Alapon

তিনি যেভাবে সম্রাট হয়ে উঠেন....


ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় রমরমা জুয়ার আসর পরিচালনা করে ব্যাপক আলোচিত তিনি। ক্লাবগুলোতে জুয়ার আধুনিক সংস্কার ‘ক্যাসিনো’ ব্যবসাও যুক্ত করেছেন সম্রাট। এ কারণে জুয়াড়িদের কাছে তিনি ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ নামেও পরিচিতি পেয়েছেন।

জুয়া ক্যাসিনো ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণের গোটা অঞ্চলে ছিল তার দাপট। গত ১০ বছর ধরে চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বাড়ি ও জমিদখল সবই নিয়ন্ত্রণ করেছেন সম্রাট।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অধিবাসী সম্রাটের পিতা রাজউকের ছোট পদে চাকরি করতেন। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকাতে বড় হন সম্রাট। পরিবারের সঙ্গে প্রথমে বসবাস করতেন কাকরাইলে সার্কিট হাউস সড়কের সরকারি কোয়ার্টারে।

রাজনীতিতে সম্রাটের আগমন ঘটে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে। এ সময় কিছুদিন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশ্য তার আগে এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রসমাজের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা ছিল বলে তার পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন। বিএনপির ১৯৯১-৯৬ আমলে ছাত্রলীগ ছেড়ে দিয়ে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৩ সালে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় দক্ষিণের সভাপতি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। মূলত শাওনই সম্রাটকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে সম্রাট ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি হন। এরপর আর তার পেছনে তাকাতে হয়নি।

এদিকে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নিজস্ব কোনও কার্যালয় না থাকলেও সম্রাট দায়িত্ব নেওয়ার পর কাকরাইলে রাজমনি সিনেমা হলের উল্টো দিকে বিশাল এক ভবনের পুরোটাজুড়ে অফিস শুরু করেন। সাংগঠনিক কাজের কথা বলা হলেও এখানে বসেই সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখানে থাকতো তার কর্মী বাহিনী ও অপকর্মের সঙ্গীদের আনাগোনা। যে রাতে খালিদ মাহমুদ গ্রেফতার হন, ওই রাতে সম্রাট তার অফিসেই ছিলেন বলে জানা যায়। অবশ্য পরিবার নিয়ে তার বসবাস মহাখালী ডিওএইচএসের একটি বাড়িতে।

নানা অপকর্মের বিপরীতে সম্রাট যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি কাড়েন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ‘লোকবল’ সাপ্লাই আর অর্থ দিয়ে। তার রয়েছে বিশাল ‘কর্মী বাহিনী’। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বড় ধরনের শো ডাউন দেখাতেন তিনি। কর্মী বাহিনীকে একেক কর্মসূচিতে একেক ধরনের পোশাক পরিয়ে দৃষ্টি কাড়তেন সবার। এ জন্য যুবলীগ চেয়ারম্যান সম্রাটকে শ্রেষ্ঠ সংগঠক বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি ক্যাসিনো ব্যবসার খবর প্রকাশের পরও তার পক্ষে স্ট্যান্ড নেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। গণমাধ্যম কর্মীদের একটি অংশের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা। যে কারণে সম্রাটের যেকোনও কর্মসূচির মিডিয়া কাভারেজও ছিল চোখে পড়ার মতো।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্রাটের এই কর্মীবাহিনীর তথ্য জানতেন। এজন্য তার প্রতি সফটকর্নার ছিল সবসময়। গত বছর সম্রাটের বিরুদ্ধে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে। এটা জানতে পেরে শেখ হাসিনা তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন। আঞ্জুমানকে প্রধানমন্ত্রী নিজে ও তার বোন শেখ রেহেনা বিভিন্ন সময়ে অনুদান দিয়ে আসছেন। সম্রাট তাদের কাছে চাঁদা চাওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সম্মেলনে যাওয়ার আগে তিনি যুবলীগ দক্ষিণের কমিটি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে যান। তবে সেই নির্দেশনা তখন বাস্তবায়ন পর্যন্ত গড়ায়নি। এরই মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সম্রাটের জুয়া ও ক্যাসিনে ব্যবসা পরিচালনার রিপোর্ট পান প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে কানাডা সফরে গেলে মতিঝিল এলাকার সাবেক একজন ছাত্রনেতা সম্রাটের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলেন। সম্রাটের কারণেই তিনি রাজনীতি ছেড়ে কানাডা চলে গেছেন বলে জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনিবার্হী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবারও সম্রাটের নাম আসে। তখন প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের জুয়া ক্যাসিনো ব্যবসার নাম উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এরপরই গ্রেফতার হয় যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভুঁইয়া। এ সময় আলোচনায় আসে সম্রাটের নামও।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সম্রাট গত দিন দশেক ধরে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে ছিলেন। গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে থেকেও তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে সেই চেষ্টায় সফল হননি। রবিবার (৬ অক্টোবর) ভোরের দিকে সম্রাটকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আত্মীয় মনিরুল ইসলামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন।

সম্রাটের ঘনিষ্ট দুই সহচর হলেন— ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা জিকে শামীমও সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন।

‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম— তিনি ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে যান জুয়া খেলতে। সেখানে টাকার বস্তা নিয়ে যান তিনি।

সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথমসারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে।

এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’যোগে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হন যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমানুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম।

পঠিত : ১১২৪ বার

মন্তব্য: ০