটে! আর কোন নাম নাই, বাজারের নাম বউবাজার। শহীদ সাহেবের এখন যেমন ‘জামাইবাজার’ খুব দরকার! মেডিকেল পড়ুয়া মেয়েকে যোগ্য পাত্রস্থ করতে পেরেশানীর শেষ নাই। চিরায়ত বাঙ্গালিয়া পেরেশানী। এই মেয়েই তার জীবন। প্রচন্ড মেধাবী। ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হয়নি। ভাল বক্তৃতা ও উপস্থাপনা করে। হিজাবের সাথে তার স্মার্টনেস যেন একাকার। অনলাইন-অফলাইনে দুটোতেই দাওয়াহ’র কাজে তৎপর। শহীদ সাহেব অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- রাজশাহী কেন্দ্রীক জামাই খুঁজবেন। খুব ভাল হয়, রামেকের সাবেক ছাত্র কাউকে পেলে। একেবারে কমপ্লিট ডাক্তার হতে হবে এমন নয়; মেডিকেল পড়ুয়া সিনিয়ার কেউ হলেও চলবে। কন্যার বাপদের এক দোষের কথা ডাঃ শহীদ জানেন। নিজ কণ্যা ছাত্রী হলেও পাত্রকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত পেশাদার হতে হবে। শহীদ সাহেব নিজেও চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়া অবস্থায় চবি পড়ুয়া সাইয়্যেদা তামান্না রুনাকে বিয়ে করেছিলেন। আজ মেয়ের বাপ হয়েও সেই দর্শন থেকে সরে আসেন নি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ছেলেকে দেখা হয়েছে। ব্যাটে-বলে না হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়েই আলোচনা শেষ। সব মিলিয়ে হাসিব ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেলে ইন্টার্ন করছেন। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাবা রিটায়ার্ড প্রফেসর। মা প্রাইমারীর প্রধান শিক্ষিকা। এ বছরেই রিটায়ার্মেন্টে যাবেন। দুই ভাই, এক বোনের মাঝে বড়। হাসিব ছেলেটার সন্ধান দিয়েছে তাহিয়ার মেডিকেলের সিনিয়ার রোদেলা আপু। রোদেলার ক্লাসমেট হাসিব।


 


আজ হাসিব মা-বাবা ও ছোট বোনকে সাথে নিয়ে গাইবান্দা তাহিয়াদের বাড়িতে এসেছে। দুই পরিবারের সম্মতিতে রাজশাহীতেই রোদেলার বাসায় হাসিব ও তাহিয়ার প্রথম পর্বের সাক্ষাৎ হয়েছে। দুইজন তাদের জীবন, দর্শন, স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও আকাঙ্ক্ষার কথা পরস্পরকে জানিয়েছে। গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে আজ গাইবান্দায় এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা। হঠাৎ করে বেঁকে বসেছেন শহীদ সাহেব। মেয়েকে সাবেক ছাত্রনেতার হাতে কোনমতেই তুলে দিবেন না। অথচ ওনি আগে থেকে জানতেন ছেলে ছাত্ররাজনীতি করতো। সব জেনেই এ পর্যন্ত আসা। অথচ...


 


তিনঃ


তাহিয়া এবার সত্যিই ঘর থেকে বের হল। গোসল করে নামাযের ঘরে গেল। বিকালে ঘুম থেকে উঠে পারিবারিক স্টাডি রুমে বসে আছে। নারীবার্তা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। ভাল লাগছে না। হাসিব ভাইয়ের আব্বা-আম্মা ও বোনকে এভাবে ফেরত পাঠানোকে ভাল লাগেনি তাহিয়ার। সত্যি বলতে কি- সেদিন রাজশাহীর সিটিং এর পর হাসিব ভাইকে ভাল লাগার শুরু হয়েছে। কত সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব! ভাল লাগার বিশেষ কারণ হাসিবের আদর্শিক দৃঢ়তা। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনেই নবীন বরণে হাসিব ভাইয়ের বক্তৃতা শুনেছে। রোদেলা আপুর বাসায় প্রথম দেখেই সেই নবীন বরণের বক্তৃতার কথা মনে পড়ে যায়। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর ক্যাম্পাসের অনেক আপুই তাহিয়াকে উইশ করেছে। একজন ভাল মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাচ্ছো-বলেছে অনেকেই। প্রফেসর শরিফা মানসুরা তো রুমে ডেকে নিয়ে দোয়া করে দিয়েছেন। বলেছেন- মনে রেখো, হাসিব আমার ছেলে কিন্তু। তুমি আমার বউমা হয়ে আসছো। ...... অনেককিছু ভাবছে তাহিয়া। ম্যাগাজিনের উপর হাত আর তার উপর মাথা রেখে চিন্তার রাজ্যে। 


কখন বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে শুনলো সেই পরিচিত কন্ঠ- তাহি!


-বাবা, তুমি?


- খুব কষ্ট পেয়েছিস মা, না রে?   


তাহিয়ার কাছে এই লাইনটা খুব চেনা। যখনই মন খারাপের পর বাবা কোন আবদার পুরুণ করতে এসেছে, তখনই বলে ‘খুব কষ্ট পেয়েছিস মা, না রে?’ তাহিয়া এবার কৃত্রিম ভাব নিয়ে বলে- ‘না, বাবা। মেয়ে হিসেবে তোমার আনুগত্য করাটাই আমার কাছে প্রথম বিবেচ্য। তোমার মেয়ে তার বাবার সিদ্ধান্ত নিঃশংকোচিত্তে মেনে নিতে জানে।’


হু হু করে কেঁদে ওঠেন ডাঃ সাদিকুল ইসলাম শহীদ।


-‘মা রে ! তুই ছাড়া আমার আর কি আছে বল? তোর চাওয়ার বিরুদ্ধে আমি কখন, কি করেছি বল? আজ কেন হাসিবের ব্যাপারে অমত করছি, তোকে কিছু বলবো না। যদি সুযোগ পাই বলবো একদিন।’


- ‘বাবা, কোনদিনই বলতে হবে না। আমি হাসিব ভাইকে বিয়ে করছি না তো।’


- ‘মা রে, বুঝি তো তোকে। আমি হাসিবের সাথে তোর বিয়েতে রাজী। আল্লাহ্‌ তোদের কবুল করুন।’


মেয়ের গাল ধরে টান দিয়ে বলেন- ‘এবার একটু হাসি দে মা। তুই কাঁদলে আমার জীবন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝড়ে। তুই হাসলে আমার বুকের ব্যাথা সেরে যায়।’


 তাহিয়া বাবার বুকে মাথা রাখে। অনেকক্ষন চুপ করে থাকে।


চারঃ


আজ শুক্রবার। তাহিয়া লাল বেনারশি পড়েছে। এমনিতেই রাজকণ্যা। আজ বিয়ের সাজে আরো সুন্দর লাগছে। বান্ধবীদের টিপ্পনী । ট্রিটের বন্দোবস্তোও চলছে। তাহিয়ার কাজিন কূল পাশেই বর পক্ষের বিয়ে ফি’র পরিমান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শলাপরামর্শে বসেছে। তাহিয়া একবার ধমক দিয়ে বলে দিল- ‘এই তোরা টাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবি না।’ ধমক শুনে পিচ্চিরা ভড়কে না গিয়ে উল্টো এসে বলল- ‘আপ্পি, তুমি ইতোমধ্যে ভাইয়ার পক্ষের লোক হয়ে গেছো? মানে তুমি বরপক্ষের লোক? তুমি ওদের পক্ষে ওকালতি করছো? ’ আতিয়া, ‘চুপ কর’- বলে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবে- ‘তাই তো! আমি ওনার পক্ষের হয়ে গেলাম কিভাবে?’ মেডিকেল থেকে একদল বান্ধবী এসেছে। আফসানা গালে টোকা দিয়ে বলল- ‘ক্লাস কিন্তু পুরোদমে চলছে! মিস করিস না।’ সবাই হেসে উঠলো। এক প্রানবন্ত ও পবিত্র শুভ্র পরিবেশ।


 


সব আয়োজন সম্পন্ন। শুধু বর আসা বাঁকি। জোহরের নামাযের সময় সন্নিকটে। শহীদ সাহেবের সাথে হাসিবের বাবার অব্যাহত কথা হচ্ছে। যে জায়গার কথা বলেছে, তাতে আর মিনিট বিশেক লাগার কথা। বরযাত্রীকে রিসিভ করা এবং প্রাথমিক আপ্যায়নের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাগাদা দিলেন শহীদ সাহেব। রোদে ঘেমে গেছেন। চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কাজী সাহেব আগেই এসেছেন। কাজীকে ডেকে নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন। মুঠোফোন বেজে উঠলো। হবু বেয়াই মশাইয়ের ফোন। রিসিভ করেই বললেন- ‘কতদূর?’


ওপাড় থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কিছু বলা হলো। শহীদ সাহেব চেয়ারে বসে পড়লেন। দরদর করে ঘাম ঝড়তে লাগলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- ‘ইয়া আল্লাহ্‌, তুমি হেফাজত করো।’


সবাই দৌড়ে আসলেন। শহীদ সাহেব কারো কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবারো ফোন হাতে নিলেন। ওসি সাহেবকে ফোন দিলেন। বললেন- ‘কি অপরাধ করলাম ওসি সাহেব। প্লিজ, আপনি নির্দয় হবেন না। আমার মেয়েকে কি জবাব দিব? প্লিজ, হাসিবকে ছেড়ে দিন। যা লাগে আমি দিব আপনাদের।’


ওপাড় থেকে অনেক কথা হলো। কিন্তু...।


তাহিয়ার কানেও খবর পৌঁছে গেছে। তাহিয়া একদম নীরব। সবাই শ্বান্তনা দিচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহিয়া যেন কিছুই শুনছে না। আনন্দের মুহুর্তগুলো বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। সাজানো বিয়ে বাড়ি মুহুর্তেই বিবর্ণ লাগছে। শুনশান নিরবতা। মধ্য রাতের নিরবতার আলাদা ভাষা আছে। কিন্তু মধ্য দুপুরের নিরবতার ভাষাটা বড্ড কঠিন! বেসুরা! বেদনার নীলে ঢাকা।


 


 


 


পাঁচঃ


রাজশাহী মেডিকেলের মর্গ। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির এক শরীর পড়ে আছে। সাদা কাপড়ে জড়ানো। ঘন্টাখানিক আগেই অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে জানা হয়ে গেছে শহরের উপকন্ঠে বন্দুকযুদ্ধে মেডিকেল ইন্টার্ন ডাক্তার হাসিব (২৭) নামের একজন নিহত। দুই পুলিশ আহত; একটি বিদেশী রিভালবার উদ্ধার।


হাসিবের গ্রামের বাড়ি। কফিনকে ঘিরে শত মানুষ। সহকর্মী ডাক্তার, গ্রামবাসী, স্বজনদের ভীড়। হাসিবের মুখটা আজ কেন জানি খুব বেশী শুভ্র। যেন অপলক তাকিয়ে হাসছে। থেমে থেমে কান্নার শব্দ আসছে। পুলিশ বেষ্টনী ঠেলে কয়েকজন যুবক দোয়া করে গেল। রইস চাচা এসে হাসিবের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ আমরা হাসুর লাশ তো পেয়েছি! অনেক ভাগ্যবান আমরা। কত বাবা লাশের আশায় পথ চেয়ে আছে? আমরা তো মাত্র পাঁচ দিনেই পেয়েছি।’


তাহিয়া গাইবান্দা থেকে বাবা-মা’র সাথে এসে পৌঁছেছে, ঘন্টাখানিক হলো। এতক্ষণ কফিনের সামনে আসার সাহস পায়নি। স্বপ্ন মুখ দেখবে কি করে? কথা ছিল- যখন সে দেখবে, সেখানে আর কেউ থাকবে না। শত লোকের ভীড়ে এই মুখটা দেখতে হবে। বুকের ঠিক মাঝখানে একটু একটু ব্যাথা লাগছে তাহিয়ার। খুব জোড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মেয়েদের দল এসে একজন আরেকজনকে বলছে- ‘ঐ যে আমাদের ভাবী।’ এই ‘ভাবী’ শব্দটা তাহিয়ার অনেকবার শুনতে ইচ্ছে করছে।


ভীড়ের মাঝ থেকে তাহিয়া তার বাবার সাথে কফিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। তখনো নীরব তাহিয়া। একদম নিশ্চুপ। শহীদ সাহেব ধরে আছেন। হাসিবের মুখ খোলা। তাহিয়া তাকাল। প্রশান্ত তাহিয়ার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু কফিনের পাশেই পড়ে গেল। বুকের ব্যাথাটা লুকানো গেলেও এই অশ্রু লুকানো গেল না। হিজাবের ফাঁক গলেও পাশের মেয়েরা তা বুঝতে পারল।


তাহিয়া অবিরত দোয়া পড়ে চলছে। দু’হাত উঠালো। মেহেদীর রং তখন যেন একটু বেশীই গাঢ় দেখাচ্ছিল। গত পাঁচদিনে হাতের মেহেদী লাল কি যেন আরেক লাল খুঁজে ফিরেছে। কফিনের সাদা কাফনেও একটু লালচে ধরেছে। এ যেন হাসিবের কলিজা ঠিকরে পড়া মেহেদী! তাহিয়া মুনাজাত করছে সংগোপনে।


‘হে আল্লাহ্‌- তুমি ওনাকে কবুল করেছো, শুকরিয়া। আমায় কী তার সাথে কবুল করেছো? আমার কাছে কোন ডকুমেন্টস নাই, ইয়া আল্লাহ্‌। কিন্তু তুমি সাক্ষী। তুমি আমার হৃদয় পড়েছো। কিছু চাই না। ওপাড়ে তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে কবুল করো’।


 


তাহিয়া আসমানের দিকে তাকালো। দিনের শেষের বেলা।  সাদা মেঘগুলো সরে যাচ্ছে। 

পঠিত : ৯২৬২৭৪ বার

মন্তব্য: ০