Alapon

নেগেটিভ ধারণায় শিশু বড় হলে, পিতা-মাতাই প্রথম অপমানের সুখ পায়!

দীর্ঘ বছরের নেতিবাচক চিন্তায় শিশুর বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে যায়। মা তাকে যতই আদর করে বুঝাক আমি তোমার মা নই? সে কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারবেনা তিনি মা হলে তার লাভ কি....
শিশুর যখন বুঝার বয়স হয়, তখন আমাদের সমাজে প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয় সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা তথা নেতিবাচক তথা খারাপ ধারণা দেওয়া হয়। কিছু মা এমনও আছে যিনি, সর্বদা সন্তানের পিতার নানাবিধ দোষ-ত্রুটি ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলে। মায়ের লক্ষ্য কিন্তু ভাল থাকে, তিনি বুঝাতে চান তোমার পিতা এই দোষে আক্রান্ত সুতরাং তুমি যাতে তোমার পিতার মত এমনটা না কর। কিছু সংখ্যক অভিভাবক ধারণা দেন যে,
- তোমার চাচা-জেঠারা কিন্তু মহা ক্ষতিকর মানুষ! ভুলেও তাদের ঘরে যাবেনা, কিছু খাবে না।
- দুনিয়ার সকল ফুফুদের অন্তর কিন্তু কুকুরের মতন! তারা লোভী, হিংসুক!
- বাড়ীতে ভিক্ষুক আসলে চুপি সারে কিছু দিও না! তাদের বেশীর ভাগই চোর স্বভাবের।
- চাকর-বাকরের সাথে খেলিও না তারা ছোট লোক, কখনও ফাঁসাতে পারে। ইত্যাদি

হ্যাঁ, প্রতিবেশীদের দোষ থাকতেই পারে। তাদের অনেকেই খারাপ স্বভাবের হতে পারে। "নিজের এক পাটির একটি দাঁত বদলানো যায় কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায়না"! এই নিরেট সত্য মাথায় নিয়ে নিজের জীবনে ছক তৈরি করে প্রতিবেশীর সাথে বিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্বার পরিচয়ে জীবনাচরন চালাতে হয়। একটি শিশুকে যদি অবিরত খারাপ ধরনায় বড় করা হয়, তাহলে সে আজীবন একটি নেতিবাচক চিন্তা-চেতনায় বেড়ে উঠবে। এতে সে সারাজীবন সকল জিনিষের খারাপ দিক আগে দেখবে। খারাপ দিকগুলোর বিশ্লেষণে যতোধিক পাক্কা হবে, ভাল দিক বিশ্লেষণে ততোধিক ব্যর্থ হবে। পরিণত বয়সে পৃথিবীতে ভাল বলতে কিছু আছে কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ করবে। এমন কি একদিন তার পিতা-মাতা, ভাই-বোনকেও শয়তানের এক একটা সাঙ্গাত চেলা বলে মনে করতে শিখবে। কেননা শিশুকাল থেকেই তার বিশ্লেষণের রসদ ছিল কু-ধারনা। এমন সন্তান সারা জীবন শুধু লাভের হিসাব করতেই অভ্যস্ত হবে। পরিণতিতে সে প্রথমেই তার নেতিবাচক চিন্তার পরীক্ষা করবে তার সান্নিধ্যে যারা থাকবে তাদের দিয়েই। আর তাতে মা-বাবা, ভাই-বোন প্রথম পরীক্ষার মুখে পড়বে। দীর্ঘ বছরের নেতিবাচক চিন্তায় শিশুর বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে যায়। মা তাকে যতই আদর করে বুঝাক আমি তোমার মা নই? সে কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারবেনা তিনি মা হলে তার লাভ কি? ইনি যতদিন বেশী বাঁচবে ততদিন তার অর্থের হাড়িতে টান বাড়তে থাকবে!

আমাদের অঞ্চলের মানুষ শত শত বছর ধরে ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফিরিঙ্গি, ব্রিটিশ, মারাঠার মত বিদেশী শক্তি; বর্গী ও মগদের মত স্বদেশী শোষক দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। আর্য, মোগল, তুর্কি, পাঠান কর্তৃক শাসিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে আজও আমরা স্বজাতিয় ভাই-বন্ধুর হাতে নিপীড়িত হচ্ছি। এই নিপীড়ন, পিষণে আমদের চিন্তা-চেতনা অভ্যস্ত। এটাতে আমরা মানিয়ে উঠেছি। আমাদের রক্ত, হরমোন গুলো নেতিবাচক ধ্যান-ধারনায় এমনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে, ফলে নতুন কাউকে দেখলে সন্দেহ করা, কারো ভাল পরামর্শ শুনলে মতলব-বাজি মনে করা, আন্তরিক সহযোগিতাকে ধাপ্পাবাজি ভাবা, উপকারীর হাতকে উৎপীড়কের ছোবল ভাবা। ভিন্ন প্রকৃতির সমাজ থেকে এক অভিন্ন চরিত্র হাসিল করেছি। উপকার পেয়ে কৃতজ্ঞ না হওয়া, পরোপকারীর প্রতি বিনয়ী না হওয়া, বাহানা দিয়ে সাহায্য হাসিলকে বুদ্ধিমত্তা ভাবা, অন্যায়-চাতুর্যকে নেতৃত্বের গুণাবলী ভাবা; আজ আমাদের অন্যতম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কিছুই নেতিবাচক চিন্তা ও চরিত্রের ফল।

জাতি হিসেবে আমরা প্রায় সকলেই সবকিছুকে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে শুরু করি। কেউ ভাল কিছু উপস্থাপন করলেও তার পিছনে কি দুর্বিসন্ধি রয়েছে সেটা নিয়ে আগে ভাবি। কোন মানুষকে এক দেখায় ভাল ভাবার চিন্তাই করতে পারিনা। কোন কাজকে ভাল ভাবতে পারিনা। নেতিবাচক সমাজে বসবাস করতে করতে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়েছি কোন কথাটি লজ্জার কোনটি না বলা উত্তম সেটাই বুঝি না। সমাজে শ্বশুরেরা গৌরব করে বলে, 'মেয়ের জামাইয়ের বেতন কম কিন্তু উপরি আয় ভাল'! এই উপরি আয় যে ঘুষের টাকা! সেটা নিয়ে শ্বশুরের লজ্জা-শরমের বালাই থাকেনা! পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা ব্যাপক হবার মূল কারণই কিন্তু এই নেতিবাচক প্রবণতার ফল। একটি ঘরে যদি তিনটি সন্তান থাকে আর তাদের মধ্যে যদি একজনও নেতিবাচক হয়, তাহলে সর্বদা সে সংসারে আগুন জ্বলবে। নেতিবাচক চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য শিশুদেরকে পরিচর্যা করতে হয়। মানব সন্তানকে পরিচর্যা ব্যতিরেকে যদি পৃথিবীতে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হত, তাহলে সহজাত প্রবৃত্তির কারণে সকল মানুষ নেতিবাচক হিসেবে বেড়ে উঠত। ছল-চাতুরীর এই দুনিয়ার সকল উপায়-উপকরণ মানুষকে নেতিবাচকই হতে শেখায়।

মানুষকে ইতিবাচক বানাতে হলে তার যথাযথ শিক্ষার প্রয়োজন হয়। আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এত কষ্ট করে যে লেখাপড়া করি, তা কিন্তু ইতিবাচক মনোবৃত্তি অর্জনের জন্যই করে থাকি। বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্য লেখা-পড়াটা দুনিয়া অর্জন করার অন্যতম মাধ্যম হয়ে পড়েছে। সারা বছর সাহিত্য, অংক, ধর্ম বিষয়ের সাথে আবশ্যিক হিসেবে আমরা একশত নম্বরের সমাজ বিজ্ঞান পড়ে থাকি! কখনও কি ভাবা হয়েছে, এখানে সমাজ বিজ্ঞান কেন? পৃথিবীর সকল দেশে ও জাতিতে সমাজ বিজ্ঞান আবশ্যিক বিষয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভাষা, সাহিত্য, আন্তর্জাতিক, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে গেলে বাধ্যতামূলক সমাজ বিজ্ঞান পড়তে হয়! যদিও আমাদের দেশের সমাজ বিজ্ঞানের চ্যাপ্টারগুলোর বিষয় নিয়ে বিস্তর কথা আছে। সেখানে সমাজের কথার চেয়ে নেতা ও রাজনীতির কথাই বেশী! তারপরও ছাত্র জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই বিষয়টি রাখা হয়, যাতে করে তাদের সুকুমার বৃত্তিতে জাতি নিয়ে গৌরব করার মত ইতিবাচক ধারনা তাদের হৃদয়ে চিরতরে স্থান করে নেয়।

তাই একজন শিশুকে মানুষ বানাতে হলে, তার জন্য প্রথম প্রয়োজন নেতিবাচক চরিত্র বাদ দিয়ে, ইতিবাচক হিসেবে গড়ে তোলা। পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও আপন আত্মীয়ের নিকট থেকে একটি শিশু সাত বছর পর্যন্ত মূল শিক্ষা লাভ করে। এটি জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে শিশু অন্ধভাবে কথা শুনে এবং মেনে চলে। তাই শিশু চরিত্রের গঠন-আকৃতিকে কে এ বয়সেই যথাযথ রূপ দিতে হয়। অন্যথায় নেতিবাচক পরিবেশে বড় হওয়া শিশু, বিভ্রান্তি ও হিংসা মূলক চিন্তায় বেড়ে উঠে। পরিণতিতে তাকে ত্রিশ বছর ধরে অক্সফোর্ড কিংবা আল আজহারে পড়ালেও, পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে বেগ পেতে হবে! সুতরাং শিশু জীবনের শুরুতেই প্রিয় সন্তানকে নেতিবাচক চিন্তা তথা, হিংসা, ঘৃণা, আলস্যতা, কঠোরতা, কপটতা, কৃপণতা শিক্ষা দিতে নাই। এটা হিতে বিপরীত হবেই এবং অকল্পনীয় সত্য যে, এই সন্তানের তার প্রথম শিকার হবে তার পিতা-মাতা।


লিখেছেন: নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৬০০ বার

মন্তব্য: ০