Alapon

মানবসেবায় প্রস্তুত ছাত্রলীগ, আপনিও সেবা গ্রহণ করুন

পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স ডাকার জন্য নির্দিষ্ট নম্বর থাকে। ছাত্রলীগ ডাকার জন্য তেমন একটা নম্বর থাকা দরকার। যার প্রয়োজন তিনি ঐ নির্দিষ্ট নম্বরে ডায়াল করবেন, প্যা পো প্যা পো সাইরেন বাজিয়ে চলে আসবে ছাত্রলীগের ছেলেদের বহন করা গাড়ি। এরপর তারা যে যে কাজ খুব সহজে করে দিয়ে চলে যেতে পারবে সেসব হচ্ছে-

শূন্য. ভর্তি পরীক্ষা ও ভাইবা না দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান? ভর্তি হবার পরে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ডাকসু বা হল সংসদের নেতা হতে চান? তাহলে ছাত্রলীগ ডাকুন। তারা আপনাকে বিনা পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী পঞ্চাশের বেশি ছাত্র ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মূলতঃ ডাকসু নির্বাচন করার জন্য। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…..

এক. যাকে পেটানোর দরকার তার মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা বলে দিতে হবে। ছাত্রলীগের ছেলেরা তাকে পেটাতে পেটাতে বাসা বা অফিস থেকে নীচে নামিয়ে আনবে। সবাই দেখবে একজন পেটান খাচ্ছেন আর একদল পেটান দিচ্ছে। বিশ্বাস না হলে ছোট্ট করে এই খবরটা পড়ুন–

‘সাতক্ষীরার আশাশুনি কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে তার অফিস থেকে কিলঘুষি মারতে মারতে বাইরে এনে মাটিতে ফেলে দেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আশরাফুজ্জামান তাজ, আল মামুন, শাওনসহ সাত আটজন ছাত্রলীগ কর্মী। অধ্যক্ষের রুম ভাংচুর করে তারা। অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন- ‘ছাত্ররা সন্তানতুল্য। সেই ছাত্রদের হাতে তিনদফা লাঞ্চিত হলাম। ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই বেদনার এবং লজ্জার। ঘটনাটা আমি ইউএনও কে জানাই এবং মামলা করি।’ ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এবং পুলিশ আশরাফুজ্জামান তাজ ও আল মামুনকে গ্রেফতার করে। শেষমেষ অবশ্য ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়। শিক্ষক পেটানোর এমন ঘটনা সারাদেশে আরও অনেকবার ঘটিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নীলফামারির ডুমার সরকারি কলেজ, পাবনার বুলবুল কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএম কলেজেও এমন ঘটনা আছে।

দুই. ধরুন আপনি আক্রান্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগকে ডাকতে পারেন। তারা এসে আপনার জন্য কাজ করবে, আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে কিংবা আপনাকে ‘সেইফ’ রাখবে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি। ঢাকার সাতটি কলেজের অধিভুক্তি আন্দোলনে ছাত্ররা তার বাসভবন ঘেরাও করলে তিনি নাকি ডেকেছিলেন ছাত্রলীগ কর্মীদের। এরপরের ঘটনা সবার জানা। ছাত্রলীগের বীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের মোটামুটি ফ্লাইংকিক মেরে কাবু করে ফেলে। অবশ্য ভিসি উদ্ধার নাটকের ঘটনার মূলে যে সাতটি কলেজের অধিভূক্তির আন্দোলন, সেটি ছাত্রলীগের ইন্ধনেই একদা চলে এসেছিল ক্যাম্পাসে। সাত পাঁচ না ভেবে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের একটি গ্রুপ ছাত্রলীগের কয়েকজনকে  উস্কে দিয়েছিলেন। পরে সরকারের মনোভাব বুঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পিছুটান দিয়েছেন, ছাত্রলীগের যারা আন্দোলনরত ছাত্রদের সমর্থন দিয়েছিলেন তারাও পিছুটান দিয়েছেন। ভিসিকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে আবার সেই ছাত্রলীগ। বিএনপি আমলে আনোয়ারউল্লাহ বা ফায়েজ সাহেব ভিসি থাকার সময়েও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

তিন. ধরুন আপনি ভাব দেখাবেন। আপনার কার্যকলাপে বুঝিয়ে দিতে চাইবেন যে আপনি বিশাল হনু।কাউরে গোনার টাইম আপনার নাই। ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট শোভন ও জিএস রাব্বানীকে ডাকুন। দেখবেন ভাব কাকে বলে তারা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। ছোট্ট আরেকটা খবর পড়ুন কষ্ট করে–

‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে ব্রিবতকর অবস্থায় পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাওনুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী আগে থেকে অবহিত করেননি যে তাদের দেরি হবে। রেওয়াজ অনুসারে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানানোর কথা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এবং তাদের ছাড়া সম্মেলন শুরু করাও সম্ভব ছিল না। বিব্রতকর অবস্থা এড়াতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভিসি মিজানুর রহমানের রুমে গিয়ে বসেন এবং তাকে সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন– আমি তো অনেক আগেই এসেছিলাম ক্যাম্পাসে। শোভন ও রাব্বানী আসতে দেরি করেছে। আমি আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না’। (ঘটনা ২০ জুলাই ২০১৯ এর)

শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনিকেও এমন ‘ভাব ট্রিটমেন্ট’ দিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আপনি ভাব নিতে চাইলে তাদের দুজনকে ডেকে ভাব শিক্ষা নিতে পারেন।

চার. সাংবাদিকদের জোর করে গাড়িতে তুলে নিতে চান? খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তৈরি ভিডিও ডিলিট করে তারপর গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চান? ছাত্রলীগ ডাকুন। তারা অভিনব উপায়ে সাহায্য করবে। এবারও কষ্ট করে খবরটা পড়ুন-

‘ছাত্রলীগ সভাপতি শোভনের গাড়িতে ওঠা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বেধে গেলে কয়েকজন আহত হন। ইমন এই সংঘর্ষের দৃশ্য ভিডিও করেছিলেন। একটি পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ইমন অভিযোগ করেন ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে নেন এবং তার করা ভিডিও ডিলিট করতে বাধ্য করেন। এরপর তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। যদিও শোভনের ভাষ্য একটু অন্যরকম- দুই তিনহাজার ছেলেপেলে জমা হয়েছিল। তারা ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং টানাহেঁচড়া করছিল। এত ছেলেদের ভীড়ে ওর যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্যই গাড়িতে তুলে নিয়েছিলাম।’ (ঘটনাটা ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর)

এরকম অসংখ্য কাজে আপনি ছাত্রলীগকে ডাকতে পারেন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রেমিকাকে কোপাবেন? ছাত্রলীগ ডাকুন। ধর্ষণ, খুন, টেন্ডারবাজি, প্রশ্নপত্র ফাঁস সব কিছুতেই ডাকতে পারেন ছাত্রলীগকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকে একসময়ে গুজব বলে প্রচার করেছিল আওয়ামী সরকার ও ছাত্রলীগ, পরে ছাত্রলীগ কর্মীরাই গ্রেফতার হয়েছে, সংগঠন থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছে। এসব কারণে একটা কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে। কৌতুকটা এমন– বেগম খালেদার জিয়া নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের খুঁজছেন! দেখা হলে নাকি জানতে চাইবেন– এতোদিন কোথায় ছিলেন? ২০১৪ সালের শুরুতে সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল এবং এগারোটি  ট্রাক দিয়ে তখন খালেদা জিয়ার গুলশান অফিস ঘিরে রাখা হয়েছিল। তাঁর বিশ্বাস ছাত্রলীগের ছেলেদের সন্ধান পেলে তিনি তাদের ডাকতেন এবং তারা তাঁকে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে আনতে পারতো, যেমন করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের ছেলেরা উদ্ধার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে!!

এবার ছাত্রলীগ সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা যা সবাই জানে-

এক.  আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগ বেপোরোয়া হয়ে ওঠে আর দল ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে হাওয়া হয়ে যায় তারা। ক্ষমতার কারণেই তারা বীরপুরুষ। আসলে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভ এদেশের অনেক রাজনীতিবিদদের চরিত্র নষ্ট করেছে আগেই। গত বিশ বছরে তাই বড়দের পথ ধরে হাঁটছে ছোটরাও। স্যালুট টু হুমায়ুন আজাদ। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে!

দুই. ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল নিয়ে একইরকম মূল্যায়ন আছে। কে ভালো আর কে খারাপ তা বলা খুবই কঠিন। গত দশ বছর ছাত্রলীগের দাপট দেখা যাচ্ছে বলে ছাত্রলীগ নিয়ে কিছু আদিখ্যেতাও দেখা যায়। সেসব এমন–

তিন. ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করে না। তারা স্বাধীনতার চেতনায় বলীয়ান একটা সংগঠন। যারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করে তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়! তারা অনুপ্রবেশকারী, বহিরাগত, বিএনপির দালাল!!

চার. ছাত্রলীগ নিয়ে অতি রোমান্টিক কেউ কেউ এবং পুরোনো নেতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন আমরা দুঃখিত! হায় ছাত্রলীগের পক্ষে এমন কাজ করাও সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সব সাফল্য এদের জন্য ম্লান হয়ে যাবে!

পাঁচ. ছাত্রদলের একই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিবরণ দিয়ে কেউ কেউ ছাত্রলীগের কার্যকলাপকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন!!

ছয়. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদা বলেছিলেন বিরোধী দলকে শায়েস্তার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাদের হাতে বই খাতাও তুলে দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে সেই তিনিই আবার ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৯ সালে তিনি ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙ্গে দিতে বলেছেন। একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়– গত নয় বছরে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে ১৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর ভেতরে ৭৪ জন ছাত্রলীগের কর্মী। ছাত্রলীগের হাতে শিশু, অন্য সংগঠনের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন ৫৭ জন। গত নয় বছরে খুনোখুনি, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষক লাঞ্চনা, ভর্তি বাণিজ্য, সাংবাদিক ও পুলিশের উপর হামলাসহ আরো অনেক অপকর্মে বার বার ছাত্রলীগকে অভিযুক্ত করে খবর ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। এ পর্যন্ত সংগঠন থেকে ৭৪৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কয়জনের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকে সেটা নিয়ে খোঁদ ছাত্রলীগেই সন্দেহ এবং সমালোচনা আছে। অবৈধ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দায়ে কোনো ছাত্রলীগ কর্মী যদি সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন তখন কেউ কেউ বলেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। বাস্তবে এটা হয় না। বিশ্বজিৎসহ ১১টি হত্যা মামলার আসামীদের ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে যা ছবিসহ পত্রিকার পাতায় এসেছে। ২০১৪ সালের ৪ জুন সিলেট ওসমানী মেডিকালের ছাত্রদল নেতা তাওহীদ খুন হন ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে। এ ব্যাপারে গ্রেফতার হন ছাত্রলীগ ওসমানী মেডিকাল শাখার সভাপতি সৌমেন দে, যিনি দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেন এবং তাকে মেডিকাল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বছরখানেক জেল খেটে তিনি বেরিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, সৌমেন ঐ মেডিকালের ইন্টার্ন চিকিৎসক হতে পারেন, পরে পুরোপুরি ডাক্তারও হয়ে যান। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত আবু বকরের হত্যাকারীদেরও কোনো শাস্তি হয়নি! ছাত্রলীগের যেসব কর্মীরা অভিযুক্ত ছিলেন তারা সুখে আছেন, চাকরি ও ব্যবসা করছেন!

পঠিত : ১৪৫২ বার

মন্তব্য: ০