Alapon

খিলাফত রাষ্ট্র বা ইসলামী রাষ্ট্র কী? জামায়াত কী চায়?



বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী খিলাফতের কথা বলে তার উদাহরণ হিসেবে তারা দুইটি শাসন ব্যবস্থাকে স্থির করেছে। সেগুলো হলো নববী শাসন ও খেলাফতে রাশেদা। এই দু'টি শাসন ব্যবস্থা থেকে আমরা কিছু মূলনীতি পাই যা দ্বারা আমরা আমাদের সমাজ ও অধীনস্থ এরিয়া পরিচালনা করতে পারি।

নববী শাসন

ইসলামের অভ্যুদয়ের পর যে মুসলিম সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে এবং হিজরতের পর রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে তা যে রাষ্ট্রের রূপ গ্রহন করে, তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল কুরআনের রাজনৈতিক শিক্ষার উপর। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নিন্মোক্ত মূলনীতিগুলো আমরা নববী শাসন থেকে পাই।

১. আল্লাহর আইনের কর্তৃত্ব
এ শাসনের প্রথম মূলনীতি ছিলো এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং ঈমানদারদের শাসন হচ্ছে মূলত খিলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন। কাজেই বলগাহীনভাবে কাজ করার তার কোনো অধিকার নেই। বরং আল্লাহর কিতাব ও তার রসূলের সুন্নাহর উৎস থেকে উৎসারিত আল্লাহর আইনের অধীনে কাজ করা তার অপরিহার্য কর্তব্য। কুরআন মাজীদের যেসব আয়াতে এ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে সেগুলো হলো, সূরা নিসাঃ ৫৯, ৬৪, ৬৫, ৮০, ১০৫; আল-মায়েদাঃ ৪৪, ৪৫, ৪৭; আল-আরাফঃ ৩; ইউসুফঃ ৪০; আন-নূরঃ ৫৪, ৫৫; আল-আহযাবঃ ৩৬ এবং আল-হাশরঃ ৭।

নবী সা.ও তার অসংখ্য বাণীতে এ মূলনীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘‘আল্লাহর কিতাব মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর কিতাব যা হালাল করে দিয়েছে, তোমরা তাকে হালাল মানো, আর যা হারাম করেছে, তোমরা তাকে হারাম করো।’’ [কানযূল ওম্মাল, ত্বাবরানী এবং মুসনাদে আহমদের উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৯০৭-৯৬৬; দায়েরাতুল মায়ারেফ, হায়দারাবাদ সংস্করণ ১৯৫৫]

‘‘আল্লাহ্ তায়ালা কিছু করণীয় নির্ধারন করে দিয়েছন, তোমরা তা নষ্ট করোনা, কিছু হারাম বিষয় নির্দিষ্ট করেছেন, তোমরা তাতে ঢুকে পড়োনা, কিছু সীমা নির্ধারন করেছেন, তোমরা তা অতিক্রম করোনা, ভুল না করেও কিছু ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা তার সন্ধানে পড়োনা। ’’ [মিশকাত, দারেকুতনীর উদ্ধৃতিতে-বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন]

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব মেনে চলে, সে দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট হবেনা, পরকালেও হবেনা সে হতভাগা।’’[ মিশকাত, রাযীন-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখিত অধ্যায়।]

‘‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাকবে, কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা,- আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাহ।’’[ মিশকাত মুয়াত্তর উদ্ধৃতিতে, আলোচ্য অধ্যায়, কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড হাদীস নং-৮৭৭, ৯৪৯, ৯৫৫, ১০০১।]

২. সকল মানুষের প্রতি সুবিচার
দ্বিতীয় যে মূলনীতির ওপর সে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা ছিলো, কুরআন সুন্নাহর দেয়া আইন সকলের জন্য সমান, রাষ্ট্রের সামান্যতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট পধান পর্যন্ত সকলের উপর তা সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কারো জন্য কোনো ব্যতিক্রমধর্মী আচরণের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীকে একথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘এবং তোমাদের মধ্যে সুবিচার কায়েম করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’’ [সূরা আশ শুরা ১৫]

অর্থাৎ পক্ষপাতমুক্ত সুবিচার নীতি অবলম্বন করার জন্য আমি আদিষ্ট ও নিয়োজিত। পক্ষপাতিত্বের নীতি অবলম্বন করে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া আমার কাজ নয়। সকল মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক- আর তা হচ্ছে আদল ও সুবিচারের সম্পর্ক। সত্য যার পক্ষে, আমি তার সাথী; সত্য যার বিরুদ্ধে, আমি তার বিরোধী। আমার দ্বীনে কারো জন্য কোনো পার্থক্যমূলক ব্যবহারের অবকাশ নেই। আপন পর, ছোট বড়, শরীফ কমীনের জন্য পৃথক পৃথক অধিকার সংরক্ষিত নেই। যা সত্য তা সকলের জন্যই সত্য; যা গুনাহ, তা সকলের জন্যই গুনাহ; যা হারাম, তা সকলের জন্যই হারাম; যা হালাল, তা সকলের জন্যই হালাল; যা ফরয, তা সকলের জন্যই ফরয। আল্লাহর আইনের এ সর্বব্যাপী প্রভাব থেকে আমার নিজের সত্বাও মুক্ত নয়, নয় ব্যতিক্রম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘ তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিন্ম পর্যায়ের অপরাধীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করতো, আর উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিত। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ নিহিত, ফাতেমাও যদি চুরি করতো, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেরতাম।’’[ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, অধ্যায়১১-১২।]

৩. মুসলমানদের মধ্যে সাম্য
এ রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি ছিলো, বংশ, বর্ণ, ভাষা এবং দেশকাল নির্বিশেষে সকল মুসলমানের অধিকার সমান। এ রাষ্ট্রের পরিসীমায় কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, বংশ বা জাতি কোনো বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারেনা, অন্যের মুকাবিলায় করো মর্যাদা খাটোও হতে পারেনা ।

কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘‘মুমিনরা একে অন্যের ভাই।’’ [সূরা হুজরাত ১০] ‘‘হে মানব মন্ডলী! এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের নানা গোত্র, নানা জাতিতে বিভক্ত করেছি, যেনো তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। মূলত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী সন্মানার্হ, যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করে।’’ [সূরা হুজরাত ১৩]

নবী সা.-এর নিম্মোক্ত উক্তি এ মূলনীতিকে আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছে, ‘‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন সম্পদের দিকে তাকাননা বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কার্যাবলীর দিকে তাকান।’’ [তাফসীরে ইবনে কাসীর, মুসলিম এবং ইবনে মাজার উদ্ধৃতিতে, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭, মুস্তফা মুহাম্মাদ প্রেস, মিসর-১৯৩৭।]

৪. সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহি
এ শাসনের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিল, শাসন কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও অর্থ সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত করতে হবে। কোনো ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো এই আমানতে খেয়ানত করার অধিকার রাখেনা। এ আমানত যাদের সোপর্দ করা হবে তারা এজন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেন, ‘‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। আন যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে আল্লাহ্ তোমাদের ভালো উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চই আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। [সূরা নিসা ৫৮]

রাসূল সা. বলেন, ‘‘সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা-যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল তাঁকেও তাঁর সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’[ বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-১। মুসলিম কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

‘‘মুসলিমদের কাজ করাবারের প্রধান দায়িত্বশীল কোনো শাসক যদি তাদের সাথে প্রতারণা এবং খিয়ানতকারী অবস্থায় মারা যায় তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’’[বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৮। মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-৬১; কিতাবুর ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো পদাধিকারী শাসক যে নিজের পদের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্ঠা সাধনা করেনা, নিষ্ঠার সাথে কাজ করেনা; সে কখনো মুসলমানদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবেনা।’’ [মুসলিম, কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

[নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যরকে বলেন] ‘‘আবু যর। তুমি দুর্বল মানুষ, আর সরকারের পদ মর্যাদা একটি আমানত। কিয়ামতের দিন তা লজ্জা এবং অপমানের কারণ হবে; অবশ্য তার জন্য নয়, যে পুরোপুরি তার হক আদায় করে এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।’’ [ কানযুল ওম্মাল, ষষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৮, ১২২।]

‘‘যে ব্যক্তি আমাদের রাষ্ট্রের কোনো পদ গ্রহন করে, তার স্ত্রী না থাকলে বিবাহ করবে, খাদেম না থাকলে একজন খাদেম গ্রহন করবে, ঘর না থাকলে একখানা ঘর করে নেবে,[যাতায়াতের] বাহন না থাকলে একটা বাহন গ্রহন করবে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়, সে খিয়ানতকারী অথবা চোর।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৪৬।]

৫. শুরা বা পরামর্শ
এ রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিলো মুসলমানদের পরামর্শ এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত হতে হবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘‘আর মুসলমানদের কাজকর্ম [সম্পন্ন হয়] পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’’[সূরা শুরাঃ ৩৮] ‘‘হে নবী! কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’[সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯]

হযরত আলী রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-এর খিদমতে আরয করি যে, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোনে বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো? তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে দীনের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ইবাদত গুযার ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করো এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবেনা।’’

হযরত উমর রা. বলেন, ‘‘মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের [ইমারাত] প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির জোর পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্নক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মতের উচিত নয়।] অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তি বর্ণিত আছে, ‘‘পরামর্শ ব্যতীত কোনো খেলাফত নেই।’’[২৪. কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩৫৪।]

৬. ভালো কাজে আনুগত্য
৬ষ্ঠ মূলনীতি-যার ওপর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এই ছিল যে, কেবল মাত্র মারুফ বা ভালো কাজেই সরকারের আনুগত্য অপরিহার্য। পাপাচারে [মা’সিয়াত] আনুগত্য পাওয়ার অধিকার কারোর নেই। অন্য কথায়, এ মূলনীতির তাৎপর্য এই যে, সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কেবল সেসব নির্দেশই তাদের অধীন ব্যক্তিবর্গ এবং প্রজাবৃন্দের জন্য মেনে চলা ওয়াজিব, যা আইনানুগ। আইনের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেয়ার তাদের কোনো অধিকার নেই; তা মেনে চলাও কারো উচিত নয়। কুরআন মাজীদে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইয়াত- আনুগত্যের শপথ গ্রহনকেও মারুফে আনুগত্যের শর্তে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তাঁর পক্ষে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ আসার প্রশ্নই ওঠেনা।

রাসূল সা. বলেন, ‘‘একজন মুসলমানের উপর তার আমীরের আনুগত্য করা শোনা এবং মেনে চলা ফরয; তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যতক্ষণ তাকে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ না দেয় হয়। মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়া হলে কোনো আনুগত্য নেই।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৪ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮। আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল জিহাদ, অধ্যায়-৪০।]

‘‘আল্লাহর নাফরমানীতে কোনো আনুগত্য নেই; আনুগত্য কেবল মারুফ কাজে।’’[ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮ আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩]

নবী সা.-এর বিভিন্ন উক্তিতে বিভিন্নভাবে এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও তিনি বলেছেনঃ ‘‘যে আল্লাহর নাফরমানী করে, তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেন, স্রষ্ট্রার নাফরমানীতে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেন, ‘‘যে আল্লাহর আনুগত্য করেনা তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই, কখনো বলেছেনঃ ‘’যে শাসক তোমাকে তোমাকে কোনো মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়, তার আনুগত্য করোনা।’’[ কানযুল ওম্মাল ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২৯৩, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬, ২৯৯, ৩০১।]

৭. পদমর্যাদার দাবী ও লোভ নিষিদ্ধ
এটাও সে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিলো যে, সাধারনত রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণে পদ বিশেষত খেলাফতের জন্য সে ব্যক্তি বেশী অযোগ্যে-অনুপযুক্ত, যে নিজে পদ লাভের অভিলাষী এবং সে জন্য সচেষ্ট।

আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেনঃ

‘‘আখেরাতের ঘর আমি তাদেরকে দেবো, যারা জমিনে নিজের মহত্ত্ব খুঁজে বেড়ায়না, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়না।’’ [সূরা কাসাসঃ ৮৩]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

‘‘আল্লাহর শপথ, এমন কোনো ব্যক্তিকে আমরা এ সরকারের পদ মর্যাদা দেইনা, যে তা চায় এবং তার জন্য লোভ করে।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৭। মুসলিম কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৩।]

‘‘যে ব্যক্তি নিজে তা সন্ধান করে, আমাদের নিকট সে-ই সবচেয়ে বেশী খেয়ানতকারী।’’[ আবু দাউদ, কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-২]

‘‘আমরা এমন কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারী কর্মচারী হিসেবে গ্রহন করিনা, যে নিজে উক্ত পদের অভিলাষী।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড,হাদীস নং ২০৬।]

‘‘আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাদিয়াল্লহু তায়ালা আনহুকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবদুর রহমান সরকারী পদ দাবী করোনা। কেননা চেষ্টা তদবীর করার পর যদি তা তোমাকে দেয়া হয়, তবে তোমাকে তার হাতে সঁপে দেয়া হবে, আর যদি চেষ্টা তদবীর ছাড়াই তা লাভ করো, তবে তার হক আদায় করার ব্যপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাকে সাহায্য করা হবে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২০৬।

৮. রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য
এ রাষ্ট্রের শাসক এবং তার সরকারের সর্ব প্রথম কর্তব্য এই সাব্যস্ত হয়েছিল যে, কোনো রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই যথাযথভাবে সে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করবে, ইসলামের চারিত্রিক মানদন্ডানুযায়ী ভালো ও সৎ-গুণাবলীর বিকাশ এবং মন্দ ও অসৎ গুনাবলীর বিনাশ সাধন করবে। কুরআন মাজীদে এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

‘‘[মুসলমান তারা] যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ভালো কাজের নির্দেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করে।’’[সূরা হজ্জঃ৪১]

কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলিম মিল্লাতের অস্তিত্বের মূল লক্ষও এটিই।

‘‘এমনি করে আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থী উম্মত [বা ভারসাম্যপূর্ণ পথে অবিচল উম্মাত] করেছি, যেনো তোমরা লোকদের উপর সাক্ষী হও আর রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।’’[সূরা বাকারাঃ ১৪৩]

‘‘তোমরা যে সর্বোত্তম উম্মাত, মানুষের [সংশোধন এবং পথ প্রদর্শনের] জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’’

এতদ্ব্যতীত যে কাজের জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল আদিষ্ট ছিলেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তা ছিলো এইঃ

‘‘দীন কায়েম করো এবং তাতে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’’ [সূরা শুরাঃ ১৩]

অমুসলিম বিশ্বের মুকাবিলায় তার সকল চেষ্টা সাধনাই ছিলো এ উদ্দেশ্যেঃ

‘‘দ্বীন যেনো সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হয়ে যায়।’’ (সূরা আনফাল ৩৯)

৯. আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের অধিকার এবং কর্তব্য
এ রাষ্ট্রের সর্বশেষ মূলনীতি যা তাকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয় তা ছিলো, মুসলিম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি সত্যবাক্য উচ্চারণ করবে, নেকী ও কল্যানের সহায়তা করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যেখানেই কোনো ভুল এবং অন্যায় কার্য হতে কেখবে, সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করবে। মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্যের এটা শুধু অধিকারই নয়, অপরিহার্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের নির্দেশ হচ্ছে, ‘‘নেকী এবং তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করো এবং গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজে সাহায্য করোনা।’’ {সূরা মায়েদা ২} ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। {আহযাব ৭০} ‘‘ঈমানদাররা! তোমরা সকলে ন্যায় বিচারে অটল অবিচল থাকো এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাতা হও, তোমাদের সাক্ষ্য স্বয়ং তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা মাতা বা নিকটাত্নীয়দের বিরুদ্ধে যাকনা কেন।’’ {সূরা নিসা ১৩৫}

এ ব্যাপারে নবী সা.-এর এরশাদ হলো, ‘‘তোমাদের কেউ যদি কোনো মুনকার {অসৎ কাজ} দেখে, তবে তার উচিত হাত দিয়ে তা প্রতিহত করা। তা যদি না পারে, তবে মুখ দ্বারা বারণ করবে, তাও যদি না পারে, তবে অন্তর দ্বারা {খারাপ জানবে এবং বারণ করার আগ্রহ রাখবে}, আর এটা হচ্চে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায় -২০ । তিরমিযী, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। আবু দাউদ; কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭ ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০।]

‘‘যালেম শাসকের সামনে ন্যায় {বা সত্য কথা} বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’’ [আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৬। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০]

‘‘যে ব্যক্তি কোনো শাসককে রাযী করার জন্য এমন কথা বলে, যা তার প্রতিপালককে নারাজ করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দীন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে।’’ [ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩০৯।]

খিলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট্য
নববী শাসনের মূলনীতির ওপর খিলাফতে রাশেদিনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ সা. কোনো ফায়সালা না দিয়ে গেলেও ইসলাম একটি শুরাভিত্তিক খিলাফত দাবী করে, মুসলিম সমাজের সদস্যরা এ কথা অবগত ছিলো। তাই সেখানে কোনো বংশানুক্রমিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বল প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি, খিলাফত লাভ করার জন্য কেউ নিজের তরফ থেকে চেষ্টা তদবীর করেনি বা নামমাত্র প্রচেষ্টাও চালায়নি। বরং জনগন তাদের স্বাধীন মর্জিমতো পর পর চারজন সাহাবীকে তাদের খলীফা নির্বাচিত করে। মুসলিম মিল্লাত এ খিলাফতকে খিলাফতে রাশেদা {সত্যাশ্রয়ী খিলাফত} বলে গ্রহন করেছে। এ থেকে আপনা আপনিই প্রকাশ পায় যে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে এটিই ছিলো খিলাফতের সত্যিকার পদ্ধতি। এই শাসন ব্যবস্থা থেকেও আমরা কিছু মূলনীতি পাই।

১. নির্বাচনী খেলাফত
নবী সা.-এর স্থলাভিষিক্তের জন্য হযরত ওমর রা. হযরত আবু বকর রা.-এর নাম প্রস্তাব করেন। মদীনার লোকেরা {বস্তুত তখন তারা কার্যত সারা দেশের প্রতিনিধির মর্যাদার অভিষিক্ত ছিলো} কোনো প্রকার চাপ, প্রভাব এবং প্রলোভন ব্যতীত নিজেরা সন্তুষ্টচিত্তে তাঁকে পছন্দ করে তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ করেন।

হযরত আবুবকর রা. তাঁর ওফাতকালে হযরত ওমর রা. সম্পর্কে অসীয়াত লিখান, অতঃপর জনগনকে মসজিদে নববীতে সমবেত করে বলেন, ‘‘আমি যাকে স্থলাভিষিক্ত করছি তোমরা কি তার ওপর সন্তুষ্ট? আল্লাহর শপথ! সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য বুদ্ধি বিবেক প্রয়োগে আমি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিনি। আমার কোনো আত্মীয় স্বজনকে নয় বরং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি। সুতরাং তোমরা তার নির্দেশ শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’’ সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, আমরা তার নির্দেশ শুনবো এবং মানবো।[ আততাবারী-তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬১৮। আল-মাতবায়াতুল ইস্তিকামা, কায়রো ১৯৩৯।]

মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় হযরত ওমর রা. বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি কোনো আমীরের হাতে বাইয়াত করে, তার কোনো বাইয়াত নেই; এবং যার হাতে বাইয়াত করে, তারও কোনো বাইয়াত নেই। অপর এক বর্ননায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ বাক্যও দেখা যায়-পরামর্শ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে ইমারাত দেয়া হলে তা কবুল করা তার জন্য হালাল নয়। {ইবনে হাযার, ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠ-১২৫, আল-মাতবায়াতুল খাইরিয়া, কায়রো, ১৩২৫ হিজরী।]

হযরত ওমর রা. খিলাফতের ফায়সালা করার জন্য তার ওফাতকালে একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করে বলেনঃ ‘মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি জোর করে আমীর হওয়ার চেষ্টা করবে, তাকে হত্যা করো।’ খিলাফত যাতে বংশানুক্রমিক পদাধিকারে পরিণত না হয়, সে জন্য তিনি খিলাফত লাভের যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা থেকে নিজের ছেলের নাম সুস্পস্টভাবে বাদ দিয়ে দেন। [ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯২। ইবনুল, আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪-৩৫। ইদারাতুল তিবরাতিল মুনীরিয়া, মিসর, ১৩৫৬ হিজরী] ওমর রা. ছয় ব্যক্তিকে নিয়ে এ নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়।

কমিটির সদস্য আবদুর রহমান ইবনে আওফকে কমিটি শেষ পর্যন্ত খলিফার নাম প্রস্তাব করার ইখতিয়ার দান করে। সাধারণ লোকদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে তিনি জানতে চেষ্টা করেন, কে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। হজ্জ শেষ করে যেসব কাফেলা বিভিন্ন এলাকায় ফিরে যাচ্ছিলো, তিনি তাদের সাথেও আলোচনা করেন। এ জনমত যাচাইয়ের ফলে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অধিকাংশ লোকই হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পক্ষে।[ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬। ইবনুল আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৬।] তাই তাকেই খিলাফতের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ জনসমাবেশে তার বাইয়াত হয়।

হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদাতের পর কিছু লোক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা করতে চাইলে তিনি বললেনঃ‘‘ এমন করার ইখতিয়ার তোমাদের নেই। এটা তো শুরার সদস্য এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাজ। তারা যাঁকে খলীফা করতে চান, তিনিই খলীফা হবেন। আমরা মিলিত হবো এবং এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবো।’’[ ইবনে কুতাইবা, আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১।] তাবারী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, তা হচ্ছেঃ ‘‘ গোপনে আমার বাইয়াত অনুষ্ঠিত হতে পারেনা, তা হতে হবে মুসলমানদের মর্জী অনুযায়ী।’’[আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০।]

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ওফাতকালে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, আমরা আপনার পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হাতে বাইয়াত করবো? জবাবে তিনি বলেনঃ ‘‘ আমি তোমাদেরকে নির্দেশও দিচ্ছিনা, নিষেধও করছিনা। তোমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারো।’’[ আততাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১২।

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, খিলাফত সম্পর্কে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সর্বসম্মত মত এই ছিলো যে, খিলাফত একটা নির্বাচন ভিত্তিক পদমর্যাদা। মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিক বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করা তাঁদের মতে খিলাফত নয় বরং তা সৈরতন্ত্র। খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের যে স্পষ্ট ও দ্ব্যতহীন ধারনা সাহাবায়ে কিরামগণ পোষণ করতেন, হযরত আবু মুসা আশয়ারী হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা ব্যক্ত করেন নিম্মোক্ত ভাষায়, ‘‘ইমারাত {অর্থাৎ খিলাফত} হচ্ছে তাই, যা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ নেয়া হয়েছে। আর তরবারীর জোরে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাদশাহী বা রাজতন্ত্র।’’[ তাবকাতে ইবনে সা’দ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১৩।]

২. শুরাভিত্তিক সরকার
এ খলীফা চতুষ্টয় সরকারের নির্বাহী এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে জাতির বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের অধিকারী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ না করে কোনো কাজ করতেননা। সুনানে দারামীতে হযরত মাইমুন ইবনে মাহরানের একটি বর্ণনা আছে যে, হযরত আবু বকর রা.-এর নীতি ছিলো, তাঁর সামনে কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি প্রথমে দেখতেন আল্লাহর কিতাব কি বলে। সেখানে কোনো নির্দেশ না পেলে এ ধরনের ব্যাপারে রাসূল সা. কী ফয়সালা দিয়েছেন, তা জানতে চেষ্টা করতেন। রসূলের সুন্নায়ও কোনো নির্দেশ না পেলে জাতীয় পরামর্শক্রমে যে মতই স্হির হতো, তদানুযায়ী ফায়সালা করতেন। [ সুনানে দারামী, বাবুল ফুতইয়া ওয়ামা ফীহি মিনাশ শিদ্দাহ।] হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কর্মনীতিও ছিলো অনুরূপ। [ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২২৮১। ] পরামর্শের ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টিভংগি ছিলো, শুরার সদস্যদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারে ওমর রা. এক পরামর্শ সভার উদ্ধোধনী ভাষণে খিলাফতের পলিসি ব্যক্ত করেছেন এভাবে,

‘‘আমি আপনাদের যে জন্য কষ্ট দিয়েছি, তা এছাড়া আর কিছু নয় যে, আপনাদের কার্যাদির যে ভার আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে তা বহন করার কাজে আপনারাও আমার সঙ্গে শরীক হবেন। আমি আপনাদের মধ্যাকরই এক ব্যক্তি। আজ আপনারাই সত্যের স্বীকৃতি দানকারী। আপনাদের মধ্য থেকে যাদের ইচ্ছা, আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন; আবার যাদের ইচ্ছা আমার সাথে একমতও হতে পারেন। আপনাদের যে আমার মতামতকে সমর্থন করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই এবং আমি তা চাই-ও না।‘‘[ ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-২৫।]

৩. বাইতুল মাল একটি আমানত
খুলাফায়ে রাশেদিনরা বাইতুলমালকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করতেন। বেআইনীভাবে বাইতুলমালের মধ্যে কিছু প্রবেশ করা ও বেআইনীভাবে তা থেকে কিছু বের হয়ে যাওয়াকে তারা জায়েয মনে করতেননা। শাসক শ্রেণীর ব্যক্তিগত স্বার্থে বাইতুলমাল ব্যবহার তাদের মতে হারাম ছিলো। তাদের মতে খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্যৈই ছিলো এই যে, রাজা বাদশাহরা জাতীয় ভান্ডারকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে নিজেদের খাহেশ মতো স্বাধীনভাবে তাতে তসরুফ করতো, আর খলীফা তাকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করে সত্য ন্যায় নীতি মোতাবেক এক একটি পাই পয়সা উসূল করতেন, আর তা ব্যয়ও করতেন সত্য ন্যায় নীতি অনুসারে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদা হযরত সালমান ফারসীকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘‘ আমি বাদশাহ, না খলীফা?’’ তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দেনঃ ‘‘মুসলমানদের ভূমি থেকে আপনি যদি এক দিরহামও অন্যায়ভাবে উসূল এবং অন্যায়ভাবে ব্যয় করেন তাহলে আপনি খলীফা নন; বাদশা।’’

৪. রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্র সম্পর্কে খুলাফায়ে রাশেদিনের ধারণা কী ছিলো? রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজের মর্যাদা এবং কর্তব্য সম্পর্কে তারা কী ধারনা পোষণ করতেন, স্বীয় রাষ্ট্রে তারা কোন্ নীতি মেনে চলতেন? খিলাফতের মঞ্চ থেকে ভাষণ দান প্রসঙ্গে তাঁরা নিজেরাই প্রকাশ্যে এসব বিষয় ব্যক্ত করেছেন। মসজিদে নববীতে গণ বাইয়াত ও শপথের পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন ন্যস্ত, আমি নিজে ইচ্ছা করে এ পদ গ্রহণ করিনি। অন্যের পরিবর্তে আমি নিজে এ পদ লাভের চেষ্টাও করিনি, এজন্য আমি কখনো আল্লাহর নিকট দোয়াও করিনি। এজন্য আমার অন্তরে কখনো লোভ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ এবং আরবদের মধ্যে ধর্ম ত্যাগের ফেতনার সূচনা হবে- এ আশংকায় আমি অনিচ্ছা সত্বে এ দায়িত্ব গ্রহন করেছি। এ পদে আমার কোনো শান্তি নেই। বরং এটা এক বিরাট বোঝা, যা আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ বোঝা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। অবশ্য আল্লাহ যদি আমাকে সাহায্য করেন। আমার ইচ্ছা ছিলো, অন্য কেউ এ দায়িত্বভার বহন করুক।

এখনোও আপনারা ইচ্ছা করলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে হতে কাউকে এ কাজের জন্য বাছাই করে নিতে পারেন। আমার বাইয়াত এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিবন্ধক হবেনা। আপনারা যদি আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানদন্ডে যাচাই করেন, তবে তার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, তিনি শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো। আমি সঠিক কাজ করলে আমার সহযোগিতা করবেন, অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেবেন। সততা হচ্ছে একটি আমানত। আর মিথ্যা একটি খেয়ানত। তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল। আল্লাহর ইচ্ছায় যতক্ষণ আমি তার অধিকার তাকে দান না করি।

আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল-যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে না পারি। কোনো জাতি আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা সাধনা ত্যাগ করার পরও আল্লাহ তার ওপর অপমান চাপিয়ে দেননি-এমনটি কখনো হয়নি। কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করার পর আল্লাহ তাদেরকে সাধারণ বিপদে নিপতিত করেননা-এমনও হয়না। আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। আমি আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হলে আমার ওপর তোমাদের কোনো আনুগত্য নেই। আমি অনুসরণকারী, কোনো নতুন পথের উদ্ভাবক নই।’’[ আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০। ইবনে হিশাম, আস সীরাতুন নববিয়্যা, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১১, মাতবায়াতু মুস্তফা আল-বাবী, মিসর-১৯৩৬, কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২২৬১, ২২৬৪, ২২৬৮, ২২৭৮, ২২৯১, ২২৯৯। ] প্রায় একইরূপ কথা বলেছেন অন্যান্য খলীফারা।

৫. আইনের প্রাধান্য
এ খলীফারা নিজেদেরকে কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতেননা। বরং আইনের দৃষ্টিতে নিজেকে এবং দেশের একজন সাধারন নাগরিককে {সে মুসলমান হোক বা অমুসলিম যিম্মি} সমান মনে করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁরা নিজেরা বিচারপতি {কাযী} নিযুক্ত করলেও খলীফাদের বিরুদ্ধে রায় দানে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেমন স্বাধীন ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাপারে।

৬. বংশ-গোত্রের পক্ষপাতমুক্ত শাসন
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, ইসলামের নীতি এবং প্রাণশক্তি অনুযায়ী তখন বংশ গোত্র দেশের পক্ষপাতের উর্ধ্বে উঠে সকল মানুষের সাথে সমান আচরণ করা হতো, কারো সাথে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করা হতোনা। আল্লাহর রসূলের ওফাতের পরে আরবের গোত্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নবুয়্যতের দাবীদারদের অভ্যুদয় এবং ইসলাম ত্যাগের হিড়িকের মধ্যে এ উপাদান ছিলো সবচেয়ে ক্রিয়াশীল। খুলাফায়ে রাশেদিনরা গোত্রবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না। গোত্রের লোকদের প্রশ্রয় দিতে গিয়েই ইসলামী খিলাফত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

৭. গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি
সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাই ছিলো এ খিলাফতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরাজির অন্যতম। খলীফারা সবসময় জনগনের নাগালের মধ্যে থাকতেন। তাঁরা নিজেরা শুরার অধিবেশনে বসতেন এবং আলোচনায় অংশ গ্রহন করতেন। তাঁদের কোনো সরকারী দল ছিলোনা। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো দলের অস্তিত্ব ছিলোনা। মুক্ত পরিবেশে সকল সদস্য নিজ নিজ ঈমান এবং বিবেক অনুযায়ী মত প্রকাশ করতেন। চিন্তাশীল, উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে সকল বিষয় যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা হতো। কোনো কিছুই গোপন করা হতোনা। ফায়সালা হতো দলীল প্রমানের ভিত্তিতে, কারোর দাপট, প্রভাব প্রতিপত্তি, স্বার্থ সংরক্ষণ বা দলাদলির ভিত্তিতে নয়। কেবল শুরার মাধ্যমেই খলীফারা জাতির সম্মুখে উপস্থিত হতেননা; বরং দৈনিক পাঁচবার সালাতের জামায়াতে, সপ্তাহে একবার জুময়ার জামায়াতে এবং বৎসরে দুবার ঈদের জামায়াতে ও হজ্জের সম্মেলনে তাঁরা জাতির সামনে উপস্থিত হতেন। অন্যদিকে এসব সময় জাতিও তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতো। তাঁদের নিবাস ছিলো জনগণের মধ্যেই। কোনো দারোয়ান ছিলোনা তাঁদের গৃহে। সকল সময় সকলের জন্য তাঁদের দ্বারা খোলা থাকতো। তাঁরা হাট বাজারে জনগণের মধ্যে চলাফেরা করতেন। তাঁদের কোনো দেহরক্ষী ছিলোনা, ছিলোনা কোনো রক্ষী বাহিনী। এসব সময়ে ও সুযোগে যে কোনো ব্যক্তি তাঁদের প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে ও তাঁদের নিকট থেকে হিসেবে চাইতে পারতো। তাঁদের নিকট থেকে কৈফিয়ত তলব করার স্বাধীনতা ছিলো সকলেরই। এ স্বাধীনতা ব্যবহারের তাঁরা কেবল অনুমতিই দিতেননা বরং এজন্য লোকদেরকে উৎসাহিতও করতেন।


আমরা দুটি শাসন ব্যবস্থার মূলনীতিগুলোকে সামনে রেখে একটি সমাজ কায়েম করতে চাই যাকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করছি। অনেকে এই বিষয়গুলোকে অলীক বা কল্পনাবিলাস বলতে চান। তারা বলতে চান আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এই ধরণের শাসনব্যবস্থা চালু করা অবাস্তব। আসলে সবকিছুই নির্ভর করে নিয়ত, যোগ্যতা ও ক্ষমতার উপর। আমরা এই মূলনীতিগুলোকে ধারণ করি ও প্রতিষ্ঠা করতে চাই বিধায় আমরা আমাদের জামায়াতের গণ্ডির মধ্যে তা কায়েম করেছি। আলহামদুলিল্লাহ। একইভাবে আল্লাহ চাহে তো আমরা আরো বড় পরিসরে এই শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারবো। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আপনিও আসুন, আমাদের সাথে শরিক হোন। আপনার উপর আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত ফরয দায়িত্ব পালন করুন।

বি.দ্র. প্রবন্ধটি মাওলানা মওদূদীর ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান বই থেকে সংকলন করা হয়েছে।

পঠিত : ২০৬৭ বার

মন্তব্য: ০