Alapon

মিশর-ইসরায়েল-সৌদি আরব-আরব আমিরাত, মোহাম্মদ মোর্সির পতন, সিসির উত্থানঃ পর্ব ২


প্রথম পর্বে মিশরের আভ্যন্তরিন ব্যাপারে বাইরের প্রযোজক হিসাবে কেবল আমেরিকার নাম উল্লেখ করেছি। কারন লাটিমটা ধরা সেখানেই। কিন্তু সেই লাটিমের সুতায় মাঞ্জা মারা বাকি দেশগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইসরায়েল, আরব আমিরাত, এবং সৌদি আরব।

ইসরায়েলঃ মিশর ইসরায়েলের সম্পর্ক ৫০ দশক থেকেই ভালো। সেই সম্পর্কে আগুন লাগে মুসলিম ব্রাদার হুডের মোহাম্মদ মোর্সি ক্ষমতায় আসলে। যেহেতু ব্রাদারহুডের সাথে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরানের সম্পর্ক ভালো, আর ঐ অঞ্চলে মিশরের মিলিটারি সংখ্যায় সবচেয়ে বিশাল, দুই দেশের মাঝে কমন সীমানা আছে, যেই সীমান্তে অবস্থিত ফিলিস্তিনের হটবেড গাযা। তাই ইসরায়েল প্রমোদ গুনতে শুরু করে। অতএব, ইসরায়েল মোর্সি পতনের জন্য জোর লবিং আর প্ল্যানিং শুরু করে । সাথে থাকে ভাই ভাই কোম্পানি এমবিজেড এন্ড এমবিএস।

আরব আমিরাতঃ এরা কিছুতেই এই অঞ্চলের কোন দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে দিবে না। কারন তাতে সাধারন মানুষের ভয়েস আর দাবী দাওয়ার ভীত তৈরি হবে, যা যে কোন রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি। ক্ষমতায় যাওয়ার নির্ধারনি ক্ষমতা জনগনের হাতে থাকলে রাজতন্ত্র পড়বে হুমকিতে। অতএব, নিজেদের রাজত্ব ধরে রাখতে তারা এই অঞ্চলের সকল দেশের ডেমোক্রেটিক প্রসেসের বিরুদ্ধে গভীরভাবে কলকাঠি নাড়ে। শুরু করে এন্টাই মোর্সি ষড়যন্ত্র। ডেমোক্রেটিক্যালি ইলেক্টেড ব্রাদারহুডের মোর্সি মাস্ট ফল।

সৌদি আরবঃ হোসনি মোবারক সৌদিদের দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন, যিনি সাদ্দামের হাত থেকে কিংডমকে রক্ষার জন্য দুই ডিভিশান মিশরীয় সেনা পাঠিয়েছিলেন। তাই ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতনের সময় সৌদিরা হতবাক হয়ে পড়েছিল; আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা মোবারককে পদত্যাগ করার আহ্বান জানালে সৌদি রেজিম খুব ভয় পেয়ে যায়। সৌদিদের কাছে যা ছিল তাদের সাথে আমেরিকার বিশ্বাসঘাতকতা। আমিরাতের সাথে মোর্সি পতনের ষড়যন্ত্রে তারাও যোগ দেয়। তার উপর জেনারেল সিসি মিশরের আর্মি ইন্টালিজেন্স চীফ হওয়ার আগে সৌদিতে মিলিটারি এট্যাশে হিসাবে কার্যরত ছিলেন। হি ওয়াজ এ নোন ফিগ্যার ইন দ্যা কিংডম।

আঞ্চলিক দেশগুলোর মাঝে মোর্সির বিপক্ষে থাকে ইসরায়েল, আরব আমিরাত, আর সৌদি আরব; আর পক্ষে থাকে ইরান আর তুরস্ক। মোর্সি ২০১২ সালে ইরান সফর করলে সৌদি আরবের ভয় বহুগুনে বেড়ে যায়। মোর্সির ইরান সফর সৌদি আর আরব আমিরাতের পেটে গরম পানি ঢালে। মিশর যদি ইরান বলয়ে চলে আসে তাহলে তা হবে সৌদি-আমিরাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ইন ফ্যাক্ট চ্যালেঞ্জ অফ দ্যা সেঞ্চুরি। সো মোর্সি মাস্ট গো।

ভিতরে ভিতরে এন্টাই মোর্সি পাওয়ারগুলো পূর্ণ উদ্যমে মাঠে নেমে পড়ে। এদিকে সাধারন জনগনের অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন না হলে মিশরিয়রা ২০১৩ সালে ফের রাস্তায় নামে। উপরে দিয়ে জনগনের পক্ষে আছে দেখিয়ে সিসি সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে মোহাম্মদ মোর্সিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে প্রেরন করে। সৌদি আর আমিরাতের রাজপরিবার খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। এবার তারা আশা করে এই অভ্যুথানের মাধ্যমে আরব বসন্তের যা হাওয়া তা চিরদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে পড়বে, স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা চিরতরে বন্ধ হবে, আর অঞ্চলজুড়ে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

কিন্তু তা হওয়ার নয়। যদিও সিসি ক্ষমতায় বসে মুসলিম ব্রাদারহুডকে কেবল ব্যাক ফুটে নয় বরং জেল জুলুম এরেস্ট করে একেবারে ধ্বংসের দারগোড়ায় নিয়ে যায়। রাবা ম্যাসাকারে প্রায় ১ হাজার ব্রাদারহুড কর্মীকে সিসি নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। ব্রাদারহুড আন্ডার গ্রাউণ্ডে চলে যায়। প্রায় সব রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট এরেস্ট এড়াতে দেশ ছাড়ে।

কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে ব্লান্ডার করে সিসি সাধারন জনগনের রোষের মুখে পড়েন। যত ইনফ্রাস্ট্রাচার প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয় প্রায় সবগুলাই মিসরীয় আর্মি কন্ট্রোল করে পাহাড় সম অয়েলথ বানায় আর সিভিলিয়ান জব মার্কেট দিন কে দিন সঙ্কুচিত হতে থাকে। মিলিটারি বিশাল হোটেল আর সিসি নিজের জন্য প্যালেস বানিয়ে জনগনের সমালোচনার মুখে পড়েন। ইউথ কনফারেন্সে দর্শক সিসিকে ডাইরেক্ট চ্যালেঞ্জ করে বসে। “People are always comparing their own status and the status of the country and the lack of services and jobs with the lavish lifestyle that Sisi, his wife and family are living in”। এমইই

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যত অর্থনৈতিক অবস্থার রিপোর্ট বের হয় সবগুলোতেই উন্নয়নের জয়গান গাওয়া হয়। সাউড ফেমিলিয়ার ফেলো বাংলাদেশিস?

কিন্তু মিসরে আসলে তৈরি হয়েছে একটা বিরাট অর্থনৈতিক ডিসপ্যারিটি। উপরে এক দল, আর বাকি সব নীচে এক কাতারে। একেবারে নিম্নস্তরের মানুষ ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খাবার খায় এমন অবস্থা। মিশরের এডুকেশান, হেলথ সেক্টরের অবস্থাও নিম্নগামী। পুলিশ ব্রুটালিটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে জনগনের মাঝে আবার অসন্তোষের গুনগুন শুরু হয়। সিসির সমালচকদের একে একে এরেস্ট করে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। ভিতরে ভিতরে মানুষ আবারও অস্থির হয় পরে। যেই পলিটিক্যাল ফ্রিডম আর বাক স্বাধীনতার জন্য তারা আরব বসন্ত করেছিল, আজ তাদের স্বাধীনতা আরও কম।

যে ভাবে শুরু হলো গতকালের বিক্ষোভঃ

মোহাম্মদ আলি, বয়স ৪৩, রিয়েল স্টেট ডেভেলপার এবং অভিনেতা, নিজ নিরাপত্তার জন্য পরিবার সহ স্পেনে সেটেল্ড। মিশরীয় আর্্মির সাথে তার প্রচুর ব্যবসা। কিন্তু আর্মি তার পেমেন্ট না করায় সে ক্ষেপে উঠে। এক ভিডিও বার্তায় সে ডিফেন্স মিনিস্টারকে অনুরোধ করে সিসিকে পদচ্যুত করতে। সিসি বিরোধি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বিভিন্ন বার্তা আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করতে থাকেে। ঠিক ৬ দিন আগে সে একটা হ্যাশট্যাগ ইউজ করে 'দ্যাটস এনাফ সিসি' যা অল্প কয়েকদিনেই মিশরে #১ আর বিশ্বব্যাপী #৬ পজিশনে চলে আসে।

এই মুহূর্তে মিশরের ডেমোগ্রাফির উপর আমাদের একটা ধারনা থাকা উচিত। মিশরীয়দের গড় বয়স এই মুহূর্তে ২২, অর্থাৎ সেখানে বৃদ্ধদের চাইতে ইয়াংদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক বেশি, যারা টেক স্যাভি, সোশ্যাল মিডিয়াগামী, সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াতে বিশ্বাস করে না। ইজিপশিয়ানরা সব সময় সোশাল মিডীয়াকে পলিটিক্যাল প্রচার আর এক্টিভিজমের জন্য ব্যপকভাবে ব্যবহার করে।

তাই আলির ডাকে সহজেই তারা প্রভাবিত হয়, কারন আলি যা বলছে ভিডিওতে দেখাচ্ছে তা তারাও নিজেদের চোখের সামনে নিত্যদিন দেখছে। আলির ডাকে তারা ফের রাস্তায় নেমে আসে। নিজেদের বিক্ষোভের ভিডিও সোশ্যাল মিডীয়াতে দিয়ে ভাইরাল করে তুলে, অন্যান্য শহরেও পাঁচ জন দশ জন করে বিক্ষভ করা শুরু করে। এগেইন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব এখানে কাজ করে। সবাইকে অবাক করে মিশরিয়রা সরকার পতনের দাবী নিয়ে আবারও রাস্তায়।

এখন অবশ্য পুলিসের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সিসি থাকবে কি যাবে তা আগামি কয়েকদিনেই বুঝা যাবে। আর সিসি টিকে গেলে যারা আজ রাস্তায় নেমেছে তারা সব হয় কারাগারে ঢুকবে না হ্য় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। অপেক্ষা করবে ফের আন্দোলনের জন্য।

তবে সিসির র্যাবা মাসাকার দেখার পরেও যেই জাতি ৬ বছরের মাথায় আবার রাস্তায় নামে, সিসির কারাগারে টর্চারের খবর জেনেও যারা ফের রাস্তায় বেরিয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ করে , যারা জানে একবার কারাগারে গেলে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে, তারা অবশ্যই আমাদের দোয়ার সাথে সাথে স্যালুট ডিজার্ভ করে। যারা নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কোন রাজনৈতিক নেতার ডাকের অপেক্ষায় থাকে না, তারা প্রত্যেকে স্ব-মহিমায় একেক জন নেতা।

লিখেছেন: সাবিনা আহমেদ

পঠিত : ৯৩৫ বার

মন্তব্য: ০