Alapon

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবরারদের খুন হয়ে যাওয়া বন্ধ হোক



জঙ্গিদের হাতে ফয়সাল আরেফিন দীপনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে তার পিতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মৃত্যুর বিচার দাবি করেননি। তিনি বলেছেন—‘আদালতে ফাঁসি বা জেল দিয়ে যে বিচার, তার ওপর তার আস্থা নেই। আমাদের জাতীয় জীবনের সমস্যা এত গভীর যে, শুধু জেল-জুলুম বিচার-ফাঁসি এগুলো দিয়ে কিছু হবে না।’ সম্ভবত অধ্যাপক কাসেম দেশের অরাজক অবস্থা থেকে বিচারের দাবি পরিত্যাগ করেছিলেন। কারণ এদেশে একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হতে ন্যূনতম ২০ বছর সময় লাগে। হয়তো কাসেম সাহেব তখন বেঁচে নাও থাকতে পারেন। দীপনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে ঠিক চার বছর আজ। তার বিচারের তো এখনও কূলকিনারা নেই।

আবরারের পিতা-মাতা অবশ্য বিচার দাবি করেছেন। তারা যেন তাদের নিরীহ সন্তানের অকাল মর্মান্তিক মৃত্যুর সঠিক আর দ্রুত বিচার পান। আবরারের পিতা বরকত উল্লাহ, মা রোকেয়া বেগম ও ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ ১৪ অক্টোবর গণভবনে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরারের পরিবারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কোনও সান্ত্বনাই আপনাদের যন্ত্রণা প্রশমন করতে পারবে না। কিন্তু সরকার এজন্য তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। খুনিদের গ্রেফতার করেছে। দ্রুত তাদের বিচার শুরু হবে।’

ঘাতকরা আবরারকে হত্যা করেছে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য। তারা সন্দেহ করেছে আবরার ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অথচ সংবাদে দেখলাম সে তাবলিগে যেত। আমি জানি তাবলিগের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের অহিনকুল সম্পর্ক। জামায়াতিরা তাবলিগ পছন্দ করে না। তারা মনে করে ইসলামের পরিপূর্ণ খেদমত তারাই করে, আর সব বাতিল পন্থা। অথচ ইসলামের উত্তম কাজ এখনও যা হচ্ছে সেটা তাবলিগই চেষ্টা করছে। মূলত তাবলিগিরা মানুষের অন্তরে আল্লাহ ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে, যা মানুষকে জালেম হওয়া থেকে বিরত রাখে। এই সমাজের জন্য বর্তমান সময়ে যা খুবই প্রয়োজন। কারণ আমাদের সমাজে জাহেলিয়া যুগের বদস্বভাবগুলো ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে। তা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে।

আমি গত ২৫ বছরব্যাপী পত্রিকায় লেখালেখি করছি। বর্তমানে জীবিত নেতাদের মধ্যে শেখ হাসিনাকেই উত্তম মনে করি বলে তার কর্মকাণ্ডের সমর্থন করে অনেক সময় লিখেছি। তিনি পূর্বে উত্তম ছিলেন, এখনও উত্তম আছেন। তিনি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর লিখেছিলাম, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে সংগঠনের কর্মীরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। কর্মীরা পার্থিব লাভালাভের ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। আর সংগঠনের কাজকর্মে স্থবিরতা আসে। সংগঠনের কর্মীদের বিবেক-বিবেচনা রহিত হয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন জনগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘তারা তখন সন্ধ্যাবাতি দিতে গিয়ে ঘরের চালায় আগুন দেয়।’ এখন তো সন্ধ্যাবাতি দিতে গিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগ ঘরের চালায় আগুন দিয়েছে। এদিকে, ডাকসু সিদ্ধান্ত নিয়েছে ধর্ম নিয়ে যেসব দল রাজনীতি করে, যেসব ছাত্র সংগঠন তাদের তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতে পারবে না। অথচ নির্বাচন কমিশন তাদের মূল দলকে নিবন্ধন প্রদান করেছে। নির্বাচন কমিশন বড়, নাকি ডাকসু বড়? বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় একেই বলে। অবশ্য তারা দাবি করতে পারে ক্যাম্পাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাখে।

এখন অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ছাত্র মিছিল করছে। শুনেছি উপাচার্যরা খারাপ লোক, সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আঁতাত করে তারা নাকি উন্নয়নের টাকা হাতিয়ে নেয়। এটা নাকি এখন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সে রকম ‘ফেয়ার শেয়ার’ চেয়েছিল। তারা উপাচার্যকে বলেছে, আপনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। আমাদেরও উন্নয়ন বাজেটের ৫ শতাংশ দেন। এটাকে তারা নাম দিয়েছে ‘ফেয়ার শেয়ার’। একথা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন। ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে প্রধানমন্ত্রী বিদায় করে দিয়েছেন। এ অবস্থা যদি হয় দেশের, তবে দেশের ভবিষ্যৎ কী!

বলেছিলাম আবরারের মৃত্যু আর বুয়েটের কথা। আমার জ্যাঠাত বোনের স্বামী প্রফেসর আব্দুল কাদের চৌধুরী আজীবন বুয়েটে অধ্যাপনা করেছেন। মেধাবী লোক, জীবনে কোনোদিন সেকেন্ড হননি। আল্লাওয়ালা মানুষ ছিলেন। মাঝে মাঝে অবকাশে তাবলিগে যেতেন। একবার এক ছাত্রের ভর্তির ব্যাপারে আমি অধ্যাপক কাদের সাহেবের লালমাটিয়ার বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি আমার কথা শুনে বলেছিলেন, এটি দেশের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও ঠিক আছে। আর এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিয়ে গোঁজামিল করার প্রস্তাব দিতে তুমি আমার কাছে এসেছ? আমার কাজ তো হয়নি বরং অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলাম।

এরপর যতবার বুয়েটের পাশের রাস্তা দিয়ে কোনও কাজে গিয়েছি, তখন ওই অধ্যাপক কাদের সাহেবের কথা আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আর বুয়েট সম্পর্কে আমার হৃদয়ে এক শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি হয়েছে।

আবরারের মৃত্যুর পর বুয়েটের সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মুখে যা শুনলাম, তাতে মর্মাহত হলাম। এখন নাকি বুয়েটে বিরাট সংখ্যক ছেলে নেশা করে। সন্ধ্যার পরে মাঠে বসে মজলিস করে মদ খায়। প্রত্যেক হলে হলে নির্দিষ্ট রুম আছে, যেখানে ছেলেরা বসে আড্ডা দেয় আর নেশা করে। সাধারণ ছাত্ররা বলল—যারা আবরারকে হত্যা করেছে, তারাও নেশা অবস্থায় আবরারকে মেরেছে। অবশ্য নেশাগ্রস্ত না হলে এত নির্মম হয় কীভাবে!

বুয়েটের উপাচার্য খুবই জ্ঞানী লোক। সহজ-সরল ধরনের। তারও পদত্যাগ দাবি করেছেন ছাত্র-শিক্ষকেরা। এখানে তার অপরাধ—তিনি শক্ত হতে পারেন না। অবশ্য বুয়েটের উপাচার্য ক্ষমা চেয়েছেন ছাত্রদের কাছে। আশা করি ছাত্র-শিক্ষকরা অনুরূপ একজন উপাচার্যের প্রতি বিরাগ হয়ে কোনও নির্মম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না।

গত ৪৮ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন ছাত্র খুন হয়েছে। এটা ক্রমবর্ধমান। মৃত্যুর চেয়েও অধিকতর ভীতির কারণ হচ্ছে মৃত্যুভয়ের উন্মাদনা এবং বিকার। বর্বর র‌্যাগিং সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। জোর করে শ্রদ্ধা আদায়ের তালিমটার মধ্যে নির্মমতা আছে। নির্মমতা শ্রদ্ধা আদায়ের পন্থা হতে পারে না। বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য দৃঢ়ভাবে পণ করেছেন। র‌্যাগিং বন্ধেও উভয়ের দৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, র‌্যাগিং বন্ধ নাকি কঠিন ব্যাপার। আমার মনে হয় ছাত্র-শিক্ষক দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকলে কোনও কিছুই কঠিন হবে না। গোষ্ঠীবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করতে হবে। সর্বত্র আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক’দিন পরে ছাত্র-শিক্ষকের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে শিথিলতা এলে চলবে না। সংকল্পবদ্ধ গোষ্ঠীকে কেউ পরাভূত করতে পারে না। আবরারের মৃত্যুতে বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকের যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা দিয়ে অনাচারের অবসান ঘটাতে পারলে আবরারের প্রতি সুবিচার করা হবে। তার আত্মত্যাগকে স্মরণ করা হবে।

পঠিত : ৬২৯ বার

মন্তব্য: ০