Alapon

ওয়াজ মাহফিলে কন্ট্রাক্ট বনাম মাহফিল কতৃপক্ষের বিবেক ও আমার কিছু কথা।

প্রথমেই ক্লিয়ার করি, আমি কখনোই ওয়াজ মাহফিল বা ইসলামীক প্রোগ্রামে কন্ট্রাক্ট, চুক্তি বা লেনদেন অথবা অর্থনৈতিক বিষয়টি কথাবার্তার মাধ্যমে নির্ধারণ করে নেয়ার বিরুদ্ধে নই, যদি দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে মাহফিল কতৃপক্ষ বক্তা বা শিল্পীকে কোটি টাকাও দিয়ে দেয় অথবা বক্তা বা শিল্পীরা একদম ফ্রীতেই চলে যায় তাহলে আমি আপনি কে সেখানে নাক গলানোর? আমি কে সেটার বিরোধিতা করার?

আমরা কি চাইনা এদেশের আলেমেরা সচ্ছল হোক? তাদের প্রত্যেকের দামী গাড়ী থাকুক,বাড়ী থাকুক,তাদের দেখে সমাজের মা বাবারা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসা মক্তবে পাঠাক,মাদ্রাসায় দিয়ে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা না করুক।
আমরা কি আসলেই চাই, তারা দুই হাজার তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে একশো টাকার নোটের জন্য মিলাদ পড়াক,দুইশো টাকার জন্য তাবিজ বিক্রি করুক,তিনশো টাকার জন্য অনৈতিক কোন কাজ করে বসুক,মাসের পর মাস তাদের ছুটি নাই,ঈদের সময় দুই কি জোরে গেলে তিনদিন,কুরবানির ঈদে সবার গরু জবাই করা মসজিদের ইমাম সাহেব নিজেই কুরবানী দিতে পারেননা,গ্রামের মানুষ তার জন্য গোস্ত সংগ্রহ করতে হয়, মসজিদের ছাদে বা বারান্দায় কবুতরের খোপের মত ছোট্ট একটা রুমে মানবেতর জীবন যাপন করে, বিয়ে করে বৌ রেখে আসে বাড়িতে,যে বেতন পায় তাতে নিজেই তো চলতে হিমশিম খেতে হয়,কি পরিবারকে দিবে আর সংসারের উন্নয়ন করবে, যৌবনের জোয়ারে শয়তানের প্রবচনায় অনেক আলেমকেই দেখা যায় চরিত্র হারিয়ে ফেলতে,নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ফেলতে,সেতো রোবর্ট নয়,মানুষ।সেসবের জন্য আমাদের কি মোটেই দায় নেই?নাকি আপনিও আমরা যা করার করি হুজুর কেন করবে এ নীতিতে বিশ্বাস করেন?

যাই হোক কথা হচ্ছিলো ওয়াজ মাহফিলে কন্ট্রাক্ট করা নিয়ে,কিছু মাহফিলে কালেকশন বড় হয়,আয়োজন বড় হয়,আলেমদের সম্মান ও সম্মানী যথাযথ হয় কিন্তু এখন কথা হচ্ছে সব মাহফিল কতৃপক্ষ তো সমান নয়,সব কতৃপক্ষের তো লাখ টাকা ডোনেশন করার মতো মাহফিলের সভাপতি নেই,কথায় কথায় ৫০ হাজার টাকা ঘোষনা করার মত দানবীর নেই, গ্রামে গঞ্জে দ্বীন প্রিয় ইসলাম প্রিয় তাওহীদ প্রিয় অনেক মানুষেরাও তাদের মসজিদের নামে এতিমখানার নামে গ্রামের নামে বা কোন ঈদগাহের নামে মাহফিল আয়োজন করে থাকেন,দেখা যায় তাদের সেচ্ছাসেবীরা গ্রামের ঘরে ঘরে হেটে দোকানে দোকানে হাতপেতে মুঠ চাল, নারিকেল, সুফারি,খুচরো টাকা সংগ্রহ করে একটা দ্বীনের মাহফিল আয়োজন করতে চেষ্টা করে,একটু মন থেকেই ভাবলেই বুঝতে পারবেন এসব মাহফিল গুলো মহান আল্লাহ্'র কাছে কতটা প্রিয় হতে পারে।

কিন্তু এখানে দুঃখজনক বিষয় দুইটিঃ

প্রথমত, মুঠ চাল সংগ্রহ করে হাজার বিশেক টাকা জমানো সেই গ্রামের ছেলেরাও দাওয়াত দিয়ে আনতে চাচ্ছে ঢাকা অমুক মসজিদের খতিব সাহেব চট্রগ্রাম তমুক মসজিদের খতিব সাহেবকে অথচ তাদের ঐ হাজার বিশেক টাকার সিংহ ভাগই মাহফিলের স্টেজ, ডেকোরেশন আর মাইকের পিছনেই খরচ হয়ে গেছে,এখন ঐ আলেমরা এতো দূর থেকে আসবেন তাদের তো একটা পথ খরচ আছে,আর বিষয়টা এমনও নয় যে তারা শুধু একটি মাহফিল করছে,মাশা-আল্লাহ এখন বাংলাদেশে এই দুঃসময়েও ইসলামী মাহফিলের গণজাগরণ চলছে বলা যায়। সুবিখ্যাত এসব আলেমগণ সমগ্র দেশব্যাপি ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন ফলে দেখা যায় আজ উনি ঢাকা তো কাল রাজশাহী পরশু রংপুর। এমতাবস্থায় উনি চাইলেই আপনার মন মত তারিখে মাহফিলের ডেট দিতে পারেননা,আবার উনার এই দীর্ঘসফরে উনার কিছু সফর সঙ্গী থাকে,তাদের খাওয়াদাওয়া বা বেতনও ঐ আলেমের মাহফিল থেকে প্রাপ্ত টাকা থেকেই হয়, ড্রাইবার থাকে,গাড়ির তেলের খরচ সহ নানাবিধ খরচ থাকে।এখন আপনি চাইলেই আবেগে উনাকে মাহফিলে এনে ওয়াজ করিয়ে দুই তিন হাজার টাকা দিয়ে হুজুর কিছু মনে করিয়েননা টাইপের কথা বলে হুজুরের ঈমানের পরীক্ষা নেয়ার কোন মানে নেই।

দ্বিতীয়ত, কিছু আলেম আসলেই দ্বীনের দাওয়াতের চেয়ে নিজেদের টাকা রুজিকে বড় করে দেখছেন,যারা মাহফিল কোথায়,ছোট না বড়,ঐতিহ্যবাহী কিনা,গতবছর কোন আলেম প্রধান বক্তা ছিলো,এ বছর আর কারা কারা ওয়াজ করবেন,উনাকে প্রধান বক্তা করা হবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করবেন,আবার অনেকে তো ব্যক্তিগত সেক্রেটারি রেখে দিয়েছেন রীতিমত! সেসব সেক্রেটারিদের মধ্যে অনেকের ব্যবহার শুনলে আপনার প্রথমনেই বাজারের কোন গরুর দালাল বা রিলিফের চাউল বিতরনের সময় লাইন ঠিক করা চৌকিদারের কণ্ঠস্বর মনে হতে পারে,এরা সরাসরি রুক্ষ ভাষায় টাকার চুক্তি নিয়ে কথা বলবে,মুখের উপর ফোন কেটে দিবে,ডেট নাই,হুজুর ব্যস্ত, হুজুর অসুস্থ এ টাইপের মিথ্যা কথা বলবে।আবার পরে দেখা যায় মাহফিল কতৃপক্ষ কোন বড় মানুষকে দিয়ে ঐ হুজুরকেই সরাসরি call দেয়াচ্ছে এবং ঠিকমত ঐ একই দিনেই ডেট পাচ্ছে!যা কিনা সত্যিই দুঃখজনক।

এক্ষেত্রে আমি দুই পক্ষের মানুষকেই ছোট্ট করে কিছু পরামর্শ দিতে চাইঃ

প্রথমত পক্ষকে বলতে চাই, আপনাদের প্রচেষ্টাকে আমি সম্মাণ করি,মহান আল্লাহ্ নিশ্চই আপনাদের এমন কঠিন কাজকে তার নেকের বৃষ্টি দিয়ে ভারী করে দিবেন আমলনামায়,আপনারা আপনাদের কাছের ভালো আলেমদের দাওয়াত দেন,আপনাদের নিয়ত যদি দ্বীনের কথা শুনা হয় তাহলে বড় আলেম ছোট আলেম বাদ দেন জ্ঞানী আলেম খোঁজ করুন,আশেপাশের মসজিদের ভালো খতিব,পেশ ইমাম, মাদ্রাসার মুহাদ্দিস বা যে কোন আলেম কে দাওয়াত দিন,এতে উনাদেরও জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পাবে আপনাদেরও সাধ্যের মধ্যে সুন্দর মাহফিল হবে।আর যদি নিয়ত হয় অমুক আলেম তমুক আলেমকে না আনলে মাহফিল জমবে না মাহফিল গরম হবেনা তবে দয়া করে থামুন আপনার মাহফিল করার দরকার নাই আপনি রাজনৈতিক দলের জনসভা বা বৈঠকে চলে যান সেখানে তারা আপনাকে উল্টো টাকা দিয়ে আপনার গা গরম করে দিবে বক্তব্য দিয়ে!আপনার উদ্দেশ্য হেদায়েত হয় গা গরম করে রাত জাগা আর ভোরে ফজরের নামায কাযা করা।

দ্বিতীয় পক্ষকে বলবো, আপনারা আলেম,আমাদের মাথার মকুট,আমরা আপনাদের ভালোবাসি বলেই আপনাদের বয়ান গুলো শুনে তৃপ্তি পাই বলেই আপনাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি,প্রথমত নিজের মোবাইলটা অন্তত নিজে রিসিভ করুন,প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় বেধে দেন যে প্রতিদিন এতটা থেকে ওতটা পর্যন্ত আপনারা আমাকে call দিলে সরাসরি পাবেন।আপনি কথা বলুন,শুধু মাহফিলে মাইকের সামনে নয় মোবাইলের ওপাশ থেকেও একজন আলমের পরিচয় দিন।আপনার জন্য কিভাবে সুবিধা হয় আর তাদের জন্য বিষয়টা কিভাবে সহজ হয় সেভাবে কথা বলুন,সুন্দরের মাধ্যমেই গ্রহণ করুন অথবা বিরত থাকুন,শুধু শহরকেন্দ্রিক বা ঐতিহ্যবাহী নয় কিছু কিছু মাহফিল তায়েফের ময়দানেও করুন,কৃতদাস বেলালদের সামনেও করুন তবেই তো ইসলামের সুমহান বাণী সবত্র ছড়িয়ে যাবে।আজ তায়েফ আছে কিন্তু পাথর মারার মতো কোন কাফের অবশিষ্ট নেই আজ বেলালদের আযানের সুরে পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জমিন প্রকম্পিত হচ্ছে।কাউকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই,অন্তত আপনারা যারা মানুষকে হেদায়েতী ওয়াজ শুনান আপনাদের ক্ষেত্রে তো নয়ই।

পরিশেষে বলবো,কিছু মানুষ সবসময় আলেমদের দোষ খুজতে ব্যস্ত,এটাই তাদের চরিত্র,কি করবেন,আপনার আমার কাজই তো তাদের সংশোধন করা,তাদের ভুল ত্রুটি গুলো শুধরে দেয়া।ভুল ধারনার পরিসমাপ্তি করা।

আবার অনেক আলেম বলেন সবারই তো কম বেশি দোষ আছে তাহলে সবাই শুধু হুজুরের দোষ খুজে কেন? আরে ভাই আপনাদের দোষ নেই বা থাকবেনা বলেই তো মানুষ আপনাদের ইমামতির দায়িত্ব দেয়,আপনাদের পিছে নামায পড়ে,রুকু করে, সেঁজদা করে,সালাম ফিরায়,সরল বিশ্বাসে আপনাদের সাথে হাত তুলে দোয়া করে,আমীন আমীন বলে। আপনাদের সম্মান করে,আপনাদের শ্রদ্ধা করে। সুতরাং অন্যে দোষ করছে করুক আপনি করবেননা বলেই আপনি আলেম,আপনি চরিত্রবান, সমাজের সবচে ভালো মানুষ,আপনাকে দেখা মাত্র চোরও সালাম দিতে কার্পণ্য করেনা।

মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকেই তার দ্বীনের কর্মী হিসেবে কবুল করুক,যাবতীয় প্রচেষ্টাকে তার দ্বীনের জন্য কবুল করুক,আমীন।

ভুল ত্রুটি হলে আমাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে অবশ্যই শুধরে দিবেন,জাযাকাল্লাহ্।


সংগৃহিত

পঠিত : ৮৭৭ বার

মন্তব্য: ০