আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা হতে পারে। এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিক রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, ডায়াবেটিক রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর হবে। কোরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে (সুরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫)

অন্য যে কোনো ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়বেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকিঃ

* রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

* রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)

* ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস

* পানি শূণ্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম

করণীয় : প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্র্যসহ বিবেচনা করতে হবে। ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন বেশ ক’বার (কম পক্ষে তিনবার) রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইফতারে চর্বিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা এ সব হজম হতে সময় লাগবে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীর ইফতারের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহরির সময় খেতে হবে। ইফতারিতে সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক পূর্বে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্চনীয়।

স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড এ সময় চালানো যেতে পারে। খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। কঠোর শ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না। তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী (বিশেষত টাইপ১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিক মতো রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাত্মক হয়।

প্রতিটি ডায়বেটিক রোজাদারকে এ কথাটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তার পর যতটা সম্ভব দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোনো খাদ্য/সরবত ইত্যাদি যে কোনো একটি খেয়ে নিতে হবে।

যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবে। যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক ধড়ফরানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিবে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হয়েছে ধরে নিতে হবে। দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/ লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেয়া জরুরি।

আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইল ইউরিয়া, মেগ্লিটিনইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার আশংকা বেশি। রক্তের গ্লুকোজ ১৬৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।

প্রাক-রমজান মূল্যায়ন :
যে সব ডায়াবেটিক রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজা শুরুর কমপক্ষে ১ মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার কিডনি ও হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

সবাইকে তার নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসগণ এ ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবেন।

বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন : ডায়াবেটিক রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন। তবে পূর্ব থেকেই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুতি নিতে হবে।

রোজার সময় নিজে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না, এতে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।

সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের কিছু আগে খাওয়া উচিত। ইফতারের সময় বেশি চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।

রোজার সময় দিনের বেলা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।

রোজার সময় রাতের বেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি (সম্ভব হলে ডাবের পানি), কম মিষ্টি রসালো ফল এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।