Alapon

আমাদের সমুদ্র অভিযান...

আচমকা সমুদ্রের একটি ঢেউ এসে আমাকে তীরে নিক্ষেপ করল! জীবনে প্রথমবার সমুদ্রস্নান। অনুভূতিটাই অন্যরকম। সত্যিই অন্যরকম ছিল, কারণ প্রথম ধাক্কাতেই সমুদ্র বাবাজি আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে গেছে! চার চোখা থেকে দু-চোখা বানিয়ে দিয়ে গেছে!

কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। সমুদ্র তীরে বালুর ভিতরে চশমা খুঁজতে শুরু করলাম। দূর থেকে মনে হবে আমি মনে হয় মাছ ধরার চেষ্টা করছি। ঠিক এই মুহুর্তে আমার মহাজ্ঞানী ছোটভাই শাফিন হাজির। কোনো ধরণের ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল, ‘প্রিয় মেজ ভাই আমার! বালু হাতিয়ে কয়টি মাছ ধরলেন?’
আমি কাচুমাচু মুখ করে বললাম, ‘মাছ ধরছি না তো, চশমা খুঁজতেছি। এই শালা সমুদ্র আমার চশমা নিয়ে গেছে!’

সে মুখখানা হাসি হাসি করে বলল, ‘তা আপনি চশমা চোখে দিয়ে সমুদ্রে নেমেছেন, কোন উদ্দেশ্যে? আপনি কি সমুদ্র তলদেশ আবিষ্কার করার অভিপ্রায় নিয়ে নেমেছিলেন, নাকি সমুদ্রের নিচেও বই পড়ার কোনো ধান্দা ছিল?’

তার কথায় আমি ভয়ানক অপমান বোধ করলাম। চোখ মুখ শক্ত করে বললাম, ‘চুপ কর বেয়াদপ! আমি তোর বড় ভাই, তুই আমাকে উপহাস করিস! এমন চড় মারব, তোর বাম পাশের দাঁত ডান পাশে চলে যাবে। সেই সাথে তোর বড় দুই ভাইয়েরও নাম ভুলে যাবি! ’

২.
তখন রাত ২ টা। লাবনী সি-বিচে বসে আছি। সমুদ্রের দিকে তাকালেই আমার চশমাটার কথা মনে পড়ে। ইশ, চশমাটা বড়ই সুন্দর ছিল। আমার আর কোনো চশমাই এত পছন্দের ছিল না। কিন্তু এই শালা সমুদ্র...

প্রচন্ড রাগ লাগছে। কেন যে, চশমা চোখে দিয়ে সমুদ্রে নামতে গেলাম। গালাগালি করতে ইচ্ছে করছে! সমুদ্র ব্যাটাকে ইচ্ছেমত গালাগালি করতে পারলে রাগ কিছুটা কমতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

বড় ভাই আর ছোট ভাইয়ের সামনে তো আর গালাগালি করা যায় না। তাই একটু দূরে গিয়ে, ফাঁকা জায়গা থেকে গালাগালি শুরু করলাম। ‘এই শালা সমুদ্র, আমার চশমা নিছিস ক্যান? ফকিরের বাচ্চা ফকির, দিয়ে যা। এক্ষুনি দিয়ে যা, নইলে কিন্তু তোর শরীরে হিসু করে দিবো!’

গালাগালির মাঝ পর্যায়ে এক ভদ্রলোক এসে বিঘ্ন ঘটালেন। তিনি নরম সুরে বললেন, ‘বাবা, তুমি কাকে গালি দিচ্ছো?’
বললাম, ‘এই শালা সমুদ্রকে। শালা আমার চশমা নিয়ে গেছে!’
ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে এক পর্যায়ে বলে ফেললেন, ‘বাবা কিছু মনে কর না! তুমি কি পাগল?’

পিছন থেকে আমার বড় ভাই জ্ঞানের জাহাজ রাফসান বলল, ‘জি আংকেল, আপনি ঠিকই ধরেছেন।’
বড় ভাইয়ের পাশেই ছিল আমার ছোটভাই।
ভদ্রলোক ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ‘এই তোমরা কে?’
আমি রাফসান, ওর বড় ভাই। ওর নাম শাফিন, আমার ছোট ভাই। আর যার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সে আমার মেজ ভাই জিবরান। আমরা তিনজনই গতরাতে পাবনার হেমায়েতপুর পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছি!

৩.
এবার সেন্টমার্টিন অভিযান। লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে আমরা তিন ভাই ট্রলারে চেপে বসলাম। ছোট জন আর আমি সাঁতার জানলেও, বড়জন সাঁতারের ‘স’-ও জানে না। অথচ ট্রলারে যাওয়ার জন্য তারই লাফালাফি বেশি।

ট্রলার চলছে, আর আমরা তিনজন শিক লেগে বসে আছি। সমুদ্রের ইয়া বড় ঢেউ আর ট্রলারের দুলোনি দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে মুরগীর ফ্যাফড়া হয়ে গেছে।

নিরবতা ভেঙ্গে বড় ভাইয়া বলল, ‘জিবরান, একটা কাজ করতে পারবি? মাঝির পাছায় কসিয়ে তিনটা লাত্থি দিতে পারবি?’
প্রশ্ন করলাম, ‘মাঝির অপরাধ?’
সমুদ্রে এত বড় বড় ঢেউ! আর হারামজাদা এত জোরে ট্রলার চালোচ্ছে, আমার তো মনে হচ্ছে, সেন্টমার্টিনে পৌঁছানোর আগেই ট্রলার ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেঙ্গে চুরে খান খান হয়ে যাবে!’

খানিক ভেবে বললাম, ‘এই কাজ করা যাবে না। এই কাজ করলে, ও আমাদের এই মাঝ সমুদ্রেই নামিয়ে দিয়ে যাবে। আমি আর শাফিন না হয় সাঁতার পারি। সাঁতরাতে সাঁতরাতে কোনো এক সময় হয়ত তীরে পৌঁছাতে পারব। কিন্তু তুমি?
তুমি তো সাঁতার পারো না। এখানেই মরে ভূত হয়ে থাকবে।

৪.
আমাদের সেন্টামার্টিন দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বাধ সাধল বড় ভাইয়া। বলল, ‘আমাকে মেরে ফেললেও ট্রলারে করে যাবো না। আসার সময় জীবন হাতে নিয়ে এসেছি। জীবন হাতে নিয়ে ফিরতে পারব না।’

তাহলে উপায়?

মহাজ্ঞানী শাফিন বলল, ‘উপায় একটা আছে। হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে। মেঘনা এভিয়েশনে কল করতে হবে।’

বড় ভাইয়া মেঘনা এভিয়েশনে কল লাগানো। কাস্টমার সেন্টার থেকে বলল, ‘মিনিটে প্রায় ৫ হাজার টাকা করে লাগবে। সেন্টামার্টিন থেকে কক্সবাজার যেতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাগবে।’

এতগুলো টাকা এখন পাই কোথায়?

তখন বড় ভাইয়া বলল, ‘আচ্ছা সেটা কোনো বিষয় না। আমার ঢাকায় ফিরে একটা কিডনি বিক্রি করার কথা। কথাবার্তা সব ফাইনাল। শুধু যাবো, কিডনি দেবো আর ১ লাখ টাকা নিবো। তখন সেই টাকা থেকে আপনাদের ৫০ হাজার দিয়ে দিলাম। এ আর এমনকি!’

তারপর...তারপর আমি আর আমার ছোট ভাই ট্রলারের দিকে হাটা দিলাম। কিছুক্ষণ বাদে, ‘লা ইলাহা ইলল্লাহ...’ জপতে জপতে ভাইয়াও ট্রলারের দিকে হাটা দিলো...

পঠিত : ১০৫৩ বার

মন্তব্য: ০