Alapon

ইতিহাসের এক অজ্ঞাত হিরো মালিক তৈমুর...

কোকন্দ, বিশাল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় একটি মনোরম শহর। শির দরিয়ার তীরবর্তী শহরটা ছিল তৎকালীন বিশ্বের সৌন্দর্য পিয়াসিদের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত নগরী। ওখানকার প্রতিটি উপত্যকায় ছিল সবুজের সমারোহ। উঁচু উঁচু গাছপালায় ছায়া সুনিবিড় উপত্যকাগুলো যেন ছিল এক একটি জান্নাতের টুকরো। দিগন্ত বিস্তৃত দেখা যেত আঙুর, খরবোজা ও তরমুজের খেত। ছোট ছোট সবুজ দ্বীপের মতো প্রতিটি গ্রামে দেখা যেতে মসজিদের সুউচ্চ সফেদ মিনার। পাহাড়ের পাদদেশে নির্ভয়ে চড়ে বেড়াতে দেখা যেত পালবাধা অসংখ্য ভেড়া বকরি। পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলা ঝর্নাগুলো আল্লাহর গুনগান গেয়ে গেয়ে মিলিত হতো শিরদরিয়ার স্রোতে। নদী তীরের সুউচ্চ পাহাড়ের জমাট বরফের উপর সৌরালোকের প্রতিবিম্ভ নদীর সৌন্দর্যকে করে তুলতো অবর্ণনীয় মোহময়।


কোকন্দের শাসক মালিক তৈমুর তাঁর শৌর্য, উত্তম চরিত্র, ন্যায় বিচার সর্বোপরি উত্তম ব্যবহারের দরুন ছিলেন জনগণের নয়নমণি। তাঁর বীরত্বকে তুলনা করা জগৎজয়ী বীর পুরুষদের সাথে। তুর্কদের বাহাদুরির সব গুণের সমাহার ঘটেছিল তার সত্তায়। পামিরের রাস্তায় সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ খাওয়ারিজমশাহর বাহিনী তাতারদের মোকাবেলায় পরাজিত হয়ে শির দরিয়া পাড়ি দিয়ে চলে আসলে দূরদর্শি মালিক তৈমুর অনুধাবন করতে পারেন তাতার ঝড়ের পরবর্তী টার্গেট হতে চলছেন তিনি এবং তাঁর প্রিয় কোকন্দ। সুতরাং সময়ের অপচয় না করে তিনি শুরু করে দেন কোকন্দের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি। অল্প দিনের ভেতরেই একদিন দেখা যায় কোকন্দের পাশে এসে শিবির স্থাপন করেছে পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি তাতার বাহিনী। আসলে এরা ছিল অগ্রবর্তী বাহনী, মূল বাহিনী ছিল জুজি দুতোমানের নেতৃত্বে। সে এগিয়ে আসছিল ২০ হাজার সৈন্যের একটি শক্তিধর বাহিনী নিয়ে। মালিক তৈমুরের ছিল মাত্র ১ হাজার সৈন্যের একটি ছোট্ট বাহিনী। বিপদ আঁচ করতে পেরেই তিনি সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাতের আধারে কোকন্দের পাশে নদীর প্রশস্ত জায়গায় দ্বীপের মতো জেগে ওঠা ভূখণ্ডের অত্যন্ত সুদৃঢ় দুর্গে চলে যান। নদীর এ পারে যতগুলো কিশতি ছিল একটিও রেখে যাননি সবগুলো নিয়ে যান সাথে করে।
সকাল হলে তাতাররা যখন ব্যপারটা অনুধাবন করতে পারে তখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দুর্গ লক্ষে তির ছুঁড়তে থাকতে থাকে। কিন্তু এ ছিল অনর্থক অস্ত্র বিনষ্টের মহড়া। কারণ দুর্গটি ছিল তাদের তিরের রেঞ্জের অনেক বাইরে। অগ্রবর্তী বাহিনীর ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যেই জুজি তার মূল বাহিনী নিয়ে আসে। সে এসেই নদীর তীরে মিনজানিক মোতায়েন করে দুর্গ লক্ষ করে গোলা ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু দূরত্বের কারণে গোলাগুলো নদীর পানিতে ঝপাত ঝপাত শব্দ তুলা ছাড়া দুর্গ প্রাচীরের কোনো ক্ষতি করতে পারছিল না।


জুজি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছিল কী করা যায়, কী ভাবে দুর্গটির পতন ঘটানো যায়। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে প্রায়-অসম্ভব অদ্ভুত একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার বাহিনীর সাথে ছিল বিপুল সংখ্যক কয়েদি। ওদেরকে পাহাড় থেকে পাথর এনে নদীতে বাধ নির্মাণের নির্দেশ দেয়। সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গীনের খোঁচায় বন্দিরা সাধ্যতীত ওজনের পাথর এনে নদীতে ছুঁড়তে শুরু করে। কয়েক দিনের প্রচেষ্টার পর খরস্রোতা শির দরিয়ার কিনারে একচিলতে পাথরের পথ জেগে ওঠে। তৈমুর মালিক তাঁর দুর্গের শীর্ষে বসে জুজির এ প্রয়াস লক্ষ করে চলছিলেন। তিনিও ভেবে চলছিলেন কীভাবে তাতার বাহিনীকে এ থেকে বিরত রাখা যায়।


এক পর্যায়ে মালিক তৈমুর তাঁর নৌকাগুলোর পাশে শক্ত কাঠ তুলে দিয়ে মাঝে মাঝে ফাঁক রেখে একদল সৈন্যসহ বাধ নির্মাণকারী সৈন্যদের দিকে পাঠিয়ে দেন। জুজির বাহিনী বৃষ্টির মতো তাদের লক্ষে তীর ছুঁড়ছিল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর কোনোই ক্ষতি করতে পারছিল না। অধিকন্তু কাঠের ফাঁক দিয়ে মুসলিম বাহিনীর ছুড়া একটা তিরও ব্যর্থ হচ্ছিল না। নদীর তিরে তাতার বাহিনীর লাশের স্তুপ গড়ে উঠেছিল। উপায়ান্তর না দেখে তারা নদীর তীর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে কয়েক দিনের লড়াইয়ে বিপুলসংখ্যক তাতার মারা গেলেও তারা একজন মুসলমানের গায়েও আঁচড় লাগাতে পারেনি।
অব্যাহত ক্ষতি জুজিকে আরও জেদি বানিয়ে তুলেছিল। তাছাড়া চেঙ্গিসখানের নির্দেশ ছিল পথে যে দুর্গ বা শহর পড়বে তা ধ্বংস না করে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না।


জুজি তখন অনেক ভেবে চিন্তে নতুন একটি উপায় বের করে। পরদিন মালিক তৈমুরের বাহিনী নৌকা নিয়ে এগিয়ে এলে আচমকা নৌকাগুলোতে আগুনে গোলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ফলে নৌকাগুলোতে আগুন ধরে যায়। বেশ ক'জন মুজাহিদও শাহাদত বরণ করেন। দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় এই প্রথম তারা মুসলিম বাহিনীর কিছুটা ক্ষতি করতে সমর্থ হয়। কিন্তু মালিক তৈমুর হতাশ হননি। তিনি পরদিন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি নৌকাগুলোর পাশের কাঠে আগুন প্রতিরোধি মাঠির পুরো একটা স্তর লাগিয়ে আবার বাধ নির্মাণকারী সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং তাদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ তিন মাস ধরে প্রতিরোধ চলতে থাকে। তাতার বাহিনী ইতোপূর্বে কখনো এতো দীর্ঘ প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। মাত্র ১ হাজার সৈন্যের ছোট্ট একটা বাহিনী যে তাদেরকে এমনভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াবে তা তাদের কল্পনায়ও ছিল না। কিন্তু তারা পরাজয় স্বীকারের পক্ষে ছিল না। এক তৃতীয়াংশ সেনা খোয়ানোর পরও তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। ফলে নদীতে সরু রাস্তাটি বেশ কিছু লম্বা হয়ে ওঠে।
ওদিকে দুর্গে মজুদ পানাহার সামগ্রী ফুরিয়ে আসায় মালিক তৈমুর দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। জুজিও বিরক্ত হয়ে ওঠিছিল সে জনৈক সেনাপতির জিম্মায় অর্ধেক সৈন্য রেখে বাকি অর্ধেক সৈন্য নিয়ে নদির ভাটি অঞ্চলের দিকে চলে যায়। তৈমুর যে উদ্দেশ্য নিয়ে এদের প্রতিরোধ করে চলছিলেন তাঁর ধারণা মতে এতদিনে সেটা পূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি ভাবছিলেন এদেরকে এখানে আটকে রাখতে পারলে আশা করা যায় খাওয়ারিজমশাহর মোকাবিলায় যে বাহিনী আছে তাদের উপর তিনি জয়ী হতে পারবেন। সুতরাং তিনি ওখান থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এক রাতে তিনি প্রায় সত্তরটি নৌকায় বহরে তাঁর ছোট্ট বাহিনীকে নিয়ে স্রোতের অনুকূলে নৌকা ভাসিয়ে দেন। তাতারদের প্রহরীদল ছিল অত্যন্ত চৌকস। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারার সাথে সাথেই তাদের সেনাপতিকে অবহিত করে। তাতার সেনাপতিও তৎক্ষণাৎ তাদের সমান্তরালে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মালিক তৈমুরের বাহিনীকে অনুসরণ করতে থাকে। তাতাররা নৌকার বহর লক্ষ করে অবিরাম তির ছুঁড়ছিল, কিন্তু প্রতিরোধব্যবস্থা থাকায় মালিক তৈমুরের বাহিনীর কোনোই ক্ষতি করতে পারছিল না। অধিকন্তু মুসলিম বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাতে পথে পথে তাদের অনেক লাশ পড়ছিল।


বানাকতের পার্শ্ববর্তী উপকুলে আসার আগেই তাতার বাহিনী ওখানে থাকা তাদের একটি সেনাদলকে নদীতে প্রতিবন্ধক গড়ে তুলার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ওরা একটি লৌহ শিকলের প্রতিবন্ধক গড়ে তুলে। কিন্তু মালিক তৈমুরের শৌর্যের মুখে ওদের এই প্রতিবন্ধক ঠেকনি। তিনি বাধা মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে চলেন।


তাতাররা তখন আগেই ভাটির দিকে যাওয়া তাদের সেনাপতির কাছে মালিক তৈমুরের আগমন বার্তা প্রেরণ করে। বার্তা পেয়ে জুজি নদিতে দুই স্তরের নৌকার প্রতিবন্ধক গড়ে তুলে। প্রতিটি নৌকায় ছিল দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ। কিন্তু মালিক তৈমুর তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে বিপদটা আঁচ করতে পেরে এক রাতে নৌকার বহর নদীর ওপারে লাগিয়ে তার বাহিনীকে সামনের পাহাড়ি ভূমির দিকে পালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে শুন্য নৌকাগুলো শিরদরিয়ার স্রোতে ভাসিয়ে দেন। তাতার বাহিনী নৌকা গুলো অনুসরণ করে চলছিল বেলা অনেকটা গড়ানোর পর যখন তারা ধোঁকা খেয়ে গেছে বলে অনুমান করতে পারে তখন নৌকাগুলো দখল করে ওপারে এসে মালিক তৈমুরের বাহিনীকে ধাওয়া করে। কিন্তু ততক্ষণে মালিক তৈমুরের বাহিনী পাহাড়ের নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। মালিক তৈমুর জানতেন বেশিক্ষণ ওদের ধোঁকার মধ্যে রাখা যাবে না। যখন ভুল ভেঙে যাবে তখন অবশ্যই ওরা ধাওয়া করবে। তাই মূল বাহিনীর নিরাপত্তার লক্ষে ধাওয়াকারী বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য তিনি ছোট্ট একটি দল নিয়ে পেছনে থেকে যান। ধাওয়াকারী বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। মালিক তৈমুরের দুঃসাহসী ওই ছোট্ট দলটি অসংখ্য শত্রুকে ভূপাতিত করে সবাই একে একে শাহাদত বরণ করেন। থেকে যান একা মালিক তৈমুর। তিনি প্রবল বিক্রমে শত্রুদের প্রতিহত করে পাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিন একা, তাঁকে ধাওয়াকারীদের সংখ্যা তিনজন। আর তাঁর কাছে ছিল মাত্র তিনটি তির। তিনি একটি তির দিয়ে এক শত্রুর চোখ লক্ষভেদ করে বাকি দুজনকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলেন, দেখো আমার লক্ষ ব্যর্থ হয় না। আমার কাছে রয়েছে মাত্র দুটি তির। কিন্তু তোমাদের দুজনের লাশ অপেক্ষা তির দুটি আমার কাছে প্রিয়। আমি চাই না তোমরা দুজন লাশ হয়ে ওখানে পড়ে থাকো। অতএব সিদ্ধান্ত তোমরাই নাও। তার কথা শুনে ওরা পেছনের দিকে চলে যায় আর তিনিও তার বাহিনীর খুঁজে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন।

কোকন্দ, বর্তমান তাজিকিস্তানের একটি শহর।



লিখেছেন: আব্দুর রশীদ তারপাশি

পঠিত : ১২১০ বার

মন্তব্য: ০