Alapon

সরকারের ধান কেনা নয়, সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

ধান নিয়ে বাংলাদেশে চলছে লঙ্কাকাণ্ড। ধানক্ষেতে আগুন দেয়া হচ্ছে, রাস্তায় ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদও করা হচ্ছে কম দামের জন্য। এটা মানুষের আবেগকে স্বাভাবিক কারণেই নাড়া দিয়েছে। কৃষকের কষ্ট দেশের মানুষ অনুভব করছেন। তাই ছাত্র, পুলিশ সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা এমনকি সাধারণ মানুষ গিয়ে কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। আওয়াজ উঠেছে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনা হোক। কৃষকের সব ধান সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনুক। এমনকি সংসদীয় কমিটি বুঝে হোক অথবা সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য হোক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান কিনতে বলেছে সরকারকে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো সরকার যদি তার নির্ধারিত দামে কৃষকের সব ধানও কেনে তাহলে কি এই সমস্যার সমাধান হবে?

কৃষকের সর্বোচ্চ কোথায় খরচ হয় : 
বড় একটি সমস্যা আছে যা আমরা হয়তো লক্ষ করছি না। অথবা বুঝতে পারছি না। আমরা বিষয়টিকে ধানের দাম কম হিসেবে না দেখে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে সেদিক থেকে বিবেচনা করে কি দেখেছি? আপনাদের জানিয়ে রাখি, কৃষকের ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। আর এই খরচের ৫০ ভাগই যায় একটি খাতে। সেটা কী? সেটা হলো ফসল কাটার মজুর বা শ্রমিক। এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনের মোট খরচ ১৪ হাজার টাকা। আর তার মধ্যে ৭ হাজার টাকা দিতে হয় শুধু ফসল কাটার জন্য মজুরকে। এখন একজন ফসল কাটা শ্রমিকের প্রতিদিন মজুরি এক হাজার টাকা। আর এক বিঘা জমির ফসল কাটতে লাগে ৭ জন মজুর। এখন কি মজুরের মজুরি কমিয়ে দিতে কোনো আইন করতে চান? তা কি ঠিক হবে? তখন তো আমরা আবার হাহাকার তুলব।

একবিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ধান উৎপাদনের খরচের একটি মোটামুটি হিসাব হলো এই, চাষ ১,০০০ টাকা, বীজ ও রোপণের খরচ ২,৫০০, প্রথম দফায় সার ১,৫০০, দ্বিতীয় দফায় সার, কীটনাশক, নিড়ানি ২,০০০, ফসল কাটতে ৭ জন দিনমজুরের জন্য ৭,০০০ টাকা। এর সঙ্গে আছে দিনমজুরদের খাওয়া খরচ। তারা কী খাবেন সেটা কিন্তু আগেই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনোভাবেই ৫-৬শ’ টাকার নিচে হয় না। আবার ধান ক্ষেতে পানি থাকলে মজুরি বেড়ে যায়। এখানে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৪,৫০০ টাকা। লক্ষ করুন এর মধ্যে ধান কাটার জন্য মজুরের খরচই প্রায় অর্ধেক ৭,০০০ টাকা, যা কৃষককে মাত্র এক দিনেই শোধ করতে হয়। একজন মজুর দিনে সর্বোচ্চ ৫ শতক জমির ধান কাটতে পারেন। তাই ৭ জন শ্রমিকের নিচে হয় না। এই খরচের মধ্যে কৃষক নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের শ্রম ও নিজের জমি হওয়ায় জমির ভাড়ার হিসাব এখানে দেননি। সেই হিসাব দিলে খরচ আরো বাড়বে।

উৎপাদন খরচ বনাম ধানের দাম : 
এক বিঘা জমিতে কৃষক বেরো ধান পান ১৫-১৬ মণ। যদি ১৬ মণও ধরে নিই তাহলে প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৮৭৫ টাকা। তাতে প্রতিকেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৩ টাকা। তবে সরকার মনে করে এবার প্রতিকেজি ধানের উৎপাদন খরচ গড়ে ২৫ টাকা ৩০ পয়সা। সরকার এবার সরকারি ক্রয়ের জন্য ধানের প্রতিমণের দাম ধরেছে ১,০৪০ টাকা। কিন্তু বাজারে এখন কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতিমণ ৫০০ টাকায়। তাতে প্রতিকেজির দাম পড়ে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা। সরকারের উৎপাদন খরচ যদি ধরে নিই তাহলে প্রতিকেজি ধান উৎপাদন করে কৃষককে ১১ টাকা ৫০ পয়সারও বেশি লোকসান গুনতে হয়। কারণ কৃষক তো আর সরকারি গুদামে ধান সরাসরি বিক্রির সুযোগ পান না। দু-এক জন পেলেও তাতে দেশের কৃষকদের কিছু আসে যায় না। সারাদেশে এবার সরকার ধান কিনবে দেড় লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের বেশি নয়। এই পুরোটাও যদি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কেনা হয় তারপরও তা দিয়ে ধানের বাজার প্রভাবিত বা সরকারি দামের পর্যায়ে আনা যাবে না। আর গত বছর মোট ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬২ লাখ টনে পৌঁছে গেছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৫৫ লাখ টন, যার মধ্যে বোরো ১ কোটি ৯৬ লাখ টন।

সরকারের কাছে কেন ধান বেচতে পারে না :
সরকারি গুদামে বা সরকারের কাছে সরাসরি ধান বেচতে হলে-
১. কৃষককে তালিকাভুক্ত হতে হবে
২. ধানের আর্দ্রতা ১৪ মাত্রার বেশি হতে পারবে না
৩. জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে
৪. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে
কৃষক তালিকাভুক্ত করার কাজ করে আবার থানা কৃষি অফিস। কিন্তু গত দুই বছর ধরে এই তালিকাভুক্তি বন্ধ রয়েছে। নিয়মে আছে তালিকাভুক্ত হতে হলে প্রকৃত কৃষক হতে হবে। তিনি জমির মালিক বা বর্গাচাষি হবেন। ধান উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতে হবে। তবে এই তালিকাভুক্তির কাজেও আবার আছে দুর্নীতি।

আসলে প্রত্যেক উপজেলায় সরকারি গুদামে ধান বিক্রির একটি চক্র আছে। কারণ সাধারণ কৃষক আর্দ্রতার বিষয়টি বোঝেন না। আর ধান বিক্রি করতে তালিকাভুক্তসহ যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় সেসব শর্ত পূরণ করা অনেক কৃষকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সব শর্ত পূরণ করলেও কৃষককে ধানের আর্দ্রতার মারপ্যাঁচে ফেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর ওই চক্রটি কৃষি অফিসের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয় এবং উপজেলা খাদ্য অফিসের সাথে মিলে আর্দ্রতাসহ সব শর্ত পূরণ করে। ফলে বছরের পর বছর তারাই প্রকৃত কৃষকের নামে সরকারি গুদামে ধান বেচে। তারাই এখন কৃষকের কাছ থেকে ৫০০ টাকা মণ কিনে সরকারি গুদামে ১,০৪০ টাকা দরে বিক্রি করবে। প্রতিমণে লাভ করবে ৫৪০ টাকা। এই লাভের টাকার ভাগ পায় কৃষি, খাদ্য প্রশাসনসহ সব দফতর। এটা কৃষককে বড় ধরনের ঠকানো। এটা যদি সরাসরি কৃষক বেচতে পারতেন সরকারি গুদামে তাহলে কিছু কৃষক লাভবান হতেন সত্য। কিন্তু তারা দেশের ধান উৎপাদনকারী কৃষকের অতি সামান্য অংশ।

সরকার ধান কিনে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না : 
আগেই বলেছি এবার সরকার ধান কিনবে দেড় লাখ টন। একজন কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন সর্বোচ্চ ৩ টন। ধানের বাম্পার ফলনের কারণে বছরে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৬২ লাখ টনে পৌঁছে গেছে। ওই মাত্র দেড় লাখ টন মোট উৎপাদিত ধানের খুবই সামান্য অংশ। যদি একজন কৃষক সর্বোচ্চ ৩ টন ধান বিক্রি করতে পারেন সরকারের কাছে, তাহলে মোট ৫০ হাজার কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন। এবার শুনুন, শুধু টাঙ্গাইলের একটি উপজেলা বাসাইলেই তালিকাভুক্ত কৃষক আছেন ৩৭ হাজার। তাহলে দেশের বাকি উপজেলার কৃষকদের কী হবে। সরকার যদি ক্রয় দ্বিগুণও করে তাহলে হয়তো ৩ উপজেলার কৃষকদের ধান কিনতে পারবে। কিন্তু উপেজলা তো ৪৯২টি। এটাও ঠিক, কৃষক তো তার সব ধান বিক্রি করবেন না। আর সব কৃষক ধান বিক্রিও করবেন না। তা বিবেচনায় নিলেও খুব অল্পসংখ্যক কৃষকের ধানই কিনতে পারবে সরকার।

তাহলে সমাধান কী?
আমি আগেই বলেছি, কৃষি শ্রমিকের সংকটের কারণে এখন ফসল কাটতেই খরচের অর্ধেক চলে যায়। অনেক আগেই কৃষি অর্থনীতিবিদরা কৃষি শ্রমিকের যে সংকট হবে তার আভাস দিয়েছিলেন। সরকার ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু ধান কাটা ও মাড়াইয়ে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার না হলে এই খরচ কমানো সম্ভব নয়। আর কৃষক যদি সরকারের কাছ থেকে নামমাত্র সুদে বা বিনা সুদে ঋণ পান তাহলে তাকে চড়া সুদে ঋণ করে ধান উৎপাদন করতে হবে না। একই সঙ্গে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে কৃষক ২-৩ মাস ধান ধরে রেখে ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন। যে চালকল সরকারের কাছে চাল বিক্রি করবে সেই চালকলকে সরকার নির্ধারিত দামেই ধান কিনতে হবে। এগুলো করা হলে কৃষক ধান নিয়ে আর সংকটে পড়বেন বলে মনে হয় না।
কৃষিতে পরিকল্পিতভাবে আধুনিকায়ন করতে হবে। সঠিক নিয়মে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে এক বিঘায় ১৬ মণের জায়গায় ২৪ মণ ধান উৎপাদন করা সম্ভব। এটা আমার কথা নয়, কৃষিবিজ্ঞানীদের কথা।
তাই কৃষকের কাছ থেকে শুধু দেড় লাখ টন ধান কেনা সমাধান নয়। সংকটের মূলে হাত দিতে হবে। ধানের সাথে কৃষককে এখন হাই ভ্যালু ক্রোপের দিকেও যেতে হবে। আর এসব কাজে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তাই চাল রফতানি, কৃষকের কাছ থেকে আরো বেশি করে ধান কেনা- এসব চটকদার কথা। মানুষের আবেগকে ঠান্ডা করা। সেটা সরকার তার প্রয়োজনে করতে পারে। কিন্তু কৃষককে বাঁচাতে হলে তার উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সঠিক সময় বিক্রির জন্য সক্ষম করতে হবে। আর চাল বা কৃষিপণ্য নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। 

পঠিত : ৭৩১ বার

মন্তব্য: ০