Alapon

পেশীশক্তির রাজনীতিঃ সেক্যুলার থেকে ইসলামপন্থী...


ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বাদ দিন, কর্তৃত্বের প্রয়োগ অথবা ক্ষমতার প্রয়োগ সম্পর্কে আপনারা কি ভাবেন? মনে করে দেখুন, জীবনে কতবার বাবা-মায়ের হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়ার মতো অপরাধ করেছেন এবং সেটা জানার পরেও বাবা মা আপনাকে সাশন করেন নাই। ভাবুন আপনার সেই শিক্ষকদের কথা, যারা প্রহার করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও কদাচিতই গায়ে হাত তুলতেন। আজকে সেই শিক্ষকদেরকে আপনি কতটা শ্রদ্ধা করেন?

কথাটা এজন্যেই বলছি, ইসলাম পন্থীদের এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাঁরা ক্ষমতা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব কিন্তু ক্ষমতার ব্যবহারের সীমা পরিসীমা সম্পর্কে তাঁরা সম্পুর্ন অজ্ঞ। আমি হলপ করে বলতে পারি- পাওয়ার এক্সারসাইজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের (ইসলামী ও অনৈসলামী) কোনও দলের মধ্যেই মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। দমন নিপীড়নের বাসনা সবার মনের গহীনে সুনিপুন ভাবে লালিত হয়ে আসছে বহুকাল থেকে।

সেক্যুলার দলগুলো ক্ষমতায় গেলে কি করতে পারে তাঁর নমুনা আমাদের সামনে পরিষ্কার। ভাববেন না ইসলামী দলগুলো এর চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু হবে। বিষয়টা বুঝতে হলে আপনাকে শুধু তাকাতে হবে সেই জায়গা গুলোতে, যেখানে যেখানে একেকটি ইসলামী দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম আছে। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্রইউনিয়ন যেভাবে শিবির তাড়ায় তেমনি শিবিরও তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাম্পাস গুলো থেকে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্রইউনিয়ন কে তাড়িয়েছে। কিন্তু মাত্রার দিক থেকে শিবিরের আগ্রাসন নিঃসন্দেহে অন্যান্য সেক্যুলারদের চাইতে ব্যাপক হারে কম ছিল। শিবির যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছে তখন সে সব ক্যাম্পাসে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনকে লুকিয়ে লুকিয়ে সংগঠন করতে হয় নাই। শিবির নিয়ন্ত্রিত প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কমিটি প্রকাশ্য ছিল। পক্ষান্তরে অন্যান্য ছাত্রসংগঠন যেখানে নিয়ন্ত্রনে ছিল তখন শিবিরকে চলে যেতে হয়েছে অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে। বর্তমানে তো তারা শতভাগ আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে।

একই সাথে আপনি যদি দেখেন চরমোনাই, সারছিনা, মোকারা, লালবাগসহ যত কওমি মাদ্রাসা আছে, সেখানে যে দলের আধিপত্য সে দলের বাইরে আর কেউ কোনও প্রকার একটিভিটিজ পরিচালনা করতে পারে না। সেই সব প্রতিষ্ঠান আরও কয়েক কাঠি সরেস, সেখানকার শিক্ষকরাই নির্যাতন (উনাদের কথায় শালিশ) করে প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্নমত দমন করেন। এইসব প্রতিষ্ঠানে মারামারির সুযোগ থাকলে সেখানেও লাশ পড়তো। কিন্তু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলিমদের সম্মানের কারনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সেখানে শক্তির মহড়া দেখানোর গ্রাউন্ড একেবারেই থাকে না। একইসাথে, প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্র- সব মিলে এক্সট্রিমলি হোমোজেনিয়াস একটা পরিবেশ সেখানে থাকে। ভিন্নমত সেখানে সব সময়েই গর্তের ইদুরের মতো বাস করে। এসব কারণে সেখান সব মতের সমান দৌড় থাকে না। যদি এটা থাকতো তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে এই প্রতিষ্ঠান গুলোতে মারামারি বেশিও হতে পারতো।

যাইহোক, আসুন আবার ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া যাক। মাইরপিটের দিক থেকে কোনও ছাত্রসংগঠনই মুক্ত নয়। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রইউনিয়ন ও শিবির- সবাই মারামারি করে থাকে। কিন্তু এখানে শিবিরের বিষয়টা একতরফা ভাবে বাঁকা চোখে দেখা হয়। অথচ দলটিকে একইসাথে অন্য সব সেক্যুলার দলকে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। শিবির কে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে কেউই খালি হাতে মাঠে নামে না। ফলে শিবিরকেও নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্রইউনিয়ন যেহেতু একই সেক্যুলার মায়ের সন্তান সেহেতু তাঁরা বিভিন্ন ভাবে একজোট হয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু শিবির যেহেতু সেক্যুলার মায়ের সন্তান নয় সেহেতু শিবিরের সাথে তাঁদের কোনও স্বার্থ ভাগাভাগি হয় না বললেই চলে। এছাড়াও ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ শিবিরের চাইতে বড় দল। তাঁরা যখন অস্ত্র হাতে মাঠে নামে তখন শিবিরের পক্ষে খালি হাতে জিকির করার প্রশ্নই উঠে না। এটা শ্রেফ আত্মহত্যার নামান্তর। ফলে দেশের ছাররাজনীতিতে পেশীশক্তি ও অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে হলে সবার আগে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগকেই অস্ত্র ছাড়তে হবে যাতে ছোট দলগুলোর মধ্যে জানের ভয় না থাকে। এছাড়া ২য় কোনও পথ খোলা নেই।

ক্ষমতা বলতে আমরা কি বুঝি? উত্তর পেতে হলে চলে যেতে হবে আগের প্রশ্নে। সেটা হল- আমাদের নিয়ন্ত্রিত অঙ্গনে আমরা কি আচরণ করি? এই প্রশ্নের উত্তর আগেই পরিশকার করেছি। ইসলাম পন্থীদের কথা বলছি, আমরা কেউই সহনশীল না। আমাদের অঙ্গনে অন্য ইসলাম পন্থীদের প্রবেশ সম্পুর্ন নিষেধ। এমনকি যেখানে সেক্যুলাররাও দলমত নির্বশেষে আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়, সেখানে আমরা একে অন্যের ছায়াও মাড়াতে পছন্দ করি না। উই আর সাচ এ ছোটলোক।

ইসলাম কায়েমের ধারণা নিয়ে যদি আপনি ইসলাম পন্থীদের মধ্যে জরীপ করেন তাহলে তাঁরা এক লাফে দশ তলার বিষয়টা চিন্তা করে। যেমন আজান হইলে অফিস আদালত দোকান পাট বন্ধ করে দিবে, মেয়েদেরকে জোর করে বোরকা পড়াবে, এইটা নিষিদ্ধ করবে, ঐটা নিষিদ্ধ করবে, এই শাস্তি কায়েম হবে, ঐশাস্তি কায়েম হবে। ইসলাম কায়েম বলতে প্রথমেই তাঁদের মাথায় এগুলো ভেসে আসে। এগুলো সব ইনফোর্সমেন্ট তথা চাপিয়ে দেয়ার সাথে সম্পৃক্ত। একজন মুসলমান হিসেবে আমি কোরআন হাদিসেরর আলোকে প্রতিষ্ঠিত এসব বিধানের প্রতি ইমান রাখি এবং পাশা পাশি এটাও মনে করি যে- এগুলো জোর করে প্রতিষ্ঠার বিষয় নয়। এগুলো আরোপের আগে সমাজ ও সংস্কৃতিকে একটা উপযুক্ত মানে উন্নীত করা বেশি প্রয়োজন। আমার হাতে ক্ষমতা আসলেই আমাকে প্রথমেই এগুলো করতে হবে এমন মানসিকতা থেকেই মূলত আমরা আমাদের নিজস্ব পরিসরে অসহনশীল। আমাদের অঙ্গনে ভিন্নমতাবলম্বী সেক্যুলার তো দুরের কথা ইসলাম পন্থীরাই ঠাই পায় না। এই মানসিকতার কারণে একটা ছেলে নামাজ না পড়লে তাঁর গায়ে হাত তোলা, প্রেম করলে পিটানো, সিনেমা দেখতে গেলে মাইর... এরকম হরেক রকম ঘটনা ইসলামীদল গুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রনাধীন প্রতিষ্ঠান গুলোতে ঘটিয়ে থাকে। অথচ আইনগত ভাবে তাঁদের সেই অথোরিটি নেই। তো যখন তাঁদের হাতে অথোরিটি আসবে তখন তাঁরা কি করবে? এই প্রশ্নে ইসলাম পন্থীরা আজ অবধি মানুষকে কোনও পরিশকার ধাওরণা দিতে পারে নাই।

এভাবে আমরা দেখতে পাই, ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা মৌলিক ভাবে কেউ কারও চাইতে ভিন্ন নই। সেক্যুলাররা ভিন্নমত দমনে যেমন অমানবিক ও অসহনশীল তেমনি ইসলাম পন্থীরাও ভিন্নমত দমনে তেমন অমানবিক ও অসহনশীল। মৌলিক ভাবে এই দুই ধারার মধ্যে এক্ষেত্রে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত অঙ্গনে এই দুই ধারার আচার ব্যবহার কম বেশি একই রকম। সে ক্ষেত্রে ইসলাম পন্থীরা সেক্যুলারদের চাইতে কম অথোরিটি, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ হোল্ড করে। যদি তাঁরা সেক্যুলারদের মতো অথোরিটি, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ হোল্ড করতো তাহলে তাঁরা সেক্যুলারদের ছাড়িয়ে যেতো বহু আগেই। কিসের ভিত্তিতে একথা বলছি? সেক্যুলাররা তো অন্তত নিজেরা নিজেরা (ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রইউনিয়ন) একসাথে মিলে অনেক কাজ কর্ম করে কিন্তু ইসলামপন্থীরা একে অপরের ছায়াই দেখতে পারে না। সুতরাং বুঝাই যায় ইসলাম পন্থীরা যতটুকু ভালো সেটা নিতান্তই সুযোগের অভাবে।

লিখেছেন: জাবাল আত তারিক

পঠিত : ১৩১১ বার

মন্তব্য: ০