Alapon

ফেসবুকঃ চাই ইতিবাচক ব্যবহার...

হঠাৎ একবার মাথায় ভুত চাপল, সাংবাদিক হব। সাংবাদিক হয়ে দেশ ও দশের সেবা করব।

একটা সাংবাদিকতা কোর্সে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলাম। কোর্স শেষের পরীক্ষায় সবার মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। কথা ছিল, এই কোর্সে যারা ভাল করবে, কর্তৃপক্ষই তাদের চাকুরীর ব্যবস্থা করবে।

আইনের মানুষ আইনজীবী না হয়ে সাংবাদিক হতে যাচ্ছি, এমন খবরে আত্মীয় স্বজন সব আঁতকে উঠলেন।

এক মামা একদিন ডেকে পাঠালেন। 
খুব করে বোঝালেন, সাংবাদিকতা পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। হুট-হাট করেই পত্রিকা/টিভি বন্ধ হয়ে যায়।অন্য প্রতিষ্ঠানের মত নিয়ম মেনে প্রমোশন হয় না, বেতন বাড়েনা। অনেক সময় মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকে। তাই, আইনজীবী না হয়ে এমন একটা অনিশ্চিত পেশায় নিজেকে না জড়ানোই ভাল।

মামার কথা মনে ধরল। আমার আর সাংবাদিক হওয়া হল না।

তবে সাংবাদিক না হলেও এই কোর্সটা একেবারে বিফলে যায় নি। কোর্স করার সুবাদে সংবাদমাধ্যমের অনেক ভেতরের খবর জানার সুযোগ হয়েছিল।

একদিনের ক্লাসে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক পত্রিকার সম্পাদক কথায় কথায় বলছিলেন “সাংবাদিকতা জগতে একটা কথা প্রচলিত আছে Ill news is good news. আমরা প্রতিদিন মিটিংয়ে বসি। 
আলোচনা করি। 
আগেই ঠিক করি, পরের দিনের লিড নিউজ কি হবে। হয়তো আলোচনা করে ঠিক হল, দেশের অর্থনীতির হালচাল নিয়ে কালকের শিরোনাম করা হবে। 
হঠাৎ খবর এলো, আগুন লেগে ৫ জন মানুষ মারা গেল। ব্যস! আগের শিরোনাম বাদ। লাল কালিতে আট কলামে আগুন লাগার খবর পরের দিনের পত্রিকায় হেড লাইন হয়।

আবার এমনও হয়, পরের দিনের শিরোনাম কি হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় আছি। আলোচনা করেও ঠিক করতে পারিনি। 
হঠাৎ কোথাও বড় কোন দুর্ঘটনার খবর আসে। আমাদের মুখে হাসি ফুটে। যাক অন্তত একটা যুতসই শিরোনাম পাওয়া গেল।“

শুনতে নিষ্ঠুর শোনালেও এটাই বাস্তবতা। আমাদের সংবাদমাধ্যম গুলো নানা নেতিবাচক খবরে ভরপুর। 
তাইতো পত্রিকা খুললেই কাটাকাটি, মারামারি, খু্ন, ধর্ষন, অপহরণের লোমহর্ষক নানা বর্ণনা। 
অনেক পত্রিকা ধর্ষণের বর্ননা এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে, তা যে কোন ‘চটি’ বইয়ের চাইতে কোন অংশে কম নয়।

এইসব খবর পড়লে মনে হবে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে ভয়াবহতম দেশ। এই দেশে কোন মানুষ থাকতে পারে না।

আমার এক কাকা দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পরে দেশে এলেন। কাকার সাথে দেখা করতে গেলাম, রাত ৮ টায়। ৯ টা বাজতেই কাকা বলা শুরু করলেন, ‘ওমর! রাত অনেক হয়ে গেছে। এখন চলে যাও। পথে যদি আবার ছিনতাই কিংবা অন্য কোন দুর্ঘটনা ঘটে!’

আমি হেসে অভয় দিলাম, অত ভয়ের কিছু নেই। মতিঝিল থেকে অনেক সময় ১২ টার পরেও বাসায় ফিরি। পত্রিকা পড়লে মনে হয়, আমরা সব গুহাবাসী। সন্ধ্যার পরে আমাদের ঘর থেকে বেরুনো মানা। আসলে ব্যাপারটা এমন নয়।

পাঠকদের মধ্যে এসব খবরের কাটতি অনেক। পাঠকেরা পত্রিকা হাতে পেলে সে সব খবরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
অনেকে হয়তো মুখে আহারে উহুরে করেন। কিন্তু পত্রিকায় কোন নারীর অপহরণ, ধর্ষণের খবরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন সবার আগে । মনের মধ্যে এক ধরনের বিকৃত সুখ অনুভব করেন।

পরিচিত এক ভদ্রলোক দীর্ঘদিন আমেরিকায় কাটিয়ে এসেছেন। কথায় কথায় তিনি বললেন “সেই সব দেশেও শিশু ধর্ষণ, হত্যা, খুন খারাবীর ঘটনা ঘটে। 
সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। 
তবে সেই সব দেশের পত্রিকাগুলোতে এতটা ফলাও করে প্রচার করা হয় না। এতটা বিস্তারিত বর্ননা থাকে না। “

সাংবাদিক শফিক রেহমান একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমাদের পত্র পত্রিকার প্রথম পাতায় সব সময় নেতিবাচক খবর থাকে। 
দেশের ইতিবাচক দিক, আশাব্যাঞ্চক বিভিন্ন দিক প্রথম পাতায় থাকে না বললেই চলে।
দৈনিক ‘যায় যায় দিনে’ তিনি একটা নতুন ফিচার চালু করলেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় বক্স আইটেম করে, একটা করে ভাল খবর থাকত। 
তার বিদায়ের পর সে ধারা আর চালু থাকে নি।

আগে ছিল শুধুই পত্রিকা। এখন তার সাথে যোগ হয়েছে ফেসবুক। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর মত এখানেও চলে ভাইরাল করার প্রতিযোগিতা। 
কে কতটা ভাইরাল করতে পারে, কে কয়টা লাইক কমেন্ট আদায় করতে পারে, সবাই সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।

এইতো দিন কয়েক আগে কে বা কারা গুজব ছড়াল, পদ্মা সেতু করতে মানুষের কল্লা দরকার। 
ব্যস! অনেকেই ঝড়ের বেগে শেয়ার দিয়েছেন, ভাইরাল করেছেন। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন নি।

ফেসবুক জগত আজ নানা নেতিবাচক খবরে ভর্তি। 
অমুক বিখ্যাত মানুষের গোপন ভিডিও ফাঁস, অমুক হুজুর তমুক হুজুরকে বাঁশ দিয়েছেন, অমুক অভিনেত্রীকে জুতা মারুন, তমুক দল/গোষ্ঠীকে বর্জন করুন, অমুক মরে গিয়ে জাহান্নামে গিয়েছে...নেতিবাচক খবরের শেষ নেই। 
ফেসবুক যেন মানুষের ‘চরিত্র হননে’র এক কারখানা। সবাই সবার পিছু লেগে আছে। অন্যকে পঁচানো, তার সম্মানহানি করাই মুখ্য বিষয়।

এর সাথে যোগ হয়েছে সস্তা লাইক কামানোর নামে নানা ‘প্রাঙ্ক ভিডিও। যাতে অন্য মানুষকে শারিরীক মানসিক কষ্ট দিয়ে একদল লোক বিকৃত আনন্দে মেতে উঠে। 
এই সব ভিডিও যত ছড়ায়, ততই নাকি টাকা কামানো যায়।

ফেসবুকের কিছু কল্যাণকর দিক যে নেই, তা নয়। 
ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে খুব সহজেই জনমত গঠন করা যায়। প্রতিবাদের আওয়াজ তোলা যায়। 
অনেক মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন। অনেকে বিপদে আপদে খুব সহজেই মানুষের সাহায্য পাচ্ছেন। 
তবে নিত্যদিনের নেতিবাচক খবরের ভিড়ে এর সংখ্যা নেহায়েত নগণ্য।

পত্রিকা আর ফেসবুকের জগতে এলে নিজেকে মাঝে মাঝে অসুস্থ মনে হয়। 
মন মস্তিষ্ক এত এত নেতিবাচক পোস্ট নিতে পারে না। 
নেতিবাচক খবর ও ঘটনার বাইরে ভাল খবরও তো আছে। 
এই দেশের সাধারণ মানুষের অনেক ভাল ভাল কাজ আছে। আন্তরিকতা, ভালবাসায় তাদের অনেক কাজ বিশ্বসেরা। 
আমাদের অনেক তরুণেরা সমাজের মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন।

অনেক মহৎ কাজে নীরবে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছেন।
নেতিবাচক খবর ও কাজ সামগ্রিকভাবে মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 
একটা মানুষ উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে শুধুই খারাপ খবর ও খারাপ কাজের বর্ণনা শুনলে তার মনোবৃত্তিও খারাপ হয়ে যায়। 
অন্যদিকে ভাল কাজের প্রচার প্রসার আরও দশটা মানুষকে ভাল কাজে উৎসাহিত করে।

‘মাটি ও মানুষ’ নামে একটি টিভি অনুষ্ঠানে এ দেশে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সে অনুষ্ঠান দেখে অসংখ্য কৃষক, তরুণ, মাছ চাষ, মুরগী পালন ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। 
‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে দেখানো অনেক কল্যাণকর কাজ, আরও হাজারো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে।

তাই, আসুন না, আমরা সস্তা লাইক, কমেন্ট আর ভাইরালের প্রতিযোগিতা বন্ধ করি। 
অন্যের ‘চরিত্র হননে’ ব্যস্ত না থেকে আমরা ফেসবুককে ভাল কাজে লাগাই। 
কল্যাণকর, ভাল কাজগুলোকে বেশি বেশি ভাইরাল করি, মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেই। 
অন্যের সম্মানহানির চাইতে অন্যের পজিটিভ দিকটাকেই বেশি ফুটিয়ে তুলি।

এতে সমাজ বদলাবে। বদলাবে মানুষ। 
আর কিছু না হোক, অন্তত মনের গহীন কোণে আপনি এক সুনিবিড় প্রশান্তি অনুভব করবেন।

অন্যের পিছু লেগে থাকার বিকৃত আনন্দের চাইতে এই প্রশান্তি অনেক অনেক আরামের, ভাল লাগার।

গ্যারান্টেড!



লিখেছেন: শামসুর রহমান ওমর

পঠিত : ১৩২৮ বার

মন্তব্য: ০