Alapon

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ কী?

রোহিঙ্গারা যেন এক জন্ম-জন্মান্তরের ক্রীতদাস, নিষ্ঠুর ব্যাধের শিকার এক নীড়হারা পাখি। এই রাষ্ট্রহারা, নীড়হারা, সম্ভ্রমহারা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মানবগোষ্ঠীকে পরম মমতায় এ দেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা জাতিও কৃতজ্ঞ। রোহিঙ্গা জাতির জন্য যথার্থ করণীয় হলো, সম্মানে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে নিজের বাসভূমিতে ও বসতভিটায় মানবিক মর্যাদা নিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়া। এতদিন আমরা নাকি জানতে পারিনি, ‘রোহিঙ্গারা এত অপরাধী, এত সমস্যার জন্মদাতা।’ কিন্তু ২২ আগস্টের পর থেকে উগ্রপন্থী একটি শক্তি রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচার প্রপাগান্ডায় এই কথাটি বলতে চাইছে যে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছে বাংলাদেশ সরকার।

ঘাড় ধরে এদের এ দেশ থেকে বের করে দিতে হবে- তারা যেখানে ইচ্ছা মরুক, এ দেশে তাদের এক দিনের জন্যও আর ঠাঁই হবে না। এসব ‘বুদ্ধিজীবী’, অতি শিক্ষিত মানুষের প্রচারের সার কথা হলো, রোহিঙ্গা নামের ‘অমানুষ জানোয়ার’দের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে এরাব ফড়ম ধ নধফ হধসব ধহফ ঃযবহ শরষষ যরস. একইভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশবাসী ও সরকারকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সর্বত্রই রোহিঙ্গাবিরোধী প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। হয়তো এই প্রপাগান্ডায় ইন্ধন দিচ্ছে মিয়ানমার এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আর তাদের এদেশীয় মিত্ররা।

একজন বিরোধী নেতা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে বললেন যে, মনে হলো ১০ লাখ রোহিঙ্গা তার ঘাড়ের ওপর বসে আছে। ফলে তিনি নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না। তাই তিনি এদের থেকে মুক্তি চান যেকোনো মূল্যে। আসলে এই নিপীড়িত মানুষদের স্বার্থ, তাদের কল্যাণ ও মুক্তির কথা কেউ ভাবছে না।

‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের অবস্থান পরিষ্কার। কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব জয়শঙ্কর বাংলাদেশে এসেও তার বক্তৃতায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন, প্রত্যাবাসন হবে মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে। মিয়ানমারের ‘জাতীয় স্বার্থ’ হলো ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিয়ে বন্দিশিবিরে আটক রাখা। এ ধরনের প্রত্যাবাসনে ভারত ও চীনের সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশ ও তার জনগণও কি এমন অমানবিক প্রত্যাবাসনে সম্মত?

কেন ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন নাটক মঞ্চস্থ করল মিয়ানমার। যদিও সে জানত, কোনো রোহিঙ্গা নাগরিক তাদের বিশ্বাস করে স্বদেশে ফিরবে না। জাতিসঙ্ঘ এবং আইসিসির খড়গ থেকে বাঁচার জন্যই মিয়ানমার প্রধানত চীনের মদদে আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতার সুযোগে নাটকটি মঞ্চায়ন করেছে। মানুষ ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম।’ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের কূটচাল বোঝা সত্ত্বেও তিনি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ায় অসহায় ও দুর্বল রোহিঙ্গাদের ধমক দিলেন, তাদের প্রতি ‘কঠোর’ হবেন বলে হুমকি দিলেন। কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কিছু বললেন না। চীন ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাকাণ্ডের আগে কখনো বংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

সে তার দেশের জিনজিয়াং অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নানাভাবে চরম নির্যাতন করে যাচ্ছে। চীন যেকোনো মূল্যে নিজের একই নৃগোষ্ঠীর অধিবাস মিয়ামনামারকে সাহায্য করবে। তার শত অপকর্মকে সে সমর্থন করবেই। প্রস্তাবিত বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্র দফতরের সম্মিলিত ব্যবস্থা মিয়ানমার বা বার্মাকে রক্ষা করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে চীন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেনেশুনেও কি মিয়ানমারের ফাঁদে পা রাখবে? তাহলে এটা কার স্বার্থ উদ্ধার করবে? সর্বহারা রোহিঙ্গাদের কোনো উপকার তাতে হবে বলে মনে হয় না।

২৫ আগস্ট গণহত্যা দিবসে রোহিঙ্গা সমাবেশ : একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক রোহিঙ্গাদের ‘গণহত্যা দিবসে’ তাদের সমাবেশ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। এমনকি সরকারকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন। প্রকৃত বিষয় হলো ওই সমাবেশের ঘটনাটি মোটের ওপর ইতিবাচক। ‘সুষ্ঠুভাবে সমাবেশটি শেষ হওয়ায় আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাপক প্রশংসার দাবিদার। এই গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে নির্যাতিত মানুষগুলো একদিনের জন্য হলেও মানুষের মর্যাদা পেয়েছে। তারা তাদের জরুরি বক্তব্য বাংলাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। তারা অবশ্যই স্বদেশে ফিরতে চায়- এ কথাটি তারা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে। শত নির্যাতন সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহ দেখিয়েছেন- এটা কি কম বড় উদারতা?

অশিক্ষিত হলেও তারা যে ধার্মিক ও সুশৃঙ্খল, সমাবেশে এর প্রমাণ তারা রেখেছে। এত মানুষের বিশাল সমাবেশ, কিন্তু কোথাও বিশৃঙ্খলা হয়নি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেদিন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সমাবেশ সফল করতে যারা সাহায্য করেছেন তারা সবাই প্রশংসারপাত্র। রোহিঙ্গাদের নারী নেত্রী বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এই সমাবেশ বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা উভয়ের উদ্দেশ্যকেই সমর্থন করেছে।

সমাধান কোন পথে : আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ মানুষের ভেতর ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ যদি পথভ্রষ্ট হয় এবং অধর্মের পথে চলে সেজন্য তাদের গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন হতে দেয়া যায় না। রোহিঙ্গা একটি ভাষাভিত্তিক (বাঙালিদের মতো) জাতি। এদের রয়েছে মিশ্র উপাদান- ভারতীয়, আবর ও বাঙালি বংশোদ্ভূত তারা। তাদের প্রতি বাঙালি-বাংলাদেশীদের অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে। করণীয়- চীনকে স্পষ্ট করে বলা দরকার সে যেন জাতিসঙ্ঘে ভেটো দেয়া থেকে বিরত থাকে, নতুবা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের সব ধরনের সাহায্য নেয়া হবে বলে চীনকে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও জানিয়ে দেয়া। চীন ও মিয়ানমারবিরোধী পশ্চিমা শক্তি ও জাতিসঙ্ঘের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কাজে সাহায্য করা। তুরস্ক সফরে গিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বলেছেন- ‘মিয়ানমারের উচিত তাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে আরাকানে পুনর্বাসিত করা। তা তারা দিতে না চাইলে তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য একটি এলাকা ছেড়ে দেয়া, যেখানে তারা নিজেদের রাজ্য গড়ে নিতে পারে। বাঙালিরা সব অত্যাচার সহ্য করে শেষ পর্যন্ত পেয়েছে বাংলাদেশ। তেমনি সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে ব্যবস্থাতে মিয়ানমারকেই রাজি হতে হবে। কারণ এ সমস্যা তারাই সৃষ্টি করেছে।

পঠিত : ৭৮০ বার

মন্তব্য: ০