Alapon

ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলন হামাসের ইতিহাস...

হামাস শব্দটির অর্থ আশা, বা উদ্দীপনা। এটি মূলত حركة المقاومة الاسلامية হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া, “ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন” এর একটি আদ্যক্ষর। ইজ্জদ্দীন আল কাসাম নামে হামাসের একটি সামরিক শাখাও রয়েছে। 
গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসলামি এই প্রতিরোধ আন্দোলন এর প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৭ সালে, প্রথম ইন্তিফাদা’র মাধ্যমে। হামাস এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন, যিনি মূলত ছিলেন তৎকালীন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ফিলিস্তিন শাখার নেতা। ইয়াসিন ছিলেন পঙ্গু কিন্তু তবুও যুবক বয়স থেকেই তিনি ছিলেন গাজার নেতা। ১৯৭৮ সালে ৪৯ বছর বয়সী শেখ আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য আল মুজাম্মা আল ইসলামি নামে একটি ইসলামি সংগঠন গড়ে তুলতে অধিকৃত ইসরায়েলী কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন৷ ইসরায়েল তা মন্জুর করে, কেননা ইজরাইলের লক্ষ্য ছিল গাজায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা পিএলও এর গুরুত্ব হ্রাস করা। কিন্তু ইজরাইলের সেই প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় । খুব সহসাই তারা বুঝতে পারে শেখ আহমেদ ইয়াসিন ঝানু মাল এবং পাক্কা মুসলমান। ইজরাইলের মাথায় তাল রেখে কায়দামত ঠিকই হামাসকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় “হামাস চার্টার” যার লক্ষ্য হলো অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো।

একনজরে গাজাঃ

গাজা ভূখণ্ড (আরবি: قطاع غزة ক্বিত্বা` গ়াজ়্‌জ়া, হিব্রু ভাষায়: רצועת עזה রেৎসু'আৎ 'আজ়্‌জ়া) ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত একটি ভূখণ্ড। এর ৩২০ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে চারটি শহর, আটটি ফিলিস্তিনী শরনার্থী শিবির আর এগারোটি গ্রাম। 
মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক চিলতে এলাকা গাজার জনসংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ, যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০০০ মানুষ বাস করে। (আমাদের ঢাকা শহরের আয়তনও কিন্তু ৩৬০ বর্গকিলোমিটার !) মিশরের সাথে ১১ কিঃমিঃ, ইসরায়েলের সাথে ৫২ কিঃমিঃ সীমানা আর সামনে রয়েছে অবারিত ভূমধ্যসাগর, যেটিও ইসরায়েলী নৌবাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ। এছাড়া, গাজার প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষই জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত উদ্বাস্তু। এমন একটি ভূখন্ডে প্রায় আট বছরব্যাপী অবরোধের মধ্যে থেকেও সরকার পরিচালনা করছে হামাস।গাজা ভূখণ্ডের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে মিশর, এবং উত্তরে, পূর্বে, ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ইসরায়েল। যদিও জাতিসংঘে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গাজা ভূখণ্ডের স্বাধীনতা পুরোপুরি স্বীকৃত নয়, এই অঞ্চলটি ইতমধ্যে ফিলিস্তিনী হামাস সরকারের শাসনে পড়ে। গাজা ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ইসরায়েলের দখলে, এবং সাইনাই মরুভূমিস্থ দক্ষিণ সীমান্ত মিশরের দখলে রয়েছে। ১৯৪৮ সাল হতে ১৯৬৭ পর্যন্ত পুরো ভূখণ্ড মিশরের দখলে ছিল।

সংগঠন হিসাবে হামাসঃ

সংগঠন হিসেবে হামাস মূলত তিনটি শাখার সমষ্টিঃ রাজনৈতিক শাখা, সমাজকল্যাণমূলক শাখা এবং সামরিক শাখা। মজলিশে শূরা হামাসের প্রতিনিধিদের মিলনস্থল, যার মাধ্যমে হামাস সমগ্র ফিলিস্তিনে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে হামাসের নীতিনির্ধারণী পরিষদ হলো পনেরো সদস্যের “পলিটিক্যাল ব্যুরো”। বর্তমানে হামাসের প্রধাণ হলেন খালেদ মিশাল; আর গাজা অঞ্চলে প্রধাণমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন ডঃ ইসমাইল হানিয়া।

হামাসের সামাজিক কর্মকাণ্ড

হামাসের শত্রু ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞদের গবেষণায়ই উঠে এসেছে, হামাসের কার্যক্রমের ৯০% হলো সামাজিক, শিক্ষা বিস্তার, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কাজ, এবং এই সামাজিক কাজের মধ্যে দাতব্য চিকিৎসা, মসজিদ স্থাপন, স্কুল ও শিশুশিক্ষা অর্থায়ন, খেলাধূলার জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা অন্যতম। শত অবরোধের মধ্যেও বার্ষিক ৭০-৯০ মিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট দিতে সক্ষম হয় হামাস, যার প্রায় ৮৫% অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে। প্রতিরক্ষা এবং সামরিক খাতে বরাদ্দ যায় মাত্র ১৫% (রেফারেন্সঃ কিংডম অফ গড (২০০৭), লেখক রুভন পাস)।

সবসময় ঘর ভাঙ্গা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় হামাস। ইসরায়েলী বিমান হামলা কোন ঘর বিদ্ধস্ত হলে ১৫মিনিটের মধ্যেই সরকারী সেবাদানকারী মানুষেরা (উদ্ধারকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশ) চলে আসেন তাদের সাহায্যার্থে। এছাড়া ইসরাইলী আগ্রাসনে শহীদ হওয়া ফিলিস্তিনীদের পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য এককালীন ও নিয়মিত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে হামাস (যার পরিমান ৫০০ থেকে ৫০০০ ডলার হয়ে থাকে)। এছাড়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি ঘর, স্কুল বা মসজিদ পুনঃনির্মাণে সহায়তা দিয়ে থাকে হামাস। যদিও হামাস মূলত একটি ইসলামী আন্দোলন হিসেবে কাজ করে, কিন্তু জোরপূর্বক কাউকে ইসলামী অনুশাসন মানতে বাধ্য করবার কোন নজির এখানে নেই। হামাস সরকারের দাওয়াহ মন্ত্রনালয়ের অধীনে ‘ফাদিলা’ বা ‘Virtue Committee’ নামে কিছু নাগরিক কমিটি আছে, যারা বিভিন্নভাবে জনসাধারণকে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে আহবান জানায়, অনুরোধ করে। কিন্তু স্কুলছাত্রীদের জোর করে হিজাব পরানোর একটি উদ্যোগ হামাস সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তৎপরতায় বন্ধ করা হয়। এছাড়াও জোর করে নিজেদের এলাকায় আঞ্চলিকভাবে শরীয়াহ আইন কায়েম করার প্রচেষ্টাকেও নস্যাৎ করে দেয় হামাস।

শিক্ষাঃ

টানা আট বছর অবরোধ এবং নানা ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও গাজা উপত্যকায় শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে হামাস। ২০১২ সালের হিসাব মতে, গাজা উপত্যকায় শিক্ষার হার প্রায় ৯৯%। সেখানে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া প্রায় চার লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর জন্য ৬৮৩ টি স্কুল রয়েছে যার মধ্যে ৩৮৩ টি স্কুল সরকার অর্থাৎ হামাস পরিচালনা করে।

স্বাস্থ্য সেবাঃ

স্বাস্থ্যসেবায় হামাস নিজেকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য অবস্থানে। অব্যাহত অবরোধে থাকবার কারণে খাদ্যের মান কমে যাওয়ায় গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শৈশবকালীন অপুষ্টির হার মারাত্নক হারে বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলী আগ্রাসনে আহত মানুষজনের চিকিৎসা প্রয়োজন তো রয়েছেই। হামাস পরিচালিত হাসপাতালে কম খরচে বা বিনা খরচে সুচিকিৎসা দেয়া হয়। মৃত্যু উপত্যকা গাজায় বর্তমান জন্মহার প্রায় ৪%। এছাড়াও শিশুদের জন্য অসংখ্য নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছে হামাস যার মাধ্যমে তাদের এক বেলা খাবারও সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বা দাতা দেশ থেকে আসা সাহায্য ও আর্থিক অনুদান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে হামাস; অপরপক্ষে ফাতাহ গোষ্ঠী এই দিকে আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জ। হামাসের এই সামাজিক কার্যক্রমের জনপ্রয়তা শুধু গাজা স্ট্রিপেই নয়, বরং ফাতাহ শাসিত পশ্চিম তীর এমনকি আশেপাশের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও অনেক বেশি জনপ্রিয়।

মিডিয়াঃ
২০০৬ সাল থেকে হামাস চালু করেছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘আল আকসা টিভি’। হামাসের মিডিয়া গুরু ফাতহি হাম্মাদের মিডিয়া হাউজ ‘আর-রিবাত কমিউনিকেশন্স’ এর নেতৃত্বে আরও রয়েছে নিজস্ব রেডিও স্টেশন ‘ভয়েস অফ আল আকসা’ এবং সংবাদ পত্রিকা ‘দ্য মেসেজ’। অনলাইন জগতে টুইটার এবং ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে রয়েছে হামাসের সরব উপস্থিতি। এছাড়া লন্ডন থেকে আল ফাতিহ নামে শিশু-কিশোরদের জন্যেও একটি পাক্ষিক পত্রিকা নিয়মিত বের করা হয়।ৎ

সামরিক শাখাঃ
হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জদ্দিন আল ক্কাসাম ব্রিগেড যাকে সংক্ষেপে আল ক্কাসাম ব্রিগেড বলা হয়। এটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তখন থেকেই ইসরায়েলকে সামরিকভাবে তটস্থ করে রেখেছে তারা। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও লিমিটেড টেকনোলজী আর অর্থায়নে ক্কাসাম রকেট দিয়েই ইসরায়েলি বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের আয়রন ডোম অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইসরায়েলের প্যাট্রিয়ট মিসাইল এবং এফ-১৬ এর মোকাবেলায় ক্কাসাম ব্রিগেডের ব্যবহার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে স্বল্প মাত্রার আল বানা, আল বাতার এবং আল ইয়াসিন রকেট, এছাড়াও ট্যাংক বিধ্বংসী গোলাসহ কিছু হালকা যুদ্ধাস্ত্র। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে ইসরায়েলে পৌছে এক দুঃসাহসিক কমান্ডো অভিযানের চেষ্টা চালায় হামাস যোদ্ধারা। ইরানের পর মুসলিম দেশ হিসেবে সাফল্যজনকভাবে ড্রোন তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে হামাস, যা তেলাবিবের আকাশ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। তবে হামাস যোদ্ধারা গ্রাউন্ড কমব্যাটে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। প্রবাসী হামাস নেতা খালিদ মিশালকে হত্যার একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো ইসরায়েলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং সিনবেথ, তবে হামাসের অপারেটিভদের সাহস এবং দৃঢ়তায় তারা সফল হতে পারে নি।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সীমাহীন আত্নত্যাগ, সততা – দক্ষতা ও নিপীড়িত মানুষের মধ্যে থেকে তাদের পাশে দাড়ানোর পাশাপাশি তাদের জন্য আমরণ লড়াইয়ের অদম্য মানসিকতাই হামাসকে দাঁড় করিয়েছে এক অনন্য অবস্থানে; শুধু ফিলিস্তিনীদের হৃদয়ে নয় বরং সারা বিশ্বের মজলুম সংগ্রামী মানুষের মধ্যে। আসুন আমরা ফিলিস্তিনের মর্দে মুজাহিদ হামাসের ভাইদের জন্য আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলি।

সংগৃহিত

পঠিত : ২০০৫ বার

মন্তব্য: ০