Alapon

Milli Gazete- বিপ্লব ও জাগ্রত উম্মাহর অঘোষিত অণুকাব্যঃ

"হক্ব সমাগত, বাতিল অপসারিত", কুর'আনের এই বাণীকে ধারণ করে বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে, সমৃদ্ধ একটি মুসলিম উম্মাহ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৩ সালের ১২ ই জানুয়ারী এক কন্টকাকীর্ণ পথের যাত্রা শুরু করেছিল তুরস্কে ইসলামী আন্দোলন 'মিল্লি গুরুশ' এর মিডিয়া জগতের প্রথম পদক্ষেপ, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ এবং নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের পক্ষে সদা সোচ্চার ও প্রতিবাদী কন্ঠ "মিল্লি গাজেত" পত্রিকা।

সুদূর মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিশাল এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে, জালিমের বিরুদ্ধে দুনিয়ার কোন শক্তিকে পরোয়া না করেই সত্য ও ন্যায়ের একনিষ্ঠ কন্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মিল্লি গাজেতে।
মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রফে.ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান বিশ্বব্যাপী জায়নবাদী ইহুদীদের নীল নকশার উন্মোচন করেন মিল্লি গাজেত পত্রিকার মাধ্যমে। জনগণের বুঝার সুবিধার্তে অন্ত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষায় জুলুমবাজ ইহুদীদের চক্রান্তের খোলাসা করেন মিল্লি গাজেতের প্রথম সংস্করণেই।
প্রথম সংস্করণ
১৯৭৩ সালের ১২ ই জানুয়ারীর প্রথম সংস্করণের শিরোনাম ছিল-
'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীদের প্রথম কংগ্রেস।'
সেই সাথে প্রথম পাতায় আরও যেসকল শিরোনাম ছিল-
"পৃথিবীর ২০ টি দেশের বসবাসকারী ইহুদী প্রতিনিধিরা এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করবেন।"
"বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে ইহুদীরা কেন তেল-আবিবে একত্রিত না হয়ে লন্ডনে কংগ্রেস করছে??"
এরপর মিল্লি গাজেতে ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক পারমাণবিক বোমার মত শক্তিশালী খবর প্রকাশ করতে থাকে, যা তার্কির জনগণকে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ইহুদীবাদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন করতে সক্ষম হয়।
সেসময়কার তার্কির ইসলামের ত্রাণকর্তা প্রেসিডেন্ট সুলেমান দেমিরেল ইসরাঈলের বিরুদ্ধে টু শব্দ না করলেও মিলি গাজেত পত্রিকা তার্কির জনগণের মধ্যে এই অনুভূতি তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল যে- "ইসরাঈল একটি অবৈধ রাষ্ট্র। ফিলিস্তিন আজ মজলুম। আর মজলুমেরা হচ্ছে আমাদের ভাই।"
তুরস্কের আপামর জনগণের মধ্যে একটি বাণী তারা পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে- "আপনি সেক্যুলার হতে পারেন, নাস্তিক হতে পারেন কিন্তু জালিমকে যদি জালিম হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারেন এবং একই সাথে মজলুমের পক্ষে যদি আপনার কন্ঠ উচ্চকিত না করেন তাহলে আপনার মনুষ্যত্ব বিবেকের কাঠগড়ায় প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে বাধ্য।"
সাইপ্রাস বিজয়ের পটভূমি রচনাঃ
১৯৬০-৭৪ সালে সাইপ্রাসের মুসলিমদের উপর যে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ ও জুলুম-নিপীড়ন চলছিল সে সম্পর্কে তুরস্কের কয়েকটি পত্রিকা অত্যন্ত দায়সারা ভাবে হাতে গোণা কিছু রিপোর্ট তৈরী করে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিল যে- "এসব সাইপ্রাসের নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের কী?"
মিল্লি গুরুশের প্রধান প্রফে.ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান ও তার দল মিল্লি সালামেত পার্টি তখন বামপন্থী দল CHP এর সাথে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায়। তিনি তখন ভাইস-প্রাইমিনিস্টারের দায়িত্বে।
তার নির্দেশে তুরস্কের প্রাচীন গবেষণা সংস্থা ESAM (Ekonomik ve Sosyal Araştırmalar Merkezi) এর সহযোগিতায় ১৯৬০ সাল থেকে সাইপ্রাসে মুসলিমদের উপর যেসকল নির্যাতন চলেছিল সেসকল বিষয় নিয়ে মিল্লি গাজেত পত্রিকা একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে। ফলাফল খুব দ্রুতই প্রকাশ পেতে থাকে। তার্কির জনগণ ব্যাপকভাবে আলোড়িত হয় এবং সাইপ্রাসের মুসলিমদের পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করে। যার দরুন অন্যান্য পত্রিকাও তাদের সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়।
অতঃপর প্রফেসর এরবাকান প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেই সাইপ্রাস হামলার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর প্রদান করেন। একরাতেই সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে সাইপ্রাস অভিমুখে প্রেরণ করেন। বাম্পন্থী দল CHP বাধ্য হয়েই তার সকল সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
সাইপ্রাস বিজয়ের ক্ষেত্রে মিল্লি গাজেত পত্রিকা পর্দার আড়াল থেকেই কাজ করেছে। একধারে সাইপ্রাসের গুরুত্ব এবং ইসলামপ্রিয় জনগণের ভেতরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী মূল্যবোধ তৈরী করে বিশ্বের সকল মুসলিমের পাশে দাড়াতে তার্কির জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকে।
পরবর্তীতে বসনিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মিল্লি গাজেতে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও আফগানিস্তান, মরো, পাত্তানী, উইঘুর মুসলিমদের জন্য পৃষ্টার পর পৃষ্টা সংবাদ ছেপেছে কোনরকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই।
পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের সচিত্র বর্ণনা মিল্লি গাজেত প্রায়শই প্রকাশ করে থাকে। ইখওয়ানের উপর মিশরের সরকারের নির্যাতন, ফিলিপাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী মরো এর উপর প্রতিনিয়ত সংবাদ উপস্থাপন করছে মিল্লি গাজেতে।
মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশই মরো সম্পর্কে বেখবর ছিল। ফিলিপাইনের এই নির্যাতিত ভাইদের জন্য কখনো কোন মুসলিম দেশ কোনপ্রকার উচ্চবাচ্য করে তো নাইই, অনেকে তো তাঁদের সম্পর্কে জানেই না।
মিল্লি গাজেতের সুবাদের আজ অন্তত ইসলাম প্রিয় জনগণ মরো এর জনগণের কথা জানতে পারছে, তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জামাতে ইসলামী ও মিল্লি গাজেতেঃ
এইতো ৭-৮ বছর পূর্বের কথা তুরস্কের জনগণ বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতই না। বর্তমানেও যারা অন্তত বাংলাদেশের নাম শুনেছে তা শুধুমাত্র জামাতে ইসলামীর কল্যাণে। তুরস্কের জনগণের কাছে জামাতে ইসলামী নামটিকে পরিচিত করেন প্রফে.নাজমুদ্দিন এরবাকান।
২০১০ সালে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর উপর যখন অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছিল ঠিক তখনই কাল বিলম্ব না করেই মিল্লি গাজেতে কে নির্দেশ দেন জামাতে ইসলামীর জন্য নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বরাদ্দ রাখতে। এরপর থেকে মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের পত্রিকা মিল্লি গাজেতে, এবং মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের রাজনৈতিক দল সাদেত পার্টি (Saadet Partisi Resmi Sayfası) ও তার ছাত্রসংগঠন (AGD Şebinkarahisar - Anadolu Gençlik Derneği) তুরস্কের প্রত্যেক শহরে, গ্রামে আনাচে কানাচে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে।
২০১২ সাল থেকে তুরস্কের রাজধানী আনকারায় বসবাসরত গুটিকয়েক বাংলাদেশী ছাত্রের সহযোগীতায় মিল্লি গাজেত পত্রিকা প্রত্যেকদিন জামাতে ইসলামীর জন্য বরাদ্দকৃত পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়িয়ে একের পর এক সংবাদ উপস্থাপন করতে থাকে।
আব্দুল কাদের মোল্লাহর ফাঁসীর পর পুরো তুরস্কে ভিন্ন এক আবহ তৈরী করতে সক্ষম হয়। পুরো তুরস্কে বলা যায় মিল্লি গাজেতে এক প্রকার বিলি করা হয়। লিফলেট থেকে শুরু করে যা সম্ভব হয়েছে তার সবটিই করেছে মিল্লি গাজেতে।
মিল্লি গাজেত পত্রিকায় কাদের মোল্লাকে নিয়ে শিরোনাম
এরপর থেকে পুরো তুরস্কের ইসলাম প্রিয় জনগণের নিকট বাংলাদেশের অপর নাম হয়ে উঠে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা।
তুরস্কে আসার পর সাধারণ অনেক জনগণের সাথে যখন কথা হতো তখন নিজের দেশ বাংলাদেশ পরিচয় দেয়ার পর জনসাধারণ বলে উঠতো- 'ওহ, কাদের মোল্লার দেশ?"
কাদের মোল্লা সাহেবের ফাঁসীর পরদিনই পত্রিকার শিরোনাম হয়-
হে সম্মানিত শহীদ, আপনার শাহাদাৎ কবুল হোক।
শহীদ কামরুজ্জামান

একই সাথে প্রতিদিনের ন্যায় পত্রিকার পুরো দুই পৃষ্টা জুড়ে থাকে জামাতে ইসলামী সংক্রান্ত নানা তথ্য ও বিবরণ এবং সরকার কর্তৃক অত্যাচারের বর্ণনা।
এরপর কামরুজ্জামান সাহেবের ফাঁসীর পর একইভাবে পুরো দেশে সমাবেশ সেমিনার ও পত্রিকায় একের পর এক বিবরণ দিয়ে তুরস্কের জনগণের মধ্যে জামাতের ইসলামীর প্রতি সচেতনতা তৈরী করে।
কামরুজ্জামান সাহেবের হত্যাকান্ডের পর বিভিন্ন জায়গায় তাকে নিয়ে বলা হয়-
"বিদায়!!! হে জান্নাতের পথিক।"
সাবেক আমীর শহীদ মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের ফাঁসীর পর পুরো তুরস্কে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রসংগঠন AGD.
মিল্লি গাজেতে যথারীতি তার দায়িত্ব পালন করছিল।
মতিউর রহমান নিজামীকে নিয়ে মিল্লি গাজেতের প্রতিবেদন

পত্রিকায় শিরোনাম হয়...
"এই উম্মাহ তোমরা কোথায়??
"মুসলিমরা ঘুমে আচ্ছন্ন, অপরদিকে ফাঁসী চলছে নিরবিচ্ছিন্ন।"
জাতি নিশ্চুপ হয়ে আছে, অপরদিকে আলিমরা চলে যাচ্ছে।

পরবর্তীতে এ শিরোনামে সংবাদ ছাপানো হয়-
"জাতি নিশ্চুপ হয়ে আছে, অপরদিকে আলিমরা চলে যাচ্ছে।(দুনিয়া হতে)
জামাতে ইসলামীর সেই দুঃসময়ে এক ভাইয়ের মতো কোন বিনিময় ব্যতীত নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছে মিল্লি গুরুশ তথা তার পত্রিকা মিল্লি গাজেতে। যখন পক্ষে কেউ কথা বলার ছিল না, তখন বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই জামাতে ইসলামীর পাশে দাঁড়িয়েছিল মিল্লি গাজেত পত্রিকা। এখনো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী ও তাঁদের শহীদ নেতাদের নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। প্রত্যেক নেতার শাহাদাৎ বার্ষিকীতে পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীকে নিয়েই কথা হয়ে থাকে।
জামাতে ইসলামীর পাশাপাশি ফিলিস্তিন নিয়ে পত্রিকাটি সূক্ষ্ম সতর্কতা অবলম্বন করে। সেজন্য-
তুরস্কের মাটিতে ইসরাঈলী সৈন্যদের ট্রেনিং কেন এখনো বন্ধ হয় নি? তুরস্ক সরকার, ইসরাঈলের বিরুদ্ধে এত হম্বিতম্ভি করার পরও কীভাবে সন্ত্রাসী ইসরাঈল রাষ্ট্র এখনো তুরস্কের মাটিতে তুর্কি সৈন্যদের সাথে ট্রেনিং নিচ্ছে?? তুরস্কের সাথে ইসরাঈলের ব্যবসায়িক সম্পর্ক কেন ও কীভাবে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে??
একদিকে ফিলিস্তিনের প্রতি মর্মস্পর্শী বাণী ও ইসরাঈলের প্রতি অনলবর্ষী ভাষণ, অন্যদিকে ইসরাঈলের সাথে টেবিলের নীচের সুসম্পর্ক, এসকল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মিল্লি গাজেত পত্রিকা।

পরিশেষে-
তুরস্কের অঘোষিত ইসলামী বিপ্লবের পেছনে মিল্লি গাজেত(তথা মিল্লি গুরুশ) পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। সেই ১৯৭৩ সালের ১২ ই জানুয়ারী যাত্রা শুরু করে আজ অবধি উম্মাহ কেন্দ্রিক চিন্তার লালন করে তুরস্কের মাটিতে এগিয়ে চলছে মিল্লি গাজেত। একই সাথে মুসলিম উম্মাহর উপর আপতিত প্রতিটি জুলুমের সোচ্চার প্রতিবাদ করে আসছে পত্রিকাটি তার জন্মলগ্ন থেকেই। দেশের বাইরে হোক কিংবা ভেতরে, জালিমের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান সুস্পষ্ট। তুরস্কের বর্তমান সরকার কর্তৃক হাজারো প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা সত্ত্বেও মিল্লি গাজেত তার নীতিতে অটল। আর হবেই বা না কেন?? তাঁদের বিশ্বাস ও আদর্শ যখন "হক্ব সমাগত, বাতিল অপসারিত" তখন এ ধরণের প্রতিবন্ধকতা তাঁদের নিকট তুচ্ছ বৈ আর কিছু নয়।
মজলুমের পক্ষে ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এই কন্ঠ যেন কখনো অবরুদ্ধ না হয়, সেই কামনায়...
The Voice of the Ummah

পঠিত : ২০৩৯ বার

মন্তব্য: ০