Alapon

দ্বিজাতি তত্ত্ব চিন্তার মূল দায়ভাগ কার?


কারা দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক?

দ্বিজাতি তত্ত্ব ভারত ভাগের ক্ষেত্রে একটি প্রধান আলোচনার বিষয়। জিন্নাহকে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক বলা হয়। ভারত ভাগের জন্য জিন্নাহর এই দ্বিজাতি তত্ত্বকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বহু বহু বছর ধরে এই কথা ইতিহাসে বলা হয়েছে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলে ভারত ভাগ করেছে। বহু ইতিহাস লেখক কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে ভারত ভাগের সকল দায় জিন্নাহর কাঁধে চাপিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস গ্রন্থে বর্তমানেও তাই রয়েছে। কিন্তু বহু ইতিহাসবিদ সত্যানুন্ধান করে নতুন কথা বলে গেছেন। জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেন উনিশশো চল্লিশ সালে। কিন্তু তার আগে বহুবার দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেছেন বর্ণ হিন্দুরা। জিন্নাহ হিন্দুদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বহু পরে দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেন মাত্র। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার উনিশশো সাঁইত্রিশ সালের ত্রিশে ডিসেম্বর হিন্দু মহাসভার সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রধানত দুটি জাতি ভারতবর্ষে, হিন্দু এবং মুসলিম।’ তিনি পুনরায় উনিশশো আটত্রিশ সালে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষে, আমাদের হিন্দুস্থানে হিন্দুরাই হলো প্রধান জাতি আর মুসলমানরা সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী।’ হিন্দু মহাসভার উনিশশো ছত্রিশ সালের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হিন্দুদের মনে রাখা উচিৎ যে হিন্দুস্থান একমাত্র হিন্দুদের নিজস্ব বাসভূমি এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য হলো আর্য সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্মের বিকাশ সাধন। ভারত একমাত্র হিন্দুদেরই দেশ এবং হিন্দু সংস্কৃতির বাহক। [রাশিয়ার গবেষক: এ. জি. বেলস্কি, হিন্দু ধর্ম ও ভারতীয় হিন্দু সমাজ, কলকাতা: ভস্তক ১৯৯১, পৃ. ৪৩]

জিন্নাহ তখন পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে ছিলেন। তাঁর মনে বিশ্বাস ছিলো, কংগ্রেস আর গান্ধী মিলে এর একটা সুরাহা করবেন। ফলে তিনি হিন্দু মহাসভার উস্কানিকে এড়িয়ে গেলেন। সাভারকার সাঁইত্রিশ সালে আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের তত্ত্বকে এক সম্পূর্ণ ও সর্বব্যাপী রূপ প্রদান করেন। তিনি ভারতে হিন্দুজাতির অস্তিত্ব বিষয়ক তত্ত্বের মূল বক্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি বললেন, সেই তত্ত্বের বনিয়াদ হলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত চারটি বিশ্বাস: হিন্দু, হিন্দুধর্ম, হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাজ। সাভারকারের মতে হিন্দুস্তানে উদ্ভুত যে কোনো ধর্মের মানুষই হিন্দু। যেমন হিন্দু, শিখ, বুদ্ধ, জৈন। কিন্তু মুসলমান আর খ্রিষ্টানরা নয়। সেই সঙ্গে তিনি দাবি তোলেন যে হিন্দুরাই হিন্দুরাষ্ট্রের পুরোদস্তুর নাগরিক। হিন্দুদের পবিত্র ভূমির উপর দাবি উত্থাপনকারী মুসলমানদের তিনি “বিদেশী” আখ্যা দিয়ে ‘অখণ্ড ভারত’ ধ্বনি তোলেন। সাভারকারের মতে, স্বাধীন ভারতই জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র অথবা হিন্দুরাজই হতে পারে। [ এ. জি. বেলস্কি, হিন্দু ধর্ম ও ভারতীয় হিন্দু সমাজ, কলকাতা: ভস্তক ১৯৯১, পৃ. ৪৪-৪৫] কিছুদিন পর বলা হলো, হিন্দুরাই ‘প্রথম শ্রেণীর নাগরিক’ আর মুসলিম সম্প্রদায় হলো ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’। অতএব সর্বাগ্রে মুসলিমদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে হবে। মুসলমানদের ভারতে থাকতে হলে, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেই থাকতে হবে। [ সুজিত সেন সম্পাদিত বিষয় সাম্প্রদায়িকতা: ফিরে দেখা কলকাতা: মিত্রম ২০০৮, পৃ. ৮১]

কিন্তু তারও বারো বছর পূর্বে উনিশশো চব্বিশ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার নেতা লালা লাজপত রায় “ইরাবতী থেকে ব্রহ্মপুত্র” নামে ধারাবাহিকভাবে ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় তেরোটি প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে তিনি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ভারত ভাগের কথা উচ্চারণ করেন। ’[মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়, জাতীয়তাবাদী জিন্নাহ, কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০১, পৃ. ১৪১] তিনি সেখানে হিন্দু ভারত মুসলিম ভারত কথাটি প্রথম উচ্চারণ করেন আর হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার জন্য দরকার বোধে বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ করার কথা লিখেছিলেন। [যশোবন্ত সিংহ, জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা, বঙ্গানুবাদ, কলকাতা: আনন্দ ২০০৯, পৃ. ১১] লাহোরের প্রতাপ পত্রিকায় হিন্দু মহাসভার নেতা লালা হরদয়ালের একটি প্রবন্ধে ভয়াবহ উগ্র আত্মম্ভরিতা প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ঘোষণা করেন যে, হিন্দুস্থানের এবং পাঞ্জাবের হিন্দু জাতির ভবিষ্যত চারটি স্তম্ভের উপর উপর নির্ভরশীল। হিন্দু সংগঠন, হিন্দু রাজ, হিন্দুস্থানের মুসলমানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা প্রদান এবং আফগানিস্তান ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলি জয় করে সেইসব দেশের মানুষকে হিন্দুধর্মে দীক্ষা দান। না হলে হিন্দুরা সবসময় বিপদের মধ্যে থাকবে এবং হিন্দু জাতির অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। উনিশশো পঁচিশ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার পরবর্তী অধিবেশনে বলা হয়, ‘বলপ্রয়োগ করে যেসব হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়েছে, তাদের আবার হিন্দুধর্মের ছত্রছায়ায় ফিরিয়ে আনতে হবে; হিন্দি ভাষা জনপ্রিয় করতে হবে এবং হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠানের প্রসার ঘটাতে হবে। [ এ. জি. বেলস্কি, ‘হিন্দু ধর্ম ও ভারতীয় হিন্দু সমাজ,কলকাতা: ভস্তক ১৯৯১, পৃ. ৪০-৪২]

সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেয়া কারা শুরু করলো প্রথমে? কতোটা উগ্র ছিলো সেই বক্তব্য? ভারতের সকল মুসলমানকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এ ধরনের কথা কি উস্কানিমূলক ছিলো না? এইরকম বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা তৈরি করা হয়নি? হিন্দুরা কোনো সম্প্রদায় নয়, হিন্দুরা একটা জাতি, হিন্দু মহাসভা বারবার সেই কথাই বলছিলো। কংগ্রেস এবং গান্ধীর ভূমিকা তখন কী ছিলো? গান্ধী বা কংগ্রেস কি এই সব বক্তব্যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো? জিন্নাহ তখন মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তিনি এইসব উস্কানিকে প্রশ্রয় না দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলন ঘটাতে ব্যস্ত, তিনি তখনো চাইছেন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ এক সঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিক। জিন্নাহ এই সময় যখন বারবার কংগ্রেসকে লখনৌ চুক্তি মেনে নিতে বলছিলেন বা সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার প্রস্তাব উত্থাপন করছিলেন। হিন্দুরা যখন হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার কথা বলছে, কিংবা মুসলমানদের হিন্দু বানিয়ে ফেলতে চাইছে, এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত দখল করতে চাইছে সেখানকার মুসলমানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষা দেবার জন্য, সেটা কংগ্রেসের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। হিন্দুরা যখন নিজেদের হিন্দু জাতি বলছে, তখন কি মুসলমানদের ভিন্ন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না? দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণা তাহলে কাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিলো?

[ খুব সংক্ষিপ্ত করে লিখলাম। মনে করলাম সকলের পড়া দরকার। সূত্র হিসেবে কথাগুলি আরো পাওয়া যাবে শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার ঘোষ, সুকান্ত পাল, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাভারকারের রচনা সমগ্র, রাশিয়ার আর দুজন গবেষক সহ বহু জনের গ্রন্থে।]

লিখেছেন: Raahman Chowdhury

পঠিত : ৭৯৩ বার

মন্তব্য: ০