Alapon

ইবনে তাইমিয়াঃ কারাগারই যার পাঠশালা

অনেকদিন আগে দামেশকের একজন পিতা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলেন। বেড়াতে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে তার ছেলে উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজ করার পরও ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে তিনি তাকে ফেলে রেখে অন্যান্যদের নিয়ে বেড়াতে বের হলেন। সকলে বেড়িয়ে আসার পর ছেলেটিকে পড়ার টেবিলে দেখতে পেলেন। পরিবারের সবাই বেড়াতে না যাওয়ার জন্য তিরস্কার করছিলো। ছেলেটি তখন একটি বইয়ে হাত রেখে বললো, "তোমরা তোমাদের বেড়িয়ে আসা থেকে অতটা লাভবান হতে পারনি, যেভাবে আমি তোমাদের অনুপস্থিতিতে এই বইটি মুখস্ত করার মাধ্যমে হয়েছি।"

ছেলেটি তার চেহারা, সূক্ষ্ম স্মরণশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য পরিচিত ছিলো। দামেশকের সকলেই তার মেধার প্রশংসা করতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মেধার খ্যাতি আশেপাশের শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। তার এই খ্যাতিতে আলেপ্পো হতে একজন পন্ডিত তার সাথে সাক্ষাত করতে দামেশকে আসেন। শহরের লোকজনের কাছে তিনি ছেলেটির সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর তারা তাকে ছেলেটির বিদ্যালয়ের রাস্তা দেখিয়ে দিল। পন্ডিত ব্যক্তিটি ছেলেটির বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলেটিকে ডাকলেন এবং তাকে তার পাশে বসিয়ে রাসূল (সা.) এর কিছু হাদীস বর্ণনা করলেন।

ছেলেটি তার হাতে থাকা স্লেটে রাসূল (সা.) এর হাদীসগুলো লেখে নিলো। পন্ডিতব্যক্তি এরপর তাকে হাদীসগুলো পড়তে বললে ছেলেটি তা পড়ে শুনালো। এরপর পন্ডিত ব্যক্তি তার কাছ থেকে হাদীসগুলো মুখস্ত শুনতে চাইলে ছেলেটি হুবহু তা বর্ণনা করে গেলো্। এরপর পন্ডিত ব্যক্তি তাকে আরো হাদীস বর্ণনা করলেন এবং একইভাবে ছেলেটির কাছে জানতে চাইলেন। ছেলেটি এবারেও তার স্মৃতি হতে হাদীসগুলো  হুবহু বর্ণনা করলো। সেই পন্ডিত ব্যক্তি তখন বললেন, “ছেলেটি যদি বেঁচে থাকে, তবে সে অনেক বড় হবে।’

এই ছেলেটিই পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিদ্বান ও ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম আহমদ ইবনে তাইমিয়া।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন একজন যুগ শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় সংষ্কারক, চিন্তাবিদ ও মুজাহিত ফিল মাযহাব র্অথার্ৎ ধর্মীয় ব্যাখ্যাদাতা বা ভাষ্যকর। মুসলমানদের মনকে কুরআন-সুন্নাহ কেন্দ্রিক করে আদিম ইসলামে প্রত্যাবর্তনের আওয়াজ তুলে তিনি মুসলিম চিন্তাধারাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করেছেন। তারই উত্তরসূরী আন্দোলন ‘‘ওহাবী’’ (Wahhabism in Arabia) ও সানূসী (Sanusism in North Africa)।

জন্ম বংশ পরিচয়ঃ
৬১ হিজরীর ১০ রবিউল আউয়াল সোমবার/২২শে জানুয়ারী, ১২৬৩ খ্রিঃ দামেস্কের নিকটবর্তী হাররান প্রদেশে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার পুরো নাম তকি আল দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবদুল হালিম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে তাইমিয়া আল হাররানী। তবে তিনি ইবনে তাইমিয়া নামে বেশী পরিচিত। এটা তার দাদীর নাম।

শিক্ষা জীবনঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পিতা আবদুল হালিম হাম্বলী মাযহারের একজন মশহুর আলেম ছিলেন। তিনি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন। ইবনে তাইমিয়া ১৭-২০ বছর পর্যন্ত পিতার কাছে শিক্ষা লাভ করেন। পিতা পুত্রকে কুরআন, তাফসীর, হাদীস, আরবী ভাষা প্রভূতি উত্তমরূপে শিক্ষা দেন। দামেস্বের মশহুর আলেম যয়েনউদ্দীন আল-মুকাদ্দসী, নজমউদ্দীন আসাকীর ও বিদুষী যয়নাব বিনতে মক্কির নিকটও তাইমিয়া বহুবছর শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি শামসুদ্দীন আবদুর রহমান আল-মাফদেসীর কাছে আইন শাস্ত্র পড়েন। অসাধারণ মেধা, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, সুক্ষ্ণ বিচারশক্তি ও সুদক্ষ তাকির্কতার পারদর্শী হয়ে উঠেন এবং সুধী সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন।

কর্ম জীবনঃ
৬৮১/১২৮২ সনে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ২০ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে। অতঃপর তিনিউ পিতার সালে হাম্বলী মাযহারের আইন অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি একজন মশহুর বক্তা ও তার্কিক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। প্রতিশুক্রবারে তিনি দামেস্কের জামে সমজিদে প্রকাশ্যে তাফসীরে কুরআনের বক্তৃতা দিতেন। তাসসীর, হাদীস, শরীয়ত ও ধর্মতত্ত্বে অসামান্য দখল থাকায় তিনি কুরআন ও সহীহ হাদীসের অপূর্ব ব্যাখ্যা দিতেন এবং যয়ীফ অর্থাৎ অসমর্থিত দুর্বল হাদীসের তীব্র সমালোচনা করতেন। তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি ও আশ্চর্য তর্কশক্তির কাছে বিরুদ্ধবাদীরা পরাজিত হয়ে আক্রোশবশে তার বিপক্ষে প্রচার করতো।

প্রধান বিচারপতির পদ প্রত্যাখানঃ
তাঁর বয়স যখন ৩০ বৎসর, তখন তাঁর যশ বা খ্যাতির জন্য সরকার প্রধান তাঁকে লোভনীয় পদ দেশের “প্রধান বিচারপতি” পদে নিয়োগ দিয়ে সরকারপন্থী করার জন্য প্রস্তাব পাঠান ; কিন্তু তিনি তাঁকে সারা না দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকেন।

রচনাবলীঃ
ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন নিরলস জ্ঞানসাধক। তিনি অক্লান- পরিশ্রম করে পূর্ববতী সকল শ্রেনীর লেখকদের রচনাবলী পড়তেন, তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হতেন এবং অবিশ্রান- লেখনী চালনা করে নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করতেন। কথিত আছে যে, তিনি প্রায় পাঁচশত পুস্তক রচনা করেন। কিন্তু বর্তমানে ৬৪টির অস্তিত্ব মেলেছে। যা মুসলিম গ্রন্থ প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম। এটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রধান দুটি কারণে ১) চিরকুমার ২) জীবনের অধিকাংশ সময় কারাবরন। অনেকের মন্তব্য- জীবনের এক তৃতীয়াংশ তিনি কারাবরন করেন। ফলে নির্জনে ধ্যানমগ্নে এ সমস্ত লেখা সম্ভব হয়েছে। 

মাযহাবের প্রশ্নে ইবনে তাইমিয়ার উত্তরঃ 
ফিকহি মাসায়েলের ক্ষেত্রে তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মাজহাব সামনে রাখতেন। শুধু তাই নয়, অনুসৃত অপরাপর ইমামদেরও তিনি শ্রদ্ধা করতেন এবং সসম্মানে তাদের আলোচনা পেশ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত আজকাল তার কিছু বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে মুসলিম উম্মাহর বিরাট অংশ; যারা কোনো না কোনো মাজহাবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক।

মাজহাবের ব্যাখ্যা অনুসারে কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা সম্বন্ধে ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর ভারসাম্যপূর্ণ মন্তব্যগুলো স্বয়ং তার রচিত গ্রন্থাদি থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লেখেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমামরা যেমন আবু হানিফা, সাওরি, মালিক, আওজায়ি, লায়স বিন সা’দ, শাফিয়ি ও আহমদ প্রমুখের ফতোয়ার স্বপক্ষে কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা দলিল পেশ করা যাবে। তাদের কারও তাকলিদ করা হারাম হবে না। পক্ষান্তরে যে ইলম ছাড়াই ফতোয়াবাজি করে তার তাকলিদ সম্পূর্ণরূপে হারাম।’ (আল ফোরকান বাইনা আউলিয়াইর রাহমান ও আউলিয়াইশ শায়তান, পৃ. ৭৭)।

ইমাম ইবনে তাইমিয়ারসংস্কারমূলক চিন্তাধারা (His Project of Reform):
তিনি ছিলেন মুজতাহিদ ফিল মাযহাব (One qualified to form on indipendent Opinion in Muslim Law)।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে সংস্কারপন্থী মত ব্যক্ত করেনঃ
১. তাকলীফ বিরোধী (Blind following in Religions) অর্থাৎ পূর্বোক্ত ইমামরা যা বলে গিয়েছে তা অন্ধভাবে অনুকরণ অনুসরণ করা।

২. মুতাকাল্লিম বা যুক্তিবাদীদের অন্ধকারে অনুসরণ। কুরআন-হাদীসকে তাদের কথা/যুক্তির দ্বারা বিশ্লেষণ করা। বিশ্লেষণে সমাধান না হলে যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া।

৩. বিদ‘আত (Innovation) / কুসংস্কার বা Shadd al-Riha (under taking journey to tombs of the Prophets and Saints) অর্থাৎ মাযার-কবর যিয়ারত এবং পূঁজা ইত্যাদি বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়া।

৪. তালাক / হিলা অর্থাৎ এক সাথে ৩ তালাক দিলে। সেটা কার্যকর হয় না এবং তা বৈধ করার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করা হয়, তাও বৈধ না। এ মতটি পূর্বোক্ত সকল ওলামায়ের বিরুদ্ধে চলে গেলে তিনি সকলের রোশানলে পড়েন। এ ছাড়া মাযার যিয়ারতের মাসআলাও তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়।

৫. ইজতিহাদের দরজা বন্ধ নয়। সকল যুগেই কুরআন-হাদীস কেন্দ্রিক ইজতিহাদ হতে পারে। এ সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে সমসাময়িক ওলামাদের সঙ্গে তাকে মতানৈক্য হয়। এ ধুম্রজ্বালে সরকার তাঁকে বিভিন্ন সময়ে জেল-হাজতে প্রেরণ করে থাকেন।

সমালোচনা ও প্রশংসাঃ
তাঁকে একদল ওলামা মুলহিদ (নাস্তিক) বা কাফির বলে উল্লেখ করেছেন। আর একদল তাঁকে শাইখুল ইসলাম বা ইসলামের ভাষ্যকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবার একদল তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে বলেছেন, ইবনে তাইমিয়া যদি বলেন, এটা হাদীস, তাহলে সেটা হাদীস আর যদি বলেন- এটা হাদীস না তাহলে সেটা হাদীস না। এটাও এক ধরণের বাড়াবাড়ি এবং গোড়ামী নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ একজন আলিম বা ধর্ম সংস্কারক।

সাহসী ইমামঃ
ইবনে তাইমিয়া তার সাহসের জন্যও খ্যাতি অর্জন করেন। আক্কার বিজয় অভিযানে অংশগ্রহণ করে তিনি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও সাহসের পরিচয় প্রদান করেছিলেন। মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়ার কারণে তিনি বেশি আলোচিত। মোঙ্গলরা এসময় ইসলাম গ্রহণ করলেও শরিয়ার অনুসরণ না করায় তিনি তাদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। 

একবার তাতার শাসক কাজান কয়েকজন মুসলমানকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ইবনে তাইমিয়া তার কাছে গিয়ে তাকে তার এই কাজের জন্য তিরষ্কার করলেন এবং বন্দীদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। ইবনে তাইমিয়ার কথামত কাজান বন্দীদের মুক্ত করে দেন।

ইবনে তাইমিয়ার জীবন ছিলো বিভিন্ন পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। সারজীবনেই এক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই অপর এক পরীক্ষার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন। শেষ জীবনে কিছুলোক ষড়যন্ত্র করে তাকে জেল হাজতে নিক্ষেপ করে। তাকে দামেশকের দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। কারাগারেও তার জ্ঞানসাধনা অব্যাহত থাকে। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি বলতেন,‘যদি আমাকে এই কারাগার ভর্তি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হত, তবুও আমি এতোটা অনুগ্রহবোধ করতামনা, যতটা আমি কারাগারে আটকের মাধ্যমে হয়েছি।'

মৃত্যুবরণঃ
কয়েদ অবস্থায় তাঁর যখন কাগজ-কলম ছিনিয়ে নেওয়া হল, তখন তিনি ব্যথিত হয়ে কয়লা দিয়ে ২০ দিন দেওয়ালে লিখেন। এরপর অন্তিম ডাক আসে, সে দিনটি ছিল সোমবার মধ্যরাত ২০ যুলকাদ, ৭২৮/২৬-২৭ সেপ্টেম্বর, ১৩২৮ সন। তাঁর চারবার জানাযা নামায পড়ান হয়, প্রায় দু’লক্ষ পুরুষ ও ১৫ হাজার স্ত্রী লোক অংশ গ্রহণ করে। দামেস্কের সুফিয়া কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সে কবরস্থানের সবগুলো কবর ভেঙ্গে সিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহ নির্মিত হয়েছে ; কিন্তু ইবনে তাইমিয়ার কবরটি আজও বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর টুপিটি বিক্রি হয়েছিল ৫০০ রৌপ্য মুদ্রায় । 

পরিশেষে বলা যায় যে, আশ্চর্য চরিত্রবলের দরুন মুসলিম জনসাধারণ ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে অশেষ শ্রদ্ধা করতো। তিনি আজীবন তাসাউফের বিরোধিতা করলেও সূফী প্রাধান্য ও পীরপুজা সুমলি সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেননি কিন্তু তার শিক্ষা বৃথা যায়নি।

পঠিত : ১৮১৫ বার

মন্তব্য: ০