Alapon

বাঙালির চোখে সবাই খারাপ, তবে ভালোটা কে...?


বিগত কয়েকবছর বাঙাল জাতটাকে পর্যবেক্ষণ করে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলাম। বাঙাল জাত দুই ভাগে বিভক্ত। এক জাত নিত্য দিনই কাউকে না কেউ হিরো বানিয়ে আকাশে তোলে। আর এক জাত তারে আকাশ থেকে নামি জমিনের অর্থাৎ পায়ের তলায় নামানোর চেষ্টা করে।

যেমন ধরুন, একটা বাঙালদের মাঝে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনিজাদকে নিয়ে ফেসিনেশন ছিল। একদল তাকে যুগের মুজাদ্দিদ আমিরুল মুমিনীন বানানোর চেষ্টা করতে লাগল। তার ব্যক্তিগত জীবন, অতি সাধারণ জীবন-যাপনের কাহিনি বর্ণনা করে যুগের সালাউদ্দিন আইয়ুবি বানানোর চেষ্টা করল। যারা তাকে নিয়ে এরূপ মাতামাতি করল তারা কিন্তু আম পাবলিক। অর্থাৎ জেনারেল শিক্ষিত তরুণ সমাজ।

অন্যদিকে দ্বিনের শিক্ষায় শিক্ষিত দাবিদাররা এক ধাক্কায় আহমেদি নিজাদকে ইসলাম থেকে বের করে দিল। অর্থাৎ আহমেদি নিজাদ তো শিয়া মতালম্বি। আর শিয়া মানেই কাফের। অর্থাৎ আহমেদি নিজাদ যতোই ভালো হোক, তাকে ভালো বলা যাবে না। তার আক্বিদায় গণ্ডগোল আছে। তার প্রশংসা করা মানেই সেই গণ্ডগোল মার্কা আক্বীদরই প্রশংসার নামান্তর।

এরপর বাঙালের মন থেকে আহমেদি নিজাদ হারিয়ে গেল। সেই জায়গা দখল করল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার রাষ্ট্র তুরস্কে এরদোয়ান ক্ষমতার মসনদে আসেন বহু আগে। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখন তুরস্ক প্রধানমন্ত্রী শাসিত রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু সাংবিধানিক কারণে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ না থাকায় গণভোটের মাধ্যমে তুরস্কে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। আর বর্তমানে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান।

এরদোয়ান বিভিন্ন সময় নিপিড়িত মুসলিমদের জন্য বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কখনো মজলুম মুসলিমদের জন্য বিশাল ত্রানও প্রেরণ করেন। যেমন ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তু এবং আমাদের পাশ্ববর্তি রাষ্ট্রের রোহিঙ্গাদের জন্য এরদোয়ানের দেশে তুরস্ক বিপুল পরিমাণ ত্রান সামগ্রি প্রদান করে। যার ফলে একদল তাকে ইতোমধ্যেই মুসলিম উম্মাহর সুলতান ঘোষণা দিয়ে বসে আছে। অর্থাৎ এক ধাক্কায় আকাশে তোলা। এখানেও আকাশে তোলা পাবলিকরা হচ্ছে তারাই যারা আম পাবলিক। অর্থাৎ জেনারেল শিক্ষিত।

অপরদিকে দ্বিনী শিক্ষায় শিক্ষিত দাবিকারকদের কেউ কেউ বলে, এরদোয়ান তো ফাসেক। কারণ, সে গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। আর গণতন্ত্র ইসলামে হারাম। অন্যদিকে তুরস্কে এখনো আইন করে মদ নিষিদ্ধ করা হয়নি। তুরস্কে এখনো পর্দা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সেখানে রাষ্ট্রিয়ভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। অতএব এরদোয়ান ফাসেক। সে মুসলিমদের জন্য যেসব কথা বলে, তা স্বস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বলে।

এতো গেল এরদোয়ান। এবার আসা যাক বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত নাম পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে। জাতিসংঘের ৭৪ তম অধিবেশনে ইমরান খান যে বক্তব্য দিয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। তিনি ৫০ মিনিটের বক্তব্যে এমন অনেক কিছুই উল্লেখ করেছেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

কিন্তু তার মানে এই নয়, ইমরান খান আমিরুল মুমিনীন হয়ে গেছেন। তার এই বক্তব্যের জের ধরে তাকে যেভাবে প্রশংসা আর স্তুতি বাক্যে ভাসানো হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ইমরান খানকে যুগের সালাউদ্দিন আইয়ুবি ঘোষণা দিতে আর কিছু বাকি নাই।

অন্যদিকে কেউ কেউ তাকে সুযোগ সন্ধানী এবং লোভি বলার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ বলছে, ইমরান খান কাশ্মির নিয়ে যা করছে তা আদৌত লোক দেখানো। আসলে তিনি কাশ্মিরের জন্য কিছুই করবেন না। এসব ফাও আলাপ! অন্যদিকে ইমরান খান পশ্চিমাদের এজেন্ডা কামেরই চেষ্টা করছে।

ইমরান খানকে নিয়ে যারা এরূপ আলোচনা করছে, তাদের অধিকাংশরাই দ্বিনী শিক্ষায় শিক্ষিত বলে দাবিকারি। প্রকৃত বাস্তবতা হল, ইমরান খানে চিরশত্রুরা যেখানে বলছে, বিগত কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের আরও কোনো প্রধানমন্ত্রী কাশ্মির নিয়ে এতোটা জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, সেখানে বাঙাল পন্ডিতরা কাশ্মির নিয়ে ইমরানের নিয়্যাত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

আলোচনা আর দির্ঘ করতে চাচ্ছি না। তবে মোরাল অব দ্যা স্টোরি বলি, বাঙালের চোখে কেউই ভালো না। আবার বাঙালের চোখে সবাই সুপারম্যান।

খুব সম্ভবত বাঙাল কারো প্রশংসা পছন্দ করে না। যাকে নিয়েই প্রশংসা করা হোক না কেন, তার মাঝে বাঙাল একটা না একটা দোষ খুঁজে পাবেই। খুব সম্ভবত, বাঙালের চোখ কোনো যেন তেন সাধারণ চোখ নয়। অনুবীক্ষণ যন্ত্র সম্বেলিত চোখ। যে চোখ থেকে কারও নিয়্যাত পর্যন্ত গোপন করার সুযোগ নেই। কেমন করে যেন বাঙাল সমাজ মানুষের নিয়্যাতও জেনে ফেলে!

শেষ করছি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতা দিয়ে। যে কবিতায় বাঙালির প্রকৃত মানস ফুটে উঠেছে।

পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।

পঠিত : ৯১০ বার

মন্তব্য: ০