Alapon

আমরা চোখের যিনাকে আদর করে 'ক্রাশ' বলি



সে আমার সম্পত্তি নয়, ক্রাশ। শুধুই ক্রাশ...

১.
Crush and Confession পেইজে আরেকটা নতুন পোস্ট, নতুন কনফেশন। আবারো মাইশা'র নামে। গত এক সপ্তাহে মাইশা'র নামে কোনো কনফেশন আসেনি। বিষয়টা বেশ অবাক করার মতো! প্রতিদিনই কেউ না কেউ তার উপর ক্রাশ খেতো, রাতে ফেসবুকে ঢুকে দেখতে পেতো সেসবের স্বীকারোক্তি।

কনফেশন পোস্টে বন্ধু-বান্ধবীরা মাইশা'কে নিয়ে মজা করতো।
তাকে মেনশন করে লিখতো,
'Look at, another wicket down

কমেন্টের রিপ্লাই দিতে এসে সে এমনভাবে রিপ্লাই দিতো যে, সে এসবের কিচ্ছুই জানে। কিন্তু মনে মনে শান্তি পেতো, যাক আরেকজন আমার উপর ক্রাশ খেলো।

ক্লাসের মধ্যে বললে ভুল হবে, এই ব্যাচে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে সুন্দরি প্রতিযোগিতা হলে মাইশা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'মিস ক্যাম্পাস' নির্বাচিত হবে।
ক্রাশ এন্ড কনফেশন পেইজটা যেনো মাইশাময়।

এবার এক সপ্তাহ পর কনফেশন আসলো। কনফেশন ছাড়া এই সপ্তাহটা তার কেমন কাটছে তা কেবল সে নিজেই জানে।

মাইশা'কে নিবেদিত কনফেশনগুলোও দেখার মতো। কেউ তার নীলাভ চোখের প্রেমে পড়ে সারাদিন Blue Eyes গানটি গেয়ে বেড়ায়, কেউ ক্লাসে বসে মাইশা'র দিকে তাকিয়ে তার স্কেচ আঁকে, আর সাহিত্যমনা কেউবা মাইশা'র দিকে তাকালে মেঘদূতের রাঁধার কথা মনে পড়ে,

"হাজার প্রেম দাসী গোপীদের মাঝে
পদ্ম গোলাপী রাঁধার কোন সাঁজে
মৌসুমী নীল কৃষ্ণ প্রেমিকের মনে
ব্যাকুল কামনার প্রেম সূধা বাঁজে।"

কেউ কেউ আবার একটু বাড়িয়ে এটাও বলে থাকেন, 'যে মাইশাকে দেখলো এবং ক্রাশ খেলো না, তার মধ্যে সৌন্দর্যবোধ, রূচিবোধ বলতে তো কিছুই নেই'!

সরাসরি মাইশা'কে দেখার যাদের সৌভাগ্য (!) হয়নি তারা অন্তত কনফেশন পড়তে পড়তে একবার হলেও ঢুঁ মেরে আসেন মাইশা'র প্রোফাইলে। অনেকেই আবার তাকে See First দিয়েও রেখেছেন। আর না হোক, তার সৌন্দর্য দেখেও একটু প্রাণ জুড়াক।
কবি তো বলেই গিয়েছেন,

"তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সেকি মোর অপরাধ?
... হেরিতে তোমার রূপ-মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর।
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ।।"

আমাদের আজকের গল্পটা মাইশা'কে নিয়ে নয়, মাইশা'র উপর যারা 'ক্রাশ' খায় তাদেরকে নিয়ে। মাইশা'কে দেখে যারা নয়নের সাধ মেটায় তাদেরকে নিয়ে।

২.
ক্যাথলিক খৃষ্টানরা বছরে একবার চার্চে গিয়ে তাদের বড় বড় পাপগুলো কনফেশন বক্সে স্বীকার করে। যেমন: আমি এবছর একটা খুন করেছি, আমি ১০ টা ধর্ষণ করেছি ইত্যাদি। কনফেশন বক্সে যিনি পাপীর পাপের কথা শুনেন তাকে বলা হয় Priest (ধর্মযাজক)। পাপমোচন শেষে Priest পাপীর মাথায় হাত রেখে বলেন, Father will forgive your sin / ঈশ্বর তোমার পাপগুলো ক্ষমা করবেন। কনফেশনকারী যদি বড় কোনো ক্রাইম করে এসে সেটা স্বীকার করে, তবুও Priest সেই অপরাধীকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারেন না।

কনফেশনকারী আর Priest এর মধ্যে এরকম গোপণীয়তা রক্ষাকে The Sacramental Seal বলা হয় [ক]।

মাইশা'কে দেখে যারা ক্রাশ খায় তারা ফেসবুকের Crush and Confession পেইজে ঢুকে। চার্চের মতো সেখানেও একটা কনফেশন বক্স আছে। তবে সেটার নাম Send Message. চার্চে কনফেশন বক্সের ওপাশে থাকেন Priest, ফেসবুকে কনফেশন বক্সের ওপাশে থাকেন এডমিন।
কনফেশনকারী যখন তার ক্রাশের কথা জানায় তখন এডমিন নাম গোপণ করে সেটা ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেন।

৩.
Confession শব্দটির অর্থ দেখতে গিয়ে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, ওয়েবস্টার ডিকশনারি খুললাম। তিনটিতেই মোটামুটি বলা, পাপ স্বীকার করার কাজকে Confession বলে [খ]।
কারো উপর ক্রাশ খাওয়া পাপ। সেটাকে স্বীকার করার অর্থ কিন্তু এই না যে অনুতপ্ত হওয়া, বরং ক্রাশ খাওয়া মানুষটাকে জানানোর জন্যই এর Crush and Confession. এখানে কনফেশন মানে পাপ প্রচার করে বেড়ানো। চার্চের মতো The Sacramental Seal এই কনফেশনের আওতাভুক্ত নয়।

৪.
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ প্রথমে ছেলেদেরকে/পুরুষদেরকে পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন:

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصٰرِهِمْ

"তুমি মোমেন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী (ও সংযত) করে রাখে।" [গ]
জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি হঠাৎ মেয়েদের/নারীদের দিকে চোখ পড়ে যায় তখন?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তখন দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে। [ঘ]
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "প্রথম দৃষ্টিপাত মাফ, দ্বিতীয় দৃষ্টিতে গোনাহ।" [ঙ]

অর্থাৎ, মাইশা'র দিকে তাকিয়ে Blue Eyes গান গাওয়া, মাইশা'র দিকে তাকিয়ে মেঘদূতের রাঁধার কবিতা আবৃত্তি করা এইসব ইসলামে অনুমোদিত নয়। হঠাৎ করেও যদি দৃষ্টি পড়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নেবার নির্দেশ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন।

৫.
ইসলামে যিনার ক্ষেত্রটা ব্যাপক। কেবল নারী পুরুষের অবৈধ সম্পর্কই (Intercourse) যিনা নয়; বরং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এটার সাথে সম্পৃক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

চোখের যিনা হলো - দেখা।
জিহ্বার যিনা হলো - কথা বলা। [চ]

হাফিজ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "দৃষ্টিই হয় যৌন লালসা উদ্বোধক, পয়গাম বাহক। কাজেই এ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌন অঙ্গেরই সংরক্ষণ।... কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়, আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে, আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা।" [ছ]

ইসলাম যেটাকে চোখের যিনা বলেছে, সেই চোখের যিনাকে আমরা নাম দিয়েছি 'ক্রাশ'।

এই চোখের যিনা যার আধুনিক (!) নাম ক্রাশ, সেই ক্রাশ খেলে কী হবে?

"যে ব্যক্তি কোনো অপরিচিত নারীর প্রতি যৌন লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন তার চোখে উত্তপ্ত গলিত লৌহ ঢেলে দেয়া হবে।" [জ]

৬.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
কিয়ামতের দিন আল্লাহ মুমিন ব্যক্তিকে তার পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সে তার পাপগুলো স্বীকার করবে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি পৃথিবীতে তোমার পাপগুলো গোপন করে রেখেছিলাম আর আজ আমি তা মাফ করে দেবো। [ঝ]

আর যারা পাপ করে তা প্রচার করে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

আমার সকল উম্মাতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয় এ বড়ই অন্যায় যে, কোন লোক রাতের বেলা অপরাধ করল যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে সকাল হলে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ তার কর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর দেয়া আবরণ খুলে ফেলল। [ঞ]

একজন ক্রাশ খেলো, আর একজন ক্রাশ খেয়ে তা কনফেশন করলো দুজন কিন্তু সমান নয়। একজন অপরাধ করে তা গোপন রেখেছে, আরেকজন অপরাধ করে তা বলে বেড়িয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কনফেশনকারী (যে অপরাধ বলে বেড়িয়েছে) তাকে মাফ করা হবে না।

ও কনফেশনকারী, কনফেশনকারী, তুই অপরাধীরে
কনফেশনকারী তুই বড় অপরাধী, তোর ক্ষমা নাই রে!

রেফারেন্স:
ক. লিংক কমেন্টে দেওয়া হলো।
খ. সংজ্ঞাগুলো কমেন্টে দেওয়া হলো।
গ. সূরা আন-নূর ২৪:৩০।
ঘ. সহিহ মুসলিম ২১৫৯, সুনানে আবু দাউদ ২১৪৮, জামে আত-তিরমিজি ২৭৭৬।
ঙ. সুনানে আবু দাউদ ২১৪৯, জামে আত-তিরমিজি ২৭৭৭।
চ. সহিহ বুখারী ৬২৪৩।
ছ. আল জাওয়াব আলকাফী, আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ, পৃষ্ঠা ২০৪।
জ. ফাতহুল কাদীর।
ঝ. সহিহ বুখারী ২৪৪১।
ঞ. সহিহ বুখারী ৬০৬৯।

আমরা চোখের যিনাকে আদর করে 'ক্রাশ' বলি!

পঠিত : ৩৫৫১ বার

মন্তব্য: ০