Alapon

কাশ্মীরের স্বাধীনতা এবং কিছু কথা...

কাশ্মিরের স্বাধীনতা শর্টকাট ওয়েতে আসবে না। লেংদি প্রসেস। তবে কোনমতেই মিলিট্যান্সি দিয়া না। কারণ, কোন নিউক কান্ট্রির সীমানা চেইঞ্জ করা যায় না, সহজে। চায়না, পাকিস্তান আর ভারত পারমাণবিক শক্তিধর তিনজনেই ভিন্ন ভিন্ন স্কেলে কাশ্মীরি ভূমির উপ্রে ডমিনেশন চালায়। সো সামরিক নজরে তাকাইলে থার্ড বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা আসবার পথ দেখা মুশকিল। পাকিস্তানের ইকোনমিক্স গুড না। চায়নার পলিটিক্স ব্যবসাকেন্দ্রিক। ভারতের বিজেপির জন্য কাশ্মীর প্রেস্টিজ ইস্যু। একবার পাকিস্থানি বিজ্ঞানী আবদুল কাদির একটা বিতর্কিত কমেন্ট করছিলেন সেমিনারে পারমাণবিক বোমার প্রয়োজনীয়তা বোঝাইতে গিয়া যে- ৭১-এ পাকিস্থানের হাতে নিউক থাকলে বাংলাদেশ হইতো না। খুবি মারাত্মক কথা! বাঙলাদেশ স্বাধীন হইবার ২০ বছর পর নিউক বানাইতে সক্ষম হয় পাকিস্তান।

যাহোক, ভারত, পাকিস্তান আর চীনের আমজনতাকে নিজেদের স্বার্থে কাশ্মিরের স্বাধীনতা দাবি করতে হবে। পলিটিকাল পার্টির প্রেস্টিজ ইস্যু বা দেশাত্মবোধকতার তীব্র জ্বলানিরেও না বলাইতে হবে নিজেরা বাঁচবার স্বার্থে। এই ব্যাপারে এডাম স্মিথরে স্মরণে আনা যায়। ওয়েলথ অব নেশনসে ঔপনিবেশিকতার অর্থনীতি নিয়া আলোচনা আছে।

কলোনি সংক্রান্ত অর্থনীতি নিয়া আলোচনার সময় মাথায় রাখা দরকার যে অ্যাডাম স্মিথ ঔপনিবেশিকতার তীব্র বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তার বিরোধিতা নট মানবিকতা বা অধিকারের প্রশ্নে, নিতান্তই অর্থনীতির প্রশ্নে। তিনি ইরশাদ করতাছেন, ঔপনিবেশিকের জন্যে কলোনিসিস্টেম লাভজনক নয়। দীর্ঘমেয়াদে যে দেশগুলো দখলদার হবে না তারা বরং অন্যদের থেইকা ইকোনমিকালি অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। উপনিবেশের সাথে ইউরোপের ব্যবসারে দুইভাবে দেখছেন স্মিথ। প্রথমটা শুধু ব্যবসার রিলেশান যাতে ইউরোপীয়রা লাভ করছে। একচেটিয়া বাণিজ্য। যা ঔপনিবেশিকের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, স্মিথের মতে, ঔপনিবেশিকেরা একে অপরের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই একচেটিয়া বাণিজ্যের সুবিধাটুকু হারায়া ফেলে। ইংল্যন্ডের পক্ষে তুলা আনা সহজ বইলা ইংল্যান্ড টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে বেশী দাম চাইতে যেমনি পারে, তেমনি ইন্দোনেশিয়ার মালিক ডাচেরা মশলার জন্য বেশী দাম চাইবে। উভয়ের কারও সকল সম্পত্তির ওপর যেহেতু অধিকার নাই, তাই স্থানীয় ভোগের ক্ষেত্রে ছাড়া ইউরোপে রপ্তানির ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান মোটের উপ্রে শূন্যে দাঁড়ায়ে যায়।

তাছাড়া একচেটিয়া বাণিজ্যে সাম্রাজ্য বজায়ে সামরিকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করবার হয়, সেই খরচা একচেটিয়া বাণিজ্য থেইকা আসা লাভের তুলনায় অনেক বেশী। ১৭৩৯ সনে শুরু হওয়া ইঙ্গ-স্প্যানিশ যুদ্ধের উদাহরণ টাইনা স্মিথ বলতাছেন, এইটা যেন গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া দুইদল দস্যুর লড়াই! লড়াই শেষে উভয়েই ভাগ-বাঁটোয়ারায় সম্মত হল বটে, কিন্তু ততক্ষণে তাদের অনেক শক্তিক্ষয় হইয়া গেছে!

এইছাড়াও উপনিবেশগুলা চিরকাল ঔপনিবেশিক শাসন মাইনা নেবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নাই। তাদের স্বাধীনতা ঘোষণার লগে লগেই ঔপনিবেশিকদের যুদ্ধে জড়ায়ে পড়তে হবে। তাইলে কহেন, এই বাড়তি সামরিক শক্তি ও সাম্রাজ্য বজায় রাখতে যে ওয়েলথ (টাকা আর সেনা) ব্যবহার হইতাছে সেসব অন্য কোন অধিকতর উৎপাদনশীল খাতে (ম্যানুফ্যাকচারিং) বিনিয়োগ করবার পারত না? তাইলে এইযে বাজেট এইগুলাতে লাভ কার? পুঁজির, ব্যবসার কিম্বা মুকেশ আম্বানীদের। কিছু বিজনেসম্যানদের সরকার চালায় দেশের অন্যান্য শ্রেণীর মানুশদের সমান সুযোগ থেইকা বঞ্চিত কইরা।

আরেক্টা সমস্যা হইলো, বাই স্মিথ, শিফট অব ক্যাপিটাল। মূলধনের সইরা যাওয়ানি। ঔপনিবেশিকের ঘরোয়া বাজারের মূলধন ইউরোপীয় বাণিজ্য থেইকা সইরা কলোনী বাণিজ্যে চলে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশকে ইউরোপীয় বাণিজ্যে দুর্বল কইরা দেবে। তাঁর এক্টা পর্যবেক্ষণ হইলো, ইউরোপে নৌশক্তি ও ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে আগায়া ছিল স্পেন আর পর্তুগাল। সেইমত তারাই প্রথম কলোনী-বাণিজ্যে নামে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকাকে কলোনী বানাবার পরে এই দুই দেশের বাণিজ্য এদের উপনিবেশের পথ ধরে মূলত কৃষিভিত্তিক হইয়া পড়ে। তাই ধীরে ধীরে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প মারা খায় ও নৌশক্তি হইয়া যায় দুর্বল। অন্যদিকে গরিব ডেনমার্ক (তৎকালীন ডেনমার্ক ও নরওয়ে) বা সুইডেন (বর্তমানের সুইডেন ও ফিনল্যান্ড) যাদের অর্থনীতি বাকিদের তুলনায় দুর্বল বা জার্মানী, যার নৌশক্তি সীমিত, তারা তাদের মূলধনের সর্বোত্তম ব্যবহারে ইউরোপমুখী বাণিজ্যে মনোযোগ দেয় ও কলোনি বাণিজ্য বিপন্ন হলে এরা ঔপনিবেশিকদের তুলনায় অনেক দ্রুত উন্নতি করে। ভবিষ্যতবাণী ফলে স্মিথের কথামত, তোড়া এদিক সেদিক হয়। সো, যারা উপনিবেশ-ব্যবসায় নামে নাই অথচ মুক্ত-বাণিজ্যে নাম লেখায়ছে তারা ঔপনিবেশিকদের থেইকা আরও তাড়াতাড়ি উন্নতি করছে!


ঔপনিবেশিকতার ক্ষতিকর দিকগুলার কথা বইলা স্মিথ কহেন, ইতিহাসে কোন দেশিই স্বেচ্ছায় 'সূচ্যাগ্র মেদিনী'ও ছাইড়া দেয় নাই, বরং বিপুলা ক্ষতি বা কষ্ট স্বীকার করছে! কারণ এই বিষয়টা দেশের ইগোর লগে জড়িত! নিজের অধীনস্থ অঞ্চলরে শাসনের মাধ্যমে মানুষের ভূয়া যে আত্মগৌরব জন্মে তার খোঁজেই ফাকিং সাম্রাজ্যবাদের পেছনে ছুটে দেশ, মোদি বা বিলাত।

সো, ব্রাদার্স আর সিস্টার্স! বুঝতাছেন কিনা যে, জনগণের সচেতন হওয়া ছাড়া নাই কোন উপায়। আমেরিকা ইরাকের যুদ্ধের কারণে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষে যা লোকসান করছে ইরাকের তেলের প্রতিটা বিন্দু বেইচা তা শোধ করা সম্ভব না। ভারত তার সেনাবাহিনী কাশ্মীরে মোতায়েন রাখতে যা খরচা করছে তা দিয়া ভারতের দারিদ্র্য হেসেখেলে ১০-১৫% কমায়ে দেয়া যায়। কিন্তু ওই যে, সচেতন জনগণ!

আরেকটা চান্সের কথা অবশ্য বলা যায়। সেক্ষেত্রে নাম নিতে হবে এক স্বাধীন দেশের। তখন তিমুর ছিল এক্টা দ্বীপের নাম। দুইটা তার অংশ- ওয়েস্ট তিমুর আর ইস্ট তিমুর। ওয়েস্ট তিমুরে ৯৫% খ্রিস্টান। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ডাচ কলোনি থেকে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হইয়া গেলে ওয়েস্ট তিমুর ইন্দোনেশিয়ার অংশ হয় মানুষ সেইটা মাইনা নেয়। কিন্তু ইস্ট তিমুরের ৯৫% খ্রিষ্টান কন্ট্রোল কলোনিয়াল পর্তুগীজরা ছাড়বার চায় নি। শেষে যখন ১৯৭৫ সালে পর্তুগাল ছাইড়া দেয় ইস্টতিমুরে তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়া আইন-শৃঙ্খলা ভাইঙ্গা পড়ে। যেহেতু ওয়েস্ট তিমুর ইন্দোনেশিয়ার অংশ তাই ইস্ট তিমুর ইন্দোনেশিয়ার অংশ হোক এই যুক্তিতে ইন্দোনেশিয়া ইস্ট তিমুর দখল কইরা নেয়। আর ইন্দোনেশিয়ার অংশ হিসাবে ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘ বারবরের মত প্রতিবাদ করে। ইস্ট তিমুরের মানুষ সেলফ-ডিটারমিনেশনের জন্য আন্দোলন করতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে দমনে যত ধরণের ব্রুটালিটি আছে তা প্রয়োগ করে। মুখে আমেরিকা, ইউকে, পশ্চিমা দেশ গুত গুত করলেও তেমন কোন কড়া প্রতিবাদ করে না। ইউকে বরং অস্ত্র দিয়া সাহায্য করতো সন্ত্রাস দমনে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত!

কাহিনী ছিল, ইন্দোনেশিয়া বিশাল দেশ। অনেক জনসংখ্যা। বিশাল মার্কেট। বিজনেস আর বিজনেস। তাই কোন দেশইই সম্পর্ক খারাপ করবার চাইতো না। এইভাবে ১৯৭৫ সাল থেইকা ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই নির্মম অত্যাচার যুলুম বহাল তবিয়তে ছিল। আর ইন্দোনশিয়ার মিডিয়া প্রচার করতো, সবি ঠিক আছে। আরে এইটা তিমুর, আছে না পশ্চিম তিমুর আমাদের সাথে, ইস্ট তিমুরের মানুষও আছে, সব পশ্চিমা মিডিয়ার প্রপাগান্ডা!

টনক নড়ে ১৯৯৭ সালে যখন ইন্দোনেশিয়া ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসে পড়লো! খেল খতম পানির মতন মুদ্রার দাম পড়তে লাগলো। আই,এম,এফ বেইল আউটে যেতেই সব মানবাধিকার সংস্থা এবং ওয়েস্টের দেশ পূর্ব তিমুর নিয়ে শক্ত অবস্থান নিলো। এইদিকে ইন্দোনেশিয়ায় স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয় এই সময়ে। নতুন সরকার গণভোটের ঘোষণা দিলো, কারণ ইস্ট তিমুরে দমন-নিপীড়ন চালাতে যে ব্যয় হয় সেইটাও অসম্ভব হতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৯৯ সালের গণভোটে ৭৮% মানুষ ইন্দোনেশিয়াকে রিজেক্ট করে স্বাধীন হয়। সো গাইজ, বুঝতাছেন যে, ১৯৯৭ সালে ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস না হলে এই স্বাধীনতা আসতো না। তাইলে, আপনেরা ভারতের ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসের জন্য ওয়েট করবার পারেন। কারণ, শোনা যাচ্ছে বর্তমানে ভারতের অর্থনীতি চরম নিম্নমুখীর দিকে ধাবিত হইতাছে। ফাঁপরবাজি দিয়া নির্মলা সীতারমণ বেশিদূর কি যাইবার পারবেন? ম্যাসিভ ইকোনমিক স্লোডাউনের এই কালে!

কাশ্মিরের কথা মনে হইলে সাহিদ কাপুরের 'হায়দার' ফিল্মের এক্টা সীনের কথা মনে পড়ে। রূহদার নামের ইরফান খান যখন রাস্তা দিয়া যাইতাছিলেন তখন এক মা তার পোলারে ঘরে ঢুকাইতে পারছিল না। রূহদার সমস্যাটার সলভ করে এইভাবে যে, সে পোলাটারে ইন্ডিয়ান আর্মির মতো চেক করে, পরিচয়পত্র ইতি আদি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে, তারপর ছাইড়া দেয়। আশ্চর্যের বিষয় সে ঠিকঠাক তখন ঘরে ঢুকে। মানে, পরিচালক কিঞ্চিত দেখাইছেন কাশ্মিরীদের ক্যামন আতঙ্কের উপর রাখা হয়! আরেক্টা ফিল্ম আছে চেন্নাই এক্সপ্রেস নামে যেখানের এক্টা গানে শাহরুখ আর দীপিকা নিজেরারে উত্তরের কাশ্মির আর দক্ষিণের কানাইয়াকুমারী বইলা পরিবেশন করছে। ইন্ডিয়ার মেবি একমাত্র শিল্প যেটাতে কাশ্মিররে পোলা কল্পনা করা হইছে! আপনেরা অরুন্ধতী রায়য়ের 'The Ministry of Utmost Happiness' পইড়া দেখবার পারেন। তিলোত্তমার প্রেমিক কাশ্মির-বিচ্ছিন্নতাবাদী বিপ্লবী মুসা। যে মুসা ছাত্রজীবনে নামাজহীন তারেই বিপ্লবীর বেশে নামাজ পড়তে দেখা যায়! স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষের রাষ্ট্রদ্রোহী। একদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলারত অবস্থায় গুলিতে মুসার বউ আর শিশুকন্যা জেবিনের মৃত্যু হয়। কিলার আমরিক সিংরে আমেরিকায় এসাইলামরত অবস্থায় পাইয়া সে মনে করায়ে দেয় খালি যে, সে কী কইরাছে তার এক জীবনে সভ্যতার বিরুদ্ধে! সে যেন শুধু ভুইলা না যায় এই ট্রাজেডির ইতিহাস। এটাই আমরিককে সেলফ-ডেস্ট্রাকটিভ কইরা তোলে। মুসা বলতাছেন, One day Kashmir will make India self destructive in the same way.' মানে, রাষ্ট্র যেন ভুইলা না যায় সে কী করছিল নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে!

স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরের পক্ষ থেইকাও কিছু চোখা ঘাঠতি নজরে পড়ে। প্র-ইন্ডিপেন্ডেট সেক্যুলার নেতা তৈরী করবার পারে নাই তারা, গ্রহণযোগ্য রিসোর্সফুল একাডেমিশিয়ান নাই, গ্লোবাল সেক্যুলার ভয়েজও নাই যারা ওয়েস্টের এলিটদের লগে কানেকশন করবার পারতো। তবুও ঝিলামের দেশে আফজাল গুরুদের তীব্র স্বাধীনতাকামী দীল তো আছে!

#কাশ্মির
#এডাম_স্মিথ
#পূর্ব_তিমুর
#অরুন্ধতী_রায়
#আফজাল_গুরু


সংগৃহিত...

পঠিত : ৭৩৫ বার

মন্তব্য: ০