Alapon

সুরা মাউন : ভালোবাসাপূর্ণ সমাজ সৃষ্টির এক অপূর্ব বার্তা...

______ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ______

প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্প্রীতিবোধটুকুও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সময় যত গড়াচ্ছে মানুষ যেন ততই অমানবিক হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের অতল গহ্বরে সবাই হাবুডুবু খাচ্ছে। নিজেদের উদরপূর্তির সুখেই সবাই কেমন আহলাদি দেখাচ্ছে। অহঙ্কার, দাম্ভিকতা, সম্পদের প্রাচুর্যতা- এগুলোকেই মানুষ ভালো থাকার উপায় হিসাবে নিজেদের জীবনে চর্চা করে যাচ্ছে।

এখানে মানুষ বলতে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষকে না ধরে যদি শুধু ইসলামে বিশ্বাসী মানুষদের কথা বলা হয়, তবুও তা পুরোপুরি সত্য! অথচ হওয়ার কথা কি ছিল?

একটি দেশের সুখ শান্তি নির্ভর করে সেদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের উপর। ব্যক্তি মানুষটি তার পারিবারিক জীবনে, সমাজ জীবনে কেমন ভূমিকা পালন করছে- এভাবে প্রতিটি নাগরিকের যাপিত কর্ম-ই হলো আমাদের সমাজব্যবস্থা!

পরিবার, সমাজ যদি ভালো না থাকে, তাহলে দেশ ভালো থাকবে কিভাবে?

প্রশ্নটা শুনতে খুব জটিল কিংবা গভীর শোনালেও এর একটি সহজ উত্তর আছে। হৃদয়গ্রাহী উত্তর। সাবলীল অথচ কত সুন্দর।

কুরআনুল কারীমের ১০৭ নং সুরাটি, যা আমরা নামাজে প্রায়ই তিলাওয়াত করে থাকি। সুরা মাউন। আয়াত সংখ্যা সাতটি। বালাদুল আমিন বা মক্কা নগরীতে নাজিল হয়েছিল। ছন্দবদ্ধ কি দারুণ একটি কবিতা যেন। মধুর। আবৃত্তি করতে পারলে আপনি কেঁদে দিবেন।

মানুষ কখন ভালো কাজ করে? কিংবা কখন খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকে? নিশ্চয়ই পুরস্কারের বিশালতা এবং শাস্তির নির্মমতা কেমন তা উপলব্ধি করে, বুঝতে পারে।

উপলব্ধিবোধের প্রশ্নে আমাদের হৃদয়কে, আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে তোলে পরকালের প্রতি বিশ্বাস। হাশরে বিচার দিনের প্রতি বিশ্বাস। পরকালে যাদের বিশ্বাস নেই, কিংবা বিশ্বাসটুকু হৃদয় ধারণ করতে পারে না, তারাই সমাজে অশান্তির মূল হোতা।

সমাজে মানুষে মানুষে, ঘরে ঘরে পারস্পরিক সহানুভূতি, ভালোবাসা সৃষ্টি করতে খুব বড় কোনো কাজ করা লাগে না। কারা এ কাজগুলো করে না এবং না করার কারণে আল্লাহ সুবহান তাআলা বলছেন-

আয়াত ১ : আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে?

_____ এখানে দ্বীন বলতে কিয়ামত দিবস কিংবা হাশরের মাঠে বিচার দিবসের কথা বুঝানো হয়েছে।

আচ্ছা বুঝলাম, শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করল। কিন্তু এটা দ্বারা আল্লাহ সুবহান তাআলা কি বুঝাতে চেয়েছেন? আমরা উপরে বলেছি, পরকালকে যারা অস্বীকার করে তারা কেমন হয়, সেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেই বাকি আয়াতগুলোতে আল্লাহ সুবহান তাআলা তাদের চরিত্রকে খোলাসা করে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন-

আয়াত ২ : এ তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে রুক্ষভাষায় তাড়িয়ে দেয়।

একটু মিলিয়ে দেখুন তো, সমাজে এই নির্মম নিষ্ঠুর চিত্রটি দেখা যায় কি না? ইয়াতীমের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে আত্মীয় স্বজন কিংবা এলাকাবাসী। অথচ কতটা ভয়াবহ একটি কাজ মানুষ সানন্দে করে যাচ্ছে! ইয়াতীম দেখলে আমরা ' ছেলেটি/মেয়েটি ইয়াতীম ইয়াতীম' বলে মনের মধ্যে একপ্রকার হীনমন্যতা তৈরী করি।

মুসলিম হয়েও যের হৃদয় পরকালকে ধারণ করে না, সে আরও কি করে জানেন?

আয়াত ৩ : মিসকীনদের খাদ্য প্রদানে সে উৎসাহ দেয় না।

মানে নিজে তো দেয়-ই না, নিজের পরিবার পরিজনকেও উৎসাহিত করে না। এবার আমরা নিজেদের সাথে মিলিয়ে দেখি। 
দেখুন তো মনে পড়ে কি না, কোনে এক অভাবী, মিসকিন আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিল, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আপনি তাকে 'ধুর ধুর' করে তাচ্ছিল্যের সাথে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন? কিংবা মনে করুন তো, একদিন এক উশকুখুশকু মহিলা বা পুরুষ আপনার দরজায় কড়া নেড়েছিল। আপনি দরজা খুলেছিলেন। লোকটি ভাত খেতে চাইল, আপনি তার চেহারা সুরাতে নোংরা আর দুর্গন্ধ পেয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন! 
অথচ আপনি ঠিক-ই নামাজ পড়েন! কিন্তু নিষ্ঠুর আচরণটিই না আপনি করলেন!

এবার দেখুন আপনার নামাজ নিয়ে আল্লাহ কি বলছেন-

আয়াত ৪ : কাজেই দুর্ভোগ সে নামাজ আদায়কারীর।

একটু Feel করুন তো, দুর্ভোগ শব্দটাকে! এ শব্দটার মানে কি, গভীরতা কতটুকু এবং কে বলেছেন? বুঝা যায়?

কিন্তু দুর্ভোগ হতে যাবে কেন? কারণ-

আয়াত ৫ : যে তার নামাজ সম্পর্কে উদাসীন।

অর্থাৎ নামাজ নিয়ে ঢিলেমি করা। ধরুন, আপনি ফেসবুক মেসেঞ্জারে ব্যস্ত আছেন, এমন সময় এশার আজান দিল। সাড়ে আটটায় জামাত। আপনি ফেসবুক থেকে বেরুতে বেরুতে গিয়ে দেখলেন জামাত শেষ! কিংবা ধরুন, যোহরের আজান দিল। মা এবং বোন রান্না কিংবা বাসার কাজে ব্যস্ত আছেন। ওনারা একবারে কাজ শেষ করেই নামাজ পড়ার ইচ্ছা রেখেছেন। কিন্তু কাজ শেষ করতে করতেই আসরের আজান হয়ে গেল!

এগুলো কি আল্লাহর বলা সেই উদাসীনতা নয়? সাধ্য ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সময়মতো নামাজ আদায় করলাম না! অথচ সময়মতো নামাজ আদায় করাকে আল্লাহ সুবহান তাআলা সবচাইতে বেশি ভালোবাসেন।

দুর্ভোগ শুধু উদাসীনতার জন্য নয়। আরও একটি মারাত্মক রোগ আছে। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। কেউ কেউ বা কখনো কখনো আমরা মানুষ ভালো জানবে এই চিন্তায় নামাজ পড়তে যাই। এমন অনেক আমরা আছি, যারা লোক দেখানোর জন্য নামাজ দীর্ঘ করে আদায় করি। এইসব চরিত্র নিয়ে আল্লাহ সুবহান তাআলা বলেন-

আয়াত ৬ : যে লোক দেখানোর জন্য তা আদায় করে।

দেখলেন, কতটা ভয়ংকর আমরা! এটা স্পষ্টত মুনাফিকি। যাদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে! একটু ভাবুন তো- জাহান্নাম কি? এর সর্বনিম্ন জায়গাটি কেমন হতে পারে?

আচ্ছা নামাজ পড়লাম ঠিকঠাক মতো, হলো তো? সমাজে শান্তি আসবে তো এবার? না, আসবে না। আপনাকে আরেকটি কাজ করতে হবে। না করলে আপনি উপরের সবকটি নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে মিশে যাবেন! আপনার সবকিছু অপূর্ণ থেকে যাবে, যদি আপনি-

আয়াত ৭ : এবং মাউন দেয়া থেকে বিরত থাকে।

_____ এখানে মাউন মানে কি? খুব দারুণ একটি অর্থ। ক্ষুদ অথচ অপরিসীম সুন্দর একটি কাজ। মাউন বলতে, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিশগুলো কারো প্রয়োজনে সাধ্যে থাকলে প্রদান করা। দান করা নয় কিন্তু। হতে পারে গৃহস্থলির কোনো তৈজসপত্র, হতে পারে ইলেক্ট্রিক ম্যাটেরিয়াল বক্স ইত্যাদি।

চিন্তা করা যায়, আল্লাহ সুবহান তাআলা কি বিষয়টা নিয়ে কথা বললেন? কত সিম্পল একটা ম্যাটার! কিন্তু এটাকে এতো গুরুত্ব দিলেন কেন?

ঐ যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ঘরে ঘরে ভালোবাসার আদান-প্রদান, সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এরচে দারুণ কাজ আর কি হতে পারে! কারণ এ কাজটা সবার পক্ষেই করা সম্ভব।

দেখলেন, আমাদের রব আমাদের কত ভালোবাসেন।

প্রশ্ন হলো, আমরা করি তো? পাশের ঘরের কেউ একটি বালতি নিতে এসেছিল, ফিরিয়ে দিইনি তো?
যদি থাকা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিই, বুঝে নিন আমরা কোন দলে!

সাতটা আয়াতে কত সুন্দর করে আল্লাহ সুবহান তাআলা আমাদেরকে নবিজি (সা.) এর মাধ্যমে আদর করে আদেশ করেছেন।

কাজগুলো কি খুব কঠিন হয়ে গেলো?

কাজগুলো একসাথে বসিয়ে দেখা যাক-

এক. 
বিচারের দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। এটাতো হৃদয়ে ধারণ করা জিনিশ। এটায় বিশ্বাস স্থাপন করতে না খরচ হবে অর্থের, না ক্ষতি হবে স্বাস্থ্যের? কিছু ই না। অথচ এটা ধারণ করতে পারলে আপনি আমি পুরোপুরি একটা সরল পথে ঢুকে গেলাম।

দুই.
ইয়াতীমের সম্পদ লুটেপুটে না খাওয়া। ইয়াতীমের সাথে দুর্ব্যবহার না করা। ইয়াতীমের সম্পদ কি আপনার সম্পদ? তাহলে এটা আমি নিতে যাবো কেন? ইয়াতীমের সাথে সুন্দর ব্যবহার করলে আপনার আমার ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে?

তিন.
মিসকীনকে সাহায্য করা। সাধ্যানুসারে আমরা এ কাজটা তো আনন্দের সাথেই করতে পারব। এ কাজে অলসতা মোটেও আসার কথা না। নিজেও করবো। পরিবার পরিজনকেও উৎসাহিত করব, দান সাদকা প্রদানে উদার হতে। এতে নিজেদের মধ্যকার ভালোবাসাও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। কারণ আপনার পরিবার যে তখন রহমতের চাদরে বেষ্টিত।

চার.
আচ্ছা বলুন তো, নামাজ নিয়ে উদাসীন হওয়ার কোনো যুক্তি আছে? যেহেতু পড়বোই, তাহলে সময়মতো পড়ে নিলেই তো হয়। আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার কত সহজ উপায়। আর লোক দেখিয়ে নামাজ পড়তে যাব কেন? আমরা তো বলি- নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই আল্লাহর জন্য। ব্যস হয়ে গেল।

পাঁচ.
ছোটোখাটো জিনিশগুলো দিয়ে অন্যকে সহযোগিতা করার মজাটাই তো অন্যরকম। আপনার কাছে থাকলে তাকে ব্যবহার করতে দিন? হয়ত অন্যসময় তারও কোনো জিনিশ আপনার দরকার হতে পারে। এভাবেই তো কত সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়।

সবগুলো কাজই কিন্তু একটার সাথে আরেকটা রিলেটেড। আর সবগুলোও করাও সহজ। কারণ এতে আমার নেই কোনো আর্থিক ক্ষতি, কিংবা নেই কোনো শরীরের ক্ষতি। বরঞ্চ এ সামান্য কাজগুলোর বিনিময়ে আমরা আল্লাহ সুবহান তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছি। বিনিময়ে সবুজ জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত! সুবহানআল্লাহ!

এবার নামাজরত অবস্থায় সুরাটিকে Feel করুন। প্রতিটি আয়াতে, প্রতিটি শব্দে। নিজের সাথে প্রতিটি আয়াতকে মিলিয়ে নিয়ে। ঝংকার তুলুন হৃদয়ে। দেখবেন, দু'চোখে অশ্রু বহমান...

লেখা : তুহিন মাজহার


পঠিত : ১৬৭৩ বার

মন্তব্য: ০