Alapon

বাংলার স্বাধীন নবাবেরা যেমন ছিলেন



শায়েস্তা খানের পর এদেশে আর যোগ্য ও দক্ষ সুবাহদার আসেননি। গতানুগতিক কয়েকজন সুবাহদার এসেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন করতলব খান বা মুর্শিদকুলি খান। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে মুর্শিদকুলি খান স্বাধীন নবাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

শায়েস্তা খানের পর ফিদা খান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মুহাম্মদ আজম পর পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৭৮ সালে মুহাম্মদ আজম সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের অবৈধ সুবিধা আদায়ের জন্যে মুহাম্মদ আজমকে একুশ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব তা জানতে পেরে তাকে পদচ্যুত করে পুনরায় শায়েস্তা খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। এ সময়ে ইংরেজদের ঔদ্ধত্য চরমে পৌঁছে। আকবর নামক জনৈক ব্যক্তি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ইংরেজগণ তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। শায়েস্তা খান এ ষড়যন্ত্র জানতে পেরে পাটনা কুঠির অধিনায়ক মিঃ পিকককে কারারুদ্ধ করেন। কোম্পানীর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডন থেকে ক্যাপ্টেন নিকলসনের নেতৃত্বে কয়েকখানি যুদ্ধ জাহাজ ভারতে প্রেরণ করা হয় এবং চট্টগ্রাম অধিকারের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন নিকলসন বিফল মনোরথ হন।

ইংরেজদের এহেন দুরভিসদ্ধির জন্যে নবাব শায়েস্তা খান তাদেরকে সুতানটি থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬৮৭ সালে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান জব চার্ণক নবাব প্রদত্ত সকল শর্ত স্বীকার করে নিলে পুনরায় তাদেরকে ব্যবসায় অনুমতি দেয়া হয়। নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলি জব চার্ণক কর্তৃক মেনে নেয়ার কথা ইংলন্ডে পৌঁছলে কোম্পানীর কর্মকর্তাগণ এটাকে অবমাননাকর মনে করে। অতঃপর তারা ক্যাপ্টেন হীথ নামক একজন দুর্দান্ত নাবিকের পরিচালনাধীনে ‘ডিফেন্স’ নামক একটি রণতরী বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে প্রেরণ করে। হীথ সুতানটি পৌঁছে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য কোম্পানীর লোকজনসহ বালেশ্বর গমন করে। এখানে তারা জনগণের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। অতঃপর হীথ বালেশ্বর থেকে চট্টগ্রাম গমন করে আরাকান রাজের সাহায্য প্রার্থনা করে। এখানেও সে ব্যর্থ হয় এবং নিরাশ হয়ে মাদ্রাজ চলে যায়। তাদের এসব দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র জানতে পেরে সম্রাট আওরঙ্গজেব ইংরেজদের মসলিপট্টম ও ভিজেগাপট্টমের বাণিজ্য কুঠিসমূহ বাজেয়াপ্ত করেন। এভাবে কোম্পানী তাদের দুষ্কৃতির জন্যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

শায়েস্তা খানের পর অল্পদিনের জন্যে খানে জাহান বাংলার সুবাদার হন এবং ১৬৮৯ সালে ইব্রাহীম খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। এ দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারকল্পে কোম্পানীর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয়। অতঃপর উড়িষ্যার বন্দী ইংরেজদেরকে মুক্তিদান করে জব চার্ণককে পুনরায় বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। জব চার্ণক পলায়ন করে মাদ্রাজ অবস্থান করছিল। ধূর্ত জব চার্ণক অনুমতি পাওয়া মাত্র ১৬৯১ সালে ইংরেজ বণিকদেরকে নিয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তণ করে এবং কোলকাতা নগরীর পত্তন করে নিজেদেরকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যে, এর সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজগণ বাংলা তথা সমগ্র ভারতভূমিতে তাদের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ অক্ষুণ্ণ রাখে।

এ সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ইস্তানবুলের শায়খুল ইসলাম বাদশাহ আওরঙ্গজেবকে জানান যে, ইংরেজরা ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ যবক্ষার সংগ্রহ করে তা ইউরোপে রপ্তানী করা হয় এবং তাই দিয়ে গোলাবারুদ তৈরী করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। আওরঙ্গজেব যবক্ষার ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু গোপনে তারা যবক্ষার পাচার করতে থাকে। অতঃপর ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসা নিষিদ্ধ করে বাদশাহ আওরঙ্গজেব এক ফরমান জারী করেন। হুগলী কুঠির প্রধান বাংলার সুবাদারের কৃপাপ্রার্থী হলে তিনি এ নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা হ্রাস করে দেন।

ইব্রাহীম খানের অযোগ্যতার কারণে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর স্থলে স্বীয় পৌত্র আজিমুশশানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। আজিমুশশান ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও অর্থলোভী। তার সুযোগে ইংরেজগণ তাঁকে প্রভূত পরিমাণে উপঢৌকনাদি নজরানা দিয়ে সুতানটি বাণিজ্যকুঠি সুরক্ষিত করার অনুমতি লাভ করে। তারপর পুনরায় ষোল হাজার টাকা নজরানা ও মূল্যবান উপহার দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম তিনটি লাভ করে।

১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যুর পর আজিমুশশানের পিতা বাহাদুর শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে পুনরায় আজিমুশশান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। অযোগ্য, অকর্মণ্য ও আরামপ্রিয় সুবাদারকে রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে মুর্শিদ কুলী খানকে দেওয়ান নিযুক্ত করে বাংলায় পাঠানো হয়। বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করা হয়। তবে দুবছরের মধ্যেই ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে আবার ফেরত আনা হয়। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে ফরোখশিয়ার কর্তৃক আজিমুশশান নিহত হন এবং ফরোখশিয়ার মুর্শিদ কুলী খানকেই বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। মুর্শিদ কুলী খান ইংরেজদের হাতের পুতুল সাজার অথবা অর্থদ্বারা বশীভূত হবার পাত্র ছিলেন না। অতএব তাঁর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভে ইংরেজগণ ব্যর্থ হয়। অবস্থঅ বেগতিক দেখে তারা সম্রাটের নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে হ্যাটিল্টন নামে একজন সুদক্ষ চিকিৎসক ছিল। বাংলার সুবাদার ছিলেন ইংরেজদের প্রতি বিরাগভাজন। তাঁর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে সম্রাট ছিলেন নারাজ। কিন্তু এখানে একটি প্রেমঘটিত নাটকের সূত্রপাত হয় যার ফলে ইংরেজদের ভাগ্য হয় অত্যন্ত সুপ্রসন্ন।

উদয়পুরের মহারাণা সিংহের এক পরম রূপসী কন্যার প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন যুবক সম্রাট ফরেখশিয়ার। বিবাহ স্থিরীকৃত হওয়ার পর হঠাৎ তিনি ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হন। বিবাহ অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত হয়ে যায়। কোন চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যামিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর মহারাণার কন্যার কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রিয়তমাকে লাভ করার পর সম্রাট ফরোখশিয়ার ডাঃ হ্যামিল্টনের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ইংরেজ বণিকদিগকে কোলকাতার দক্ষিণে হুগলী নদীর উভয় তীরবর্তী আটত্রিশটি গ্রাম দান করেন। তার নামমাত্র বার্ষিক খাজনা র্নিধারিত হয় মাত্র আট হাজার একশ’ একুশ টাকা। সম্রাটের নিকটে এতকিছু লাভ করার পরও মুর্শিদ কুলি খানের ভয়ে তারা বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেনি।

১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান বাংলার নাজিম পদে উন্নীত হন। তিনি অসংখ্য উপাধি ও পদবিতে ভূষিত হন। প্রথমে তিনি ‘জাফর খান’ উপাধি পান এবং পরে তাঁকে ‘মুতামিন-উল-মুলক আলা-উদ-দৌলা জাফর খান নাসিরী নাসির জঙ্গ বাহাদুর' উপাধি দেওয়া হয়। তাঁকে সাত হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যু হয়।

মুর্শিদকুলী খান কেবল বাংলার দীউয়ান ও সুবাহদার ছিলেন তা নয়, একই সময়ে তিনি ছিলেন উড়িষ্যার দীউয়ান ও সুবাহদার, বিহারের দীউয়ান এবং কয়েকটি জেলার ফৌজদার। তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল তিনটি প্রদেশ। এই সুবাদে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধ-ুবান্ধবদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। তারা তাঁকে রাজস্বসহ প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান পূর্ববর্তী টোডরমল ও শাহ সুজা প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত পদ্ধতির সংস্কার করে একটি নতুন বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। রাজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি ভূমির উৎপাদনক্ষমতা নিশ্চিত করেন এবং এভাবে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থা মাল জমিনী নামে পরিচিত, অর্থাৎ তিনি জমিদারদের উপর তাদের জমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর আমলে বেশ কিছু নতুন ও বৃহৎ জমিদারির পত্তন হয়।

মুর্শিদকুলী খানের আমলে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে বাংলার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আরব, পারস্য ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় বেশ সক্রিয় ছিল। সতের শতক থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি বাংলায় উৎপাদিত সুতা, রেশম ও তা থেকে উৎপন্ন বস্ত্রসামগ্রী ক্রয় শুরু করে। এসব ক্রয়ের জন্য তারা স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি করত। এর ফলে এদেশে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এই ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ব্যবসায়ী, সাহু বা পোদ্দার, মহাজন, বানিয়া ও দালালরা দ্রুত মহাজনি ব্যবসায় উন্নতি লাভ করে। এ ধরনের বহু মহাজনের মধ্যে জগৎ শেঠ অতি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। মুর্শিদকুলী খান বাণিজ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলিকে সৎ ব্যবসায়ে উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি অসৎ ব্যবসায়ীদের কঠিন শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন। মুর্শিদকুলী খান ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তিনি কলকাতার আশেপাশে বেশি গ্রাম ক্রয়ের অনুমতি দেননি, এমনকি কোম্পানির রাজকীয় ফরমান লাভের পরও তিনি অনমনীয় ছিলেন।

মুর্শিদকুলী খান মসজিদ নির্মাণে যত্নবান ছিলেন। তিনিই ঢাকার করতলব খান মসজিদ (বেগম বাজার মসজিদ) এবং মুর্শিদাবাদ মসজিদ নির্মাণ করান। ব্যক্তি-জীবনে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং স্বহস্তে পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরি করে তিনি পবিত্র স্থানে বিতরণ করতেন। মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। তার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের নামমাত্র আধিপত্য ছিল, সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন। তার পরিবার সম্পর্কে কয়েক প্রকার মতভেদ রয়েছে। প্রথম সংস্করণমতে মুর্শিদ কুলি খানকে, হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। ১৭১৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে কার্তালাব খান নামে ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত করেন ও বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন।

১৭২৫ সালে মুর্শিদকুলীর মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজাউদ্দীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদ অলংকৃত করেন। তাঁর আমলে ইংরেজরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ উন্নতি করে এবং তাদের ঔদ্ধত্যও বহুগুণে বেড়ে যায়। হুগলীর ফৌজদার একবার ন্যায়সংগত কারণে ইংরেজদের একটি মাল বোঝাই নৌকা আটক করেন। একথা জানতে পেরে ইংরেজরা একদল সৈন্য পাঠিয়ে প্রহরীদের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নিয়ে যায়। সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান সুবাদার নিযুক্ত হন। নাদির শাহের ভারত আক্রমণ তাঁর সময়ে হয়েছিল।

সরফরাজ খান ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বলচিত্ত। তাঁর সেনাপতি আলীবর্দী খানের সংগে সংঘর্ষে নিহত হন এবং আলীবর্দী খান ১৭৪১ সালে বাংলার সুবাদার হন। আলীবর্দী খানের সময় বার বার বাংলার উপর আক্রমণ চলে বর্গী দস্যুদের। তাদের দৌরাত্ম্য থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে তিনি কয়েকবার ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেন। দেশের আর্থিক উন্নতিকল্পে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দান করতেন।

১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলাদেশে মারাঠা আক্রমণ শুরু হয় এবং ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। প্রায় প্রতি বৎসরই মারাঠী সৈন্যরা এই আক্রমণ করতো। এই আক্রমণের সময় তারা ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ করতো। মূলত পশ্চিমবঙ্গেই এই আক্রমণ হতো। স্থানীয় লোকেরা এই আক্রমণের ভয়ে পূর্ব-বাংলার দিকে পালিয়ে যেতো। এছাড়া বহুমানুষ তখন কলকাতায় আশ্রয় নিতো। ফলে এই সময় পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে। ইতিহাসে এই আক্রমণকে 'বর্গীর হাঙ্গামা' নামে অভিহিত করা হয়।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাব হ্রাস হওয়ার পর, পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথ সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে মারাঠ সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বালাজী বিশ্বনাথের পুত্র পেশোয়া বাজীরাও এই বিষয়ে যত্নবান হন। হায়দ্রাবাদের নিজাম মারাঠী আক্রমণ থেকে নিজ রাজ্য রক্ষার জন্য, নাগপুরের স্বাধীন মারাঠী রাজা রঘুজী ভোঁসলেকে বাংলা আক্রমণে উৎসাহিত করেন। রঘুজী ভোঁসলে সাতরায় তার আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হলে বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ নেন। এই সময় পরাজিত রুস্তম জঙ্গও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রঘুজী ভোঁসলে -কে প্ররোচিত করেন।

১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী খাঁ উড়িষ্যা অভিযানে থাকার সময়, মারাঠী সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা আক্রমণ করেন এবং বিনা বাধায় বর্ধমান পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর তিনি কাটোয়া দখল করে নেন। এরপর মারাঠী সৈন্যরা আলীবর্দীর খাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে, দ্রুত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে মুর্শিদাবাদ শহর ও জগৎশেঠের কোষাগার লুণ্ঠন করে। এই সময় আলীবর্দীর খাঁ ফিরে এলে, ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে কাটোয়ায় ফিরে যান এবং সেখানে মারাঠী ঘাঁটি স্থাপন করে গঙ্গা নদীর পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হন।

১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণের উদ্যেশ্যে রওনা হন। এই সময় তাঁর প্রধান প্রতিবন্ধক ছিলেন বালাজী রাও। মোগল সম্রাটের অনুরোধে বালাজী রাও রঘুজী ভোসলেঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে, রঘুজী ভোসলেঁ নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ফলে রঘুজী ভোসলেঁর আক্রমণ থেকে আলীবর্দী খান রক্ষা পান। ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। মারাঠী সেনাবাহিনীর তুলনায় আলীবার্দী খাঁর সেনবাহিনী দুর্বল ছিল। এই কারণে আলীবার্দী খাঁ প্রতারণার আশ্রয় নেন। তিনি সন্ধির নাম করে ভাস্কর পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানান। পরে আফগান সেনাপ্রধান মুস্তফা খাঁর সহায়তায় ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করতে পারলে, আলীবর্দী খাঁ তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবেন, এই প্রতিশ্রুতি অনুসারে মুস্তফা খাঁ ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করলেও― আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নাই। এই কারণে মুস্তফা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুস্তফা নিহত হলে, বিহারের শাসনভার আলীবর্দী খাঁ'র পছন্দের শাসকের হাতেই রয়ে যায়।

ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যুর পর, রঘুজী ভোসলেঁ মারাঠী সৈন্যদের ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যার প্রতিশোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। রঘুজী প্রাথমিকভাবে উড়িষ্যা ও বিহার দখল করে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু আলীবর্দী খাঁরা বাধার মুখে পরাজিত হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান। ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রঘুজীর পুত্র জনজীর ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করে বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা দখল করে নেন। এরপর টানা তিন বৎসর মারাঠী সৈন্যদের সাথে আলীবার্দীর খাঁর যুদ্ধ হয়। এই সময় আলীবর্দী খাঁর শত্রু মীর হাবিব মারাঠী বাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং নবাবের বাহিনীর আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। নবাব এই বিদ্রোহ দমন করলেও, উড়িষ্যার পুরোপুরি মারাঠীদের দখলে চলে যায়।

১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনীর মধ্যে একটি সন্ধি হয়। এই সন্ধি অনুসারে, উড়িষ্যায় মারাঠীদের অধিকারে থেকে যায়। এছাড়া বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা মারাঠীদের কর প্রদানে আলীবর্দী খাঁ অঙ্গীকার করেন। কিন্তু বাংলাতে মারাঠীরা আর কখনো আক্রমণ করবে না, এই অঙ্গীকার মারাঠীরা প্রদান করে। এই সন্ধির মধ্য দিয়ে বর্গীর হাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আলীবর্দী খান ইংরেজ, ফরাসীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে তিনি ইংরেজদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল তিনি মুর্শিদাবাদে মৃত্যবরণ করেন।

তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তিন কন্যার নাম ছিল- মেহার উন-নিসা বেগম (ঘোশেটি বেগম), মুনিরা বেগম এবং আমিনা বেগম। আমেনা বেগমের বিবাহ হয়েছিল তাঁর কনিষ্ঠ ভাতিজা জৈনুদ্দিন আহমেদ খান-এর সাথে। আমিনা বেগমের গর্ভেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর নিজের কোন পুত্র সন্তান না থাকায়, আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করে গিয়েছিলেন।

সিরাজউদ্দোলার সিংহাসন আরোহণের পর আলীবর্দী-কন্যা ঘসেটি বেগম ও তার দৌহিত্র পুর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জং-এর সকল ষড়যন্ত্র তিনি দক্ষতার সাথে বানচাল করে দেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ করার সাথে সাথেই ঘেসেটি বেগম বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন এবং মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সিরাজদ্দৌলা ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগমের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বেগমকে রাজপ্রসাদে বন্দী করেন। অপরদিকে শওকত জং নিজেকে বাংলার সুবাদার বলে ঘোষণা করলে যুদ্ধে সিরাদ্দৌলা কর্তৃক নিহত হন।

ঘসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহে নওয়াজেশ মুহাম্মদের দেওয়ান রাজবল্লভ ইন্ধন যোগাচ্ছিল। সিরাজদ্দৌলা তা জানতে পেরে রাজবল্লভের কাছে হিসাবপত্র তলব করেন। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেশ মুহাম্মদের অধীনে দেওয়ান হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার তার উপরে ছিল। আদায়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিল বলে হিসাব দিতে অপারগ হওয়ায় নবাব সিরাজদ্দৌলা রাজবল্লভের ঢাকাস্থ ধনসম্পদ আটক করার আদেশ জারী করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভাবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদ সহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজদ্দৌলা ধনরত্মসহ পলাতক কৃষ্ণবল্লভকে তাঁর হাতে অর্পণ করার জন্যে কোলকাতার গভর্ণর মিঃ ড্রেককে আদেশ করেন। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও রাজ্যের মধ্যে অতি প্রভাবশালী হিন্দুপ্রধান মাহতাব চাঁদ প্রমুখ অন্যান্য হিন্দু বণিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজদ্দৌলার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তারপর অকৃতজ্ঞ ক্ষমতালিপ্সু ইংরেজগণ ও তাদের দালাল হিন্দু প্রধানগণ সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরদিরে জন্যে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয় –পলাশীর ময়দানে।

পঠিত : ১৮৪৩ বার

মন্তব্য: ০