Alapon

দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ব্যাধি এবং সামাজিক অবিচার দূরীভূত করনে কাজ করছে ব্র্যাক



ব্র্যাক একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারিভাবে অলাভজনক উন্নয়নমূলক সংস্থা। ব্র্যাক বাংলাদেশে ৪৭ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্র্যাক ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাদের কর্মসূচি পরিচালনা করছে। ২০০১ সালে স্থাপন করা হয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। শিক্ষা উন্নয়ন এবং গভর্নেন্স স্টাডিজ নামে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রয়েছে দুটি আলাদা ইনস্টিটিউট। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন হিসেবে দেশে ও বিদেশে এর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।


ব্র্যাক কী:
ব্র্যাক দরিদ্র মানুষের সমস্যা সমাধানকল্পে নানা ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করে , যাতে তারা তাদের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। ব্র্যাকের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ।

কোনো একটি কর্মপরিকল্পনা ছোট আকারে গ্রহণ করে, পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তার উৎকর্ষ সাধন করে এবং ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে, মান বজায় রেখে ব্যাপক আকারে সেই কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটানো।

কেবল বিস্তার ও কর্মপরিধির জন্য নয় বরং সদা উদ্ভাবনী মনোভাব এবং নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করে নেওয়ার বৈশিষ্ট্যের কারণেই ব্র্যাক স্বতন্ত্র। ব্র্যাক বিশ্বাস করে, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মূল চালক সে নিজেই। ব্র্যাক থাকে সহায়কের ভূমিকায়।
ব্র্যাক একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারিভাবে অলাভজনক উন্নয়নমূলক সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে অবস্থিত ২০১৬ইং সালের কর্মী সংখ্যা অনুসারে বেসরকারিভাবে এটি বিশ্বের একটি বৃহত্তম উন্নয়নমূলক সংস্থা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ইং সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার ১৪ টি দেশে এটির কার্যক্রম রয়েছে। ব্র্যাক এর দাবি অনুযায়ী বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠানে ১,০২,২৮১ জন কর্মী কাজ করে থাকেন। তবে এদের মধ্যে ৭০ ভাগই নারী কর্মী। ব্র্যাকের পরিসেবার আওতায় আছে ১২৬ মিলিয়ন লোক। একটি সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি স্ব-তহবিলযুক্ত দুগ্ধ, খাদ্য, কৃষি, গবাধি পশুর খামার ও হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।

রূপকল্প:
এমন একটি পৃথিবী যেখানে কোনপ্রকার শোষণ ও বৈষম্য থাকবে না এবং প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ থাকবে।

লক্ষ্য:
ব্র্যাকের লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, ব্যাধি এবং সামাজিক অবিচার দূরীভূত করে দরিদ্র মানুষ এবং জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্থ করা। সংগঠনের বিভিন্ন উদ্যোগের বিস্তার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা এবং সমাজের সকল নারী ও পুরুষকে তাদের সম্ভাবনা ও সামর্থ্য বিকাশে সক্ষম করে তোলাও ব্র্যাকের লক্ষ্য।

মূল্যবোধসমূহ:
সততা ও নিষ্ঠা
সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব
সার্বজনীনতা
কার্যকারিতা


ব্র্যাকের কাজ:
ব্র্যাক মনে করে দারিদ্র্য একটি অভিশাপ এবং এর কারণগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। এগুলোর কোন কোনটি আবার অনিবার্য। যেমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্পদহানি অথবা শারীরিক অসুস'তার কারণে দিনের মজুরি না পাওয়া। এ ছাড়া আরও নানা বিষয় দারিদ্র্যকে পরোক্ষভাবে টিকিয়ে রাখে। যেমন, আইন ও অধিকারবিষয়ে সচেতনতার অভাব। এর ফলে মানুষ সরাসরি শোষিত হয়। সে কারণে ব্র্যাক বিশ্বাস করে এই সমস্যার কোন ম্যাজিক সমাধান নেই। বিভিন্ন দিক থেকে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যকে মোকাবেলা করা জরুরি। সেজন্য ব্র্যাকের কর্মসূচিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

১. দারিদ্র্য হ্রাস: অতিদারিদ্র্য দূরীকরণে বিশেষ একটি কর্মসূচি সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখায়। জনগোষ্ঠীকে নিজের অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিতে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি মৌসুমি ঋণ ও উন্নত বীজ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটায়।

২. সামাজিক নিরাপত্তা ও দক্ষতা তৈরি: উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে বিভিন্ন রোগবালাই, অপরিচ্চছন্নতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য রয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।

৩. সংগঠন: মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে সংগঠিত করে তোলার জন্য আছে মানবাধিকার, সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার জাস্টিস ও ডাইভার্সিটি কর্মসূচি।

মূল কর্মসূচির বাইরেও ব্র্যাক বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ পরিচালনা করে। এই উদ্যোগগুলো কৌশলগতভাবে ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাজারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করে দেয়। এর ফলে তাদের সদস্যদের সম্পদ ও শ্রমের উ্‌পাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমে আসে। কৃষি থেকে কারুশিল্প পর্যন- এইসব উদ্যোগ দিনদিন তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলছে।

ইতিহাস:
বর্তমান সময়ের ব্র্যাক প্রতিষ্ঠানটি পূর্বে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি নামে। মূলত এটি গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার সহায়তার জন্য। শাহ ফজলে হাসান আবেদ তখন সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলা ছোট আকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই ত্রাণ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে যুদ্ধের সময় ধ্বংস কবলিত হওয়া মোট ১৪ হাজার ঘরবাড়ি পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি কয়েক শত মাছ ধরার নৌকা পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল। ব্র্যাকের দাবি অনুযায়ী মাত্র ০৯ (নয়) মাসের মধ্যে এই উন্নয়নমূলক কাজগুলো করা হয়েছিল। এছাড়াও তখন বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানসহ চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছিল।

ব্র্যাক ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি উন্নয়ন, মৎস্য, সমবায়, গ্রামীণ কারুশিল্প, বয়স্কদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারীর জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামের উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সামাজিক উন্যয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মূল্যায়ন এবং নির্দেশনা নির্ধারনের জন্য একটি গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ (রেড) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৭৭ সালে ভূমিহীন, গরিব কৃষক, কারিগরি ও দুর্বল নারীদের সহায়তা করার জন্য গ্রাম সংগঠন (ভিও) তৈরি করা হয়েছিল। এরপর একই বছর আবার ব্র্যাক তার কার্যক্রমের অর্থায়নের জন্য একটি বাণিজ্যিক অর্থভাণ্ডার স্থাপন করেছিল। যা পরবর্তী বছর আড়ং নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু একটি প্রধান কারণ ছিল ডায়রিয়া। ১৯৭৯ইং সালের ফেব্রুয়ারিতে শাল্লা উপজেলার ০২ (দুই) গ্রামে ব্র্যাক ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে প্রচারণার শুরু করে। প্রচারণাতে গ্রামীণ মায়েদেরকে তাদের ঘরে থাকা উপাদান থেকে কিভাবে ডায়রিয়া নিরাময়ের ঔষদ (ওআরএস) তৈরি করা যায় এবং ডায়রিয়া হলে কিভাবে ঔষধ সেবন করতে হয় তা শেখানো হয়েছিল। এই প্রচার করা হয়েছিল পোস্টার, রেডিও ও টিভির মাধ্যমে। প্রায় দশ বছরের এই কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল (বেসামরিক অস্থিরতার কারণে কাজ করতে অনিরাপদ ছিল) ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি অংশে ৭৫,০০০ গ্রামে এই কর্মসূচি পরিচালিত হয়। ফলে বর্তমানে মায়েদের বেশিরভাগই এখন নিরাপদ ও কার্যকর ওআরএস তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে ওটিইপি শুরু হওয়ার সময় এই চিকিৎসাটি খুব কমই পরিচিত ছিল। কিন্তু ১৫ বছর পরে গ্রামাঞ্চলে এটি ৮০% চেয়ে বেশি ক্ষেত্রে গুরুতর ডায়রিয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ হারের মধ্যকার একটি।

কার্যক্রম:
১৯৮৫ইং সালে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাদান শুরু করে,
১৯৮৬ইং সালে ব্র্যাক তার গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচী শুরু করে
১৯৯১ইং সালে তারা নারী স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করে।
১৯৯৬ইং সালে ব্র্যাকে সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনী সেবা কার্যক্রম চালু করে।
১৯৯৮ইং সালে ব্র্যাকের দুগ্ধ এবং খাদ্য প্রকল্প শুরু করে। একই বছর একটি তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট চালু করে।
২০০১ইং সালে ব্র্যাক একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ।

পুরোস্কার:
১. এনজিও এডভাইসর কর্তৃক বিশ্বের এক নম্বর এনজিও, ২০১৬,২০১৭,২০১৮
২. স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৭)

পঠিত : ১১০৪ বার

মন্তব্য: ০