Alapon

একনজরে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি

ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় সম্মেলনের এক বছর পর ১৩ মে বিকেলে। গত বছরের মে মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের আড়াই মাস পর রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি তখন হয়নি। আর অনেক জল ঘোলা করে এক বছর পর ৩০১ সদস্যের কমিটি ঘোষণার পরপরই শুরু হয় পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভ-হাহাকার। বাগবিতণ্ডা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়িয়ে তা হামলায় রূপ নেয়।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেলেঙ্কারির নানা কাহিনি বেরিয়ে আসে। সত্য-মিথ্যা কতটা জানি না, কিন্তু যারা এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন, তারা ছাত্রলীগেরই পদবঞ্চিত। অন্তত একজন আছেন পদ পাওয়ার পরও পদত্যাগ করে বিদ্রোহীদের কাতারে শামিল হয়েছেন। ওইদিন থেকে অভিযোগগুলো আমি খেয়াল করেছি। তার মধ্যে প্রধান অভিযোগগুলো হলো–

১. স্বজনপ্রীতি
২. টাকার বিনিময়ে পদ দেওয়া
৩. শিবির ও ছাত্রদলের নেতাদের কমিটিতে পদ দেওয়া
৪. ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্যাতনকারীদের কমিটিতে নেওয়া
৫. ইয়াবা, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ীদের কমিটিতে রাখা 
৬. চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত ও হত্যা মামলার আসামিদের কমিটিতে নেওয়া
৭. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতদের ঠাঁই দেওয়া
৮. বিবাহিতদের কমিটিতে রাখা
৯. সরকারি চাকরিজীবীদের কমিটিতে রাখা
১০. ত্রিশ বছরের বেশি বয়সীদের কমিটিতে স্থান দেওয়া।
১১. বিছানায় যাওয়া নারীদের পদ দেয়া। 

আরও কিছু অভিযোগ আছে, যা ঠিক কীভাবে লিখবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না। পদবঞ্চিত নেত্রী জেরিন দিয়া তার ফেসবুক পোস্ট এবং সংবাদমাধ্যমে যেসব অভিযোগ করেছেন তা তদন্তে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মেনে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে যা আছে:

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর ক উপ-ধারায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব ২৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত যেকোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন।

৫-এর গ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত কোনও ছাত্র ছাত্রলীগের কর্মকর্তা হতে পারবেন না।

২৩-এর ক উপ-ধারায় বলা হয়েছে, কোনও সদস্য বিয়ে করলে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার হারাবেন।

শোভন-রাব্বানী কাহিনি:
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নতুন কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মো. রাকিনুল হক চৌধুরী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের আপন ছোট ভাই। তিনি ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন না। আর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নিজ জেলা মাদারীপুর থেকেই ২২ জন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো সভাপতি শোভনের বিরুদ্ধে। তিনি নিজেই নাকি বিবাহিত।

আরও যারা মনি-কাঞ্চন:
এরইমধ্যে পদবঞ্চিতদের অভিযোগ এবং সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে ৩০১ সদস্যের কমিটির অনেক গুণধরের নাম পরিচয় প্রকাশ হয়েছে। আমি সেখান থেকে ওপরের ১০ অভিযোগের সমর্থনে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।

ক. সহ-সভাপতি আরেফিন সিদ্দিকী সুজন ইয়াবা সেবন, মাদক ব্যবসা ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হলে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে সূর্যসেন হল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। 

খ. সহ-সভাপতি বরকত হোসেন হাওলাদার ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি ও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ছাত্রলীগ থেকেই বহিষ্কার হয়েছিলেন।

গ. সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদকে ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিলো।

ঘ. সহ-সভাপতি তৌফিকুল হাসান কিশোরগঞ্জের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সোহরাব উদ্দিনের ছেলে। 

ঙ. সহ-সভাপতি সুজন ভুঁইয়া অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। 

চ. যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে পরীক্ষায় নকলের দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন।

ছ. সহ-সম্পাদক রনি চৌধুরী মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কোলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি আসিফ হাসান হাওলাদার হত্যা মামলার আসামি।

জ. সহ-সম্পাদক সামিয়া সরকার ২০১২ সালে বিয়ে করেছেন।

এই তালিকা আরও দীর্ঘ। আমি শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিলাম অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ।

হামলা এবং কমিটি নাটক:
১৩ মে কমিটি ঘোষণার দিন সন্ধ্যায় পদবঞ্চিতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে হামলার শিকার হন। আর এই হামলার জন্য শোভন-রাব্বানীর অনুসারীদেরই দায়ী করা হচ্ছে। হামলা থেকে মেয়েরাও রেহাই পাননি। আর এটাকে ধামাচাপা দিতে তারা তাদেরই অনুসারীদের দিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি করা হয় কারা হামলা করেছে তা তদন্তে। কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদবঞ্চিতদের এসব অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে তাদের পকেট কমিটি নিয়েই অবিচল ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন উতরে যাবেন তাদের গ্রুপ নিয়ে। এমনকি তারা বিদ্রোহীদের হুমকিও দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ।

ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বুধবার দুপুরে ডেকে পাঠান শোভন-রাব্বানীকে।  আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাকির-সোহাগকেও ডাকা হয়। অভিযুক্ত এবং বিতর্কিতদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। শেখ হাসিনার নির্দেশের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই অন্তত ১৭ জন অভিযুক্ত বা বিতর্কিতকে খুঁজে পেয়েছেন শোভন-রাব্বানী। আরও খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু এর আগে তারা কিন্তু সবাইকে ‘সাধু’ বলেছিলেন। এর কারণ কী? আওয়ামী লীগ সভাপতি ৩০১ সদস্যের এই বিশাল কমিটি নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

কেন এই কেলেঙ্কারি:
আমার মনে হয় এই কেলেঙ্কারির পেছনে প্রধান কারণ অর্থ এবং পকেটের লোক রেখে সামনের দিনগুলোতে ক্ষমতা আরও সুসংহত করা, যাতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সব ধরনের কাজ নির্বিঘ্ন হয়। তাই আগের কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের সামান্য কয়েকজনকেই জায়গা দেওয়া হয় নতুন কমিটিতে। ৩০১ সদস্যের এত বড় কমিটির পেছনেও কাজ করেছে অর্থ। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে বলেছেন কত টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি হয়েছে। আর তা-ই যদি না হবে তাহলে কোন স্বার্থে শিবির, ছাত্রদল, মাদক ব্যবসায়ী, হত্যা মামলার আসামি, নকলের দায়ে বহিষ্কৃতদের কমিটিতে রাখা হবে? 

তবে এই কমিটির নেপথ্যে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন নেতাও আছেন। তারাও বিষয়গুলো জানেন বলেই আমার মনে হয়। তারাও যে তাদের নিজস্ব কিছু লোক ঢোকাননি তাও কিন্তু বলা যায় না। আসলে এখানে কারা ছাত্রলীগের জন্য ত্যাগ করেছেন তারচেয়ে স্বার্থের ভাগবাটোয়ারা প্রাধান্য পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। আর এই স্বার্থ ব্যক্তির, ছাত্রলীগের স্বার্থ নয়।

তবে যতই কেলেঙ্কারি বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ এতে হতবাক হয়নি। যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে দেশের মানুষ ছাত্রলীগের সাথে এই অপরাধগুলো যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা জানে। ছাত্রলীগের ইতিহাসই এমন। এসব কেলেঙ্কারি নতুন কিছু নয়। তারা আজীবন সন্ত্রাসীই করে এসেছে সেই জন্মলগ্ন থেকে। 

পঠিত : ১১৮১ বার

মন্তব্য: ০