Alapon

মনোমানবিক! একটি পটভুমি।

দুই ফোটা পানি টপ টপ করে পড়ল খাতার উপর। তড়িঘড়ি করে বাম হাত দিয়ে চোখ মুছল মনির। তারপর আশে পাশে তাকাল যে কেউ দেখল নাকি। নাহ প্রায় সবাই লিখছে। কেউ সামনের জনকে কলমের গুতা দিয়ে একটু কাত হয়ে লিখতে বলছে যেন পিছন থেকে দেখে লেখা যায়। কিন্তুু বাশেঁর একটা পুরাতন কিন্তু শক্তিশালি ব্যাত নিয়ে ডিউটি দিচ্ছে আজাদ স্যার। এই স্যার তার পর্বত সমান ভুড়ি নিয়ে কিছুক্ষন পর পর সাইরেন বাজিয়ে যান।
-এই মাজেদ ঠিক হয়ে বস। আর একবার মাথা ঘুড়ালে পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। কখনো কখনো মাজেদের মত কেউ দাড়িয়ে বলে ,
-স্যার আমি তো দেখিনি।
- আবার কথা কয়? তুই দেখিস নাই তোব বাপ দেখেছে । আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক। একটা গরুও তোর চাইতে ভাল আছে।
 
চলতেই থাকে আজাদ স্যার হুশিয়ার মুলক বয়ান। যদিও আজাদ স্যারকে আড়ালে সবাই অজাত স্যার বলেই ডাকে। স্যার পিটায় কম কিন্তু কথা দিয়ে জন্মের পিটানি দেয় । একবার ক্লাসে শফিক কবি নজরুলের জন্ম সাল বলতে পারেনি। ওকে দাড় করিয়ে বয়ান শুরু,
-বিয়া দিলে তো তিনটা বাচ্চার জন্ম দিবি। আর সামান্য জন্ম সাল মনে নাই? গুরু কোথাকার? তোবা বাপের সাথে কালই কথা বলব যেন তোর শিঘ্রই বিয়ার ব্যাবস্থা করে। ১ম বাচ্চাটা নিবি একবছর পর তাহলে পড়া মনে থাকবে।
লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় শফিকের। বান্ধবীরা হাসাহাসি শুরু করে দেয়। মাথা নীচু করে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকে। স্যারের প্রিয় গালি গরু আর ইডিয়েট।
 
ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার ফি দিতে পারেনি মনির। প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রায়ই তাকে দাড়িয়ে থাকতে হয়। হয় সেশন ফি বাকি অথবা পরীক্ষার ফি কিংবা দুটোই । বাড়িতে আব্বাকে বার বার বলছিল যে পরীক্ষার আগেই ফি দেবার জন্য কিন্তু আব্বা উল্টা ধমক দিয়ে চুপ করায়ে রাখে।
-হেড স্যারকে বলিস , তুই জমিদারের বাচ্চা না । কামলার বাচ্চা। ট্যাকা দিতে কয়দিন দেরি হইবে।
ধমকের খেশারত সরূপ লেখা বন্ধ করে দাড়িয়ে থাকে শফিক। আজ পর পর তিনদিন দাড় করানো হয়েছে শফিক কে। ক্লাসে সে এমনিতেই লাজুক। কার সঙ্গেই তেমন কথা বলে না আর বান্ধবিদের সাথে তো প্রশ্নই ওঠে না। এই নিয়ে বান্ধবি মহলে তাকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এক দিন তো নিপা সবার সামনে বলেই বসল, তুই তো লেডিস মার্কা। আয় তোকে একটু লিপস্টিক দিয়ে দেই । হেসে উঠে সবাই। রাঙ্গিয়ে যায় মনিরের মুখ। কেউ বা আবার পিছন থেকে ডেকে ওঠে, ও মনিরা আপু কেমন আছেন? এজন্যই মনির এদের থেকে নিরাপদ দূরুত্বে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ দাড় করিয়ে কথার বাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু মনির কোন কথা দিতে পারছে না কারন তার আব্বা তো এখন পর্যন্ত কোন ডেট দেয় নি। কিভাবে সে স্যারকে টাকা দেবার তারিখ বলবে । তাছাড়া আজ পরীক্ষা শুরুর সময় হেড স্যার এসে হুশিয়ারি দিয়ে গেছে যে , যারা আজ বকেয়া পরিশোধ না করবে তাদের পরীক্ষা দেয়া হবে না।
তাই আজাদ স্যার আজ বেশী কঠোর। তিনি হেড স্যারকে পীরের মত মানেন। যা বলবেন তাই করবেন। কিন্তু হেড স্যার যখন বলেন, -আজাদ সাহেব আপনার গলাটা কি কমানো যায় না?
-কি করব স্যার। গলাতো আল্লাহর দান। ইচ্ছা করলেই তো আর কমাইতে পারি না? পান চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দেয় আজাদ স্যার।
-কিন্তু অন্য শিক্ষকরা তো বলেন আপনার গলার শব্দে তারা ভাল করে ক্লাশ নিতে পারে না।
-কথাটা উল্টা স্যার বরং তারা ছাত্র ছাত্রীদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না।
নিজের অবস্থানে গলার ব্যাপারে সর্বদা অনঢ় আজাদ স্যার। হেডস্যার বলতে বলতে ক্লান্ত। তাই এখন অন্য কোন শিক্ষক এ নিয়ে অভিযোগ তুললে সরাসরি বলে দেন যে,
-শওকত সাহের, সহনশীলতা বাড়াতে হবে। সিনিয়র শিক্ষকের ব্যাপারে কিছু না বলাই ভদ্রতা।
তারপর থেকে আজাদ স্যারের বিরুদ্ধে ভদ্রতা সরুপ কেউ অভিযোগ তুলে না। মানিয়ে নিয়েছেন এই নিয়তিকে।
চলছেই মনিরকে উদ্দেশ্য করে আজাদ স্যারে অমুল্য বয়ান। অভিমানে , রাগে , ক্ষোভে ভারী হয়ে উঠে মনিরের চোখ। খুব চেষ্টা করছিল যাতে পানি বের না হয় কিন্তু নাহ, টপ টপ করে দুই চোখ দিয়ে দুই ফোটা গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছেও গোপন করতে পারল না মনির। আজাদ স্যার ঠিকই দেখে ফেলেছে।
-সবাই দেখরে এই গরুটা কেঁদে ফেলেছে। তুই তো মহিলা রে ! একটুতেই কাদিস। এই ফারহানা, এই গরুর ফাদাটাকে একটু তোর কাছে বসতে দে তো।
সংগে সংগে হাসির রোল পড়ে যায় । মাথা চোখ গরম হয়ে যাচ্ছে । ইচ্ছা করছে একখনই সব ছিড়ে ছুড়ে বেরিয়ে যাই । লজ্জা , অভিমান আর কষ্ট গুলো রুপ নিল চাপা ক্ষোভে।
- বস তো আব্বাকে বলবি কাল যেন টাকাটা দিয়ে দেয়। মনির বসে না। তার মনে এখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে পিতার কঠোরতা আর স্কুলে স্যারের অপমানে পাথর হয়ে আছে। - এই হাসিব ওরে টেনে বসা তো।
আবার হাসির শব্দ।
এই হাসিবকে নিয়ে দারুন একটা কাহীনি আছে। আজাদ স্যারকে অজাত নামের প্রবর্তক এই হাসিব। ক্লাসের চঞ্চল ছেলেদের একজন। স্যারের কোন কথা গায়ে মাখে না সে। প্রচন্ড ক্রিকেট পাগল। আজাদ স্যারকে সে তো সহ্যই করতে পারে না। সেবার প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর যেদিন স্কুল খুললো সেদিন সে ক্লাশের সবাইকে নিয়ে বসল।  -এই তোরা কুলহুর সুরা সবাই জানিস ? যারা জানিস হাত তোল ।
বলল হাসিব।
প্রায় সবাই হাত তুলল।
-তাহলে তিনবার এই সুরা পড় । আর একবার দরুদ পড়।
>আবার বলল হাসিব।
সমস্বরে সবাই পড়া শুরু করল। পড়া শেষে সবাইকে নিয়ে মুনাজাতের জন্য হাত তুলল হাসিব । এরপর মুনাজাত করা শুরু করল, রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া . . . . . . . হে আল্লার আমাদের ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ আমাদের স্কুলে আজাদ নামের অজাত স্যার আছে শুধু মাত্র তাকে ক্ষমা কর না। সবাই জোরে বলে উঠল আমিন। হে আল্লাহ তাকে সপ্তাহে শুক্রবার বাদ দিয়ে অন্যান্য দিন গুলোতে অসুস্থ থাকার তৌফিক দিয়ে দাও। আবারও আমিন। এভাবে স্যারের নামে যত্ত বদদোয়া আছে সব একএক করে বলা শুরু করল। যেমন স্যারের গরুটাকে স্যারের বদল ক্লাস নিতে দাও, অজাত স্যারকে আরও একটা বিয়ে করার তৌফিক দাও, ওনার ভুড়িটা বাষ্ট হবার তৌফিক দাও ............... এভাবেই সবাই সমস্বরে আমিন এবং হাসির শব্দের মধ্য দিয়ে মুনাজাত শেষ হয়ে যায় । এখন সবাই যখন রুম থেকে খেলার জন্য দরজা দিয়ে বের হতে যায় তখনই সাবাই স্তম্। সবাই বাহিরের দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে ওঠে ভয়ে কাপতে থাকে সবাই। কে কার পিছনে লুকাতে পারে সেই প্রতিযোগীতা চলল। যে ভাবে শব্দ হচ্ছিল ঠিক একই ভাবে চুপ। পিনপতন নিরবতা। কারন দরজার বাহিরে হেডস্যার, আজাদ স্যার সহ পাচ ছয় জন শিক্ষক দাড়িয়ে আছেন। আজাদ স্যারে মুখের উপর দিয়ে যেন ৫৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে গেছে। ভুড়িটি বেশ জোরে উঠা নামা করছে তার মানে বোঝা যায় স্যার ফোস ফোস করছে। মুখের মধ্যে পান স্থগিত । বাম গালটি ফুলে আছে। বোঝা যায় সবে মাত্র পান মুখে দিয়েছেন। সেটাকে না চিবিয়ে মুখের বাম গালে রেখে দিয়েছেন। হেড স্যার মুখ আমাবস্যার মত। আর পিছনের স্যাররা কেউ কেউ মুখ টিপে টিপে হাসছেন। রুমে ঢুকরেন হেড স্যার। সবাই তড়িঘড়ি করে যে যার সিটে বসে পড়ল।
-দাড়াও
বেশ কঠোর ভাবে বললেন হেড স্যার। সবাই দাড়িয়ে পড়ল ঠিক যেভাবে বসে পড়ছিল । মুলত ঘটনা হল সেসময় চেচামেচি আর হাসাহাসির শব্দ শুনে আজাদ স্যার ব্যাত হাতে নিয়ে ক্লাসের দিকে আসছিলেন। বন্ধের পর পর প্রথম দিন। কিন্তু দরজার সামনে এসে ছাত্রদের মুনাজাতের বাক্যগুলো শুনে থমকে দাড়ান। তিনি হেড স্যার সহ অন্যদের ডেকে নিয়ে এসেছেন । এরপর সেদিন টানা দুই ঘন্টা ধরে চলছিল হেড স্যারের বয়ান।
 
হাত ধরে বসার জন্য টানছি হাসিব। কানে কানে ফিসফিস করে বলে চিন্তা করিস না। আমার কাছে ব্যাট কেনার টাকা আছে সেটা তোকে দিয়ে দিব আর অজাত স্যারকে মজা দেখাব। ফ্যাল ফ্যাল করে হাসিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মনির। ঠিক এই মুহুর্তে হাসিবকে মনিরের জন্য বড় আশ্রয়স্থল মনে হচ্ছিল। এ যেন প্ত্যাশার চাইতে অধিক পাওয়া। ঠিক যেমন জলন্ত আগুনে হটাৎ পানি পড়লে যেমনটি হয় ঠিক তেমনটি ঘটল মনিরের বেলায়। হুক হুক করে কেদে ফেলল মনির। এবার আর কোন হাসির শব্দ পাওয়া গেল না। সবাই লেখা থামিয়ে মনিরের দিকে দৃষ্টি দিল। কিছুক্ষন পর আবার চেচিয়ে উঠেন আজাদ স্যার
-এই তোরা সব লেখা থামিয়ে কি যাত্রাপালা দেখছিস ? লেখ।
সবাই স্যার দিকে একটা ক্রর দৃষ্টি দিয়ে লেখায় মন দিল । সবাই আজ মনিরের ব্যাথায় সমব্যাথি ।
-স্যার ও কাল টাকা দিবে বলে উঠল হাসিব। স্যারের মুখভঙ্গিতে কোন পররিবর্তন আসল না। বরং নিশ্চিন্ত মনে আয়েশি ভঙ্গিতে পান চর্বন করছেন। এবার চোখের পানি মুছতে মুছতে লেখা শুরু করল মনির। মনিরের মনে হল যে হাসিব তার সবার চাইতেও আপন। অনেক কাছের একজন বন্ধু। যে তাকে অভয় দিয়েছে আস্বস্ত করেছে। সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়েছে এবং স্যারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে মনিরের ব্যাক্তিত্বটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কলম চলছে খশ খশ করে। মাঝে মধ্যে বাজখাই গলায় শব্দ ভেসে আসছে , -এই সাব্বির আর একবার দেখাদেখি করলে তোকে পানিতে চুবাব।

পঠিত : ৪২৯২৫৬ বার

মন্তব্য: ০