Alapon

মশা দমনের নামে চলছে কোটি কোটি টাকা লুটপাট

মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। মশার উপদ্রব এতই বেড়েছে যে,  রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসা-বাড়িতে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়। মশার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে প্রতিবছর এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। কিন্তু কাজের মান বাড়ে না। নগরবাসীর অভিযোগ, তারা মশক নিধনকারী কর্মীদের দেখা পান না। অনেকেই করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে ওষুধ নিয়ে বাইরে বিক্রিও করে দেন। আবার অনেক কর্মী কাজ না করে শুধু হাজিরা দিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করে নেন। অভিযোগ উঠেছে, প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুই বেলা বিষাক্ত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, মশা মারার যন্ত্রের অর্ধেকই নষ্ট। নেই পর্যাপ্ত জনবলও। এছাড়া মশার মারার যন্ত্রের শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মশা উড়ে পালিয়ে যায়। নগরীর বেশকিছু এলাকায় সিটি করপোরেশনের প্রবেশাধিকার না থাকায় সেসব স্থানে ওষুধ ছিটানো যায় না।

জানা গেছে, গত অর্থবছর মশা নিধন কার্যক্রমের জন্য ডিএসসিসির বাজেট বরাদ্দ ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছিল। এই অর্থবছর ডিএসসিসির বাজেট বাড়িয়ে ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ডিএনসিসিতে মশকনিধনে এই অর্থ বছরে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আরজুমান বেগম বলেন, ‘রাতে বাচ্চাদের পড়ার টেবিলে বসাতে পারি না। মশার কয়েল জালিয়ে রাখতে হয়। মশার উপদ্রব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কয়েলও কাজ হয় না। বাসায় স্প্রে করলে কিছুক্ষণ পর আবার পুরো ঘর মশায় ভরে যায়। রাতে মশারির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে পড়ে মশা।’

পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক আব্দুল আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশারি, কয়েল কিংবা ইলেকট্রিক ব্যাট কিছুতেই মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।  শুধু শুনি, সিটি করপোরেশন অনেক উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাদের কর্মীদের দেখা পাইনি। একটি দিনের জন্যও কোনও কর্মীকে দেখিনি।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ সালাহউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটা সঠিক নয়। কর্মীরা নিয়মিত কাজ করেন। তবে কর্মী সংকট রয়েছে। কাজের উপস্থিতি নিশ্চিত ও নিয়মিত ডিউটি আদায় করতে তাদেরকে তদারকির দায়িত্ব ওয়ার্ড কাউন্সিলদেরকে দেওয়া হয়েছে। এখন ফাঁকিবাজির সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে ডা. শেখ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেবা সংস্থা হিসেবে আমাদের কাছে নগরবাসীর অভিযোগ থাকবেই। মশা মারার জন্য যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তা উন্নতমানের। তবে আমাদের কিছু যন্ত্র বিকল রয়েছে। এরপরেও মশা দমনের জন্য বিভিন্ন সময় আমরা ক্র্যাশ গ্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকি। সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া বড় আকারে ধারণ করার পর আমরা একযোগে কাজ করেছি। সফলতাও পেয়েছি।’

দুই সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওষুধ ছিটানোর ব্যাপারে শ্রমিকরা সঠিকভাবে কাজ করেন না। এছাড়া ওষুধের মানও অনেক খারাপ। মশা নির্মূলে স্প্রেম্যানরা ওষুধ ছিটানোর পর মশা পড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার উড়ে যায়। এ জন্য ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে স্প্রেম্যানদের ওপর যথাযথ মনিটরিং দরকার। এছাড়া নগরীর বেশ কিছু এলাকায় মশক নিধনকর্মীদের প্রবেশাধিকার নেই। এর মধ্যে বিমানবন্দন, বসুন্ধরা ও উত্তরার কিছু কিছু এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় মশা উৎপাদন হয়ে অন্য এলাকায় চলে যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য ৫ থেকে ৬ জন করে কর্মী নিযুক্ত আছেন। তারা দিনে দুই বার ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। তবে সিটি করপোরেশন এমন দাবি করলেও নগরবাসী তাদের দেখতে পান কালেভদ্রে। কীটনাশকে মশা মরছে না।

এদিকে গত বছরের ১৭ জুলাই তৈরি করা এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মশার ওষুধ ছিটানোর ৯৪০টি মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪২টি হস্তচালিত, ৪৪৭টি ফগার ও ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিন। ৪৪২টি হস্তচালিত মেশিনের মধ্যে ২০৮টি ও ৪৪৭টি ফগার মেশিনের মধ্যে ১৮৬টি অচল এবং ১৬টি অংশিক অচল। আর ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিনের মধ্যে ১৮টি অচল। সব মিলিয়ে তিন ধরনের ৯৪০টি মেশিনের মধ্যে ৪২৮টি মেশিনই নষ্ট।

উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে মশা নিধনের জন্য সংস্থাটির ৬৫৩টি মেশিন রয়েছে। এরমধ্যে হস্তচালিত মেশিনের সংখ্যা ৩৮৭টি, ফগার মেশিন ২৫৫টি, হুইল ব্যারো মেশিন ১০টি এবং একটি ভ্যাহিক্যাল মাউন্টেড ফগার মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকই বিকল।

বিকল হওয়া এসব মেশিন মেরামতের জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে সংস্থা দু’টির ভাণ্ডার বিভাগে চাহিদাপত্র দেওয়া হলেও কোনও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ভাণ্ডার বিভাগের অভিযোগ—বিকল হওয়া যন্ত্রগুলোর যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদেশি যে কোম্পানিগুলো থেকে মেশিনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেসব কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি, ওয়েব সাইটে কিংবা মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে নষ্ট হওয়া যন্ত্রাংশগুলো পাওয়া যাবে। এতে খরচ পড়বে কম। কিন্তু সংস্থার কর্মকর্তারা বিকল মেশিনগুলো বাদ দিয়ে নতুন করে আবার যন্ত্র আমদানি করার পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযো রয়েছে।

দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ফগার মেশিন দিয়ে মশা মারা সম্ভব হয় না। কারণ, মশা অনেক ‘চতুর’। মেশিনটির বিকট শব্দ শুনলেই মশা পালিয়ে যায়। এছাড়া, ৭০ শতাংশ মশা নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ছাদে তৈরি বাগানে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। এসব স্থানে ডিসিসির কর্মীদের ওষুধ ছিটানোর অনুমতি নেই। এ জন্য মশার বংশবিস্তার রোধে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে।

সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীরা বলছেন, বাসাবাড়ির আঙিনা, ছাদ বাগান, নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত ভবন, গাছের কোটর, এসি ও ফ্রিজ থেকে জমা পানি, ফুলের টব,পরিত্যক্ত টায়ার, খালি ক্যান ও ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিতে মশার বংশ বিস্তার বেশি ঘটে। এসব স্থানে করপোরেশনের মশক নিধনকর্মীরা যেতে পারেন না। ফগার মেশিনের শব্দ শুনলেই মশা এসব স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনে ছয় শতাধিক মশক নিধনকর্মী রয়েছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটির পাঁচটি অঞ্চলে মশা নিধনের জন্য ৩০৩ জন স্প্রে ম্যান, ১৪৮টি ফগার মেশিন এবং ২৭১টি হস্তচালিত মেশিন রয়েছে। এর মাধ্যমে মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সমপরিমাণ জনবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটিতেও। হস্তচালিত মেশিনগুলো দিয়ে ওষুধ ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গেই মশা মরে যায়। কিন্তু এই মেশিন দিয়ে দ্রুত কাজ করা যায় না। আর ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করলে অল্প সময়ে বিশাল এলাকায় ওষুধ ছিটানো সম্ভব। কিন্তু এই মেশিনের বিকট শব্দে মশা আগেই পালিয়ে যায়। যে কারণে কাজে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছি। তবে ডিএনসিসিতে এমন কিছু এলাকা আছে, যেগুলোতে আমাদের কাজ করার অনুমতি নেই। সেসব স্থানেও মশার জন্ম হয়। সেই মশা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যায়।’

পঠিত : ৬৬৫ বার

মন্তব্য: ০