Alapon

লাভে লোভে জামায়াত

ডিগবাজি, নীরবতা এবং লোভে-লাভের হিসাবটা রাজনীতিতে জামায়াতের আদর্শগত চরিত্র। বিএনপি জোটে থেকেও একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের লাভের হিসাবের খাতা খুলছে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় জামায়াত জোটে থেকে বিএনপির বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং মাঠপর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে সহানভূতি লুফে নিয়েছে। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশের পলিসি, ক্ষমতাসীনদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিএনপির সিদ্ধান্তের আলোকে জোট থেকে তাদের বের করে দেয়া হয় তাহলে দলটির দ্বিতীয় দফায় কোমর ভাঙবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টমহল। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াত তিন দিক দিয়ে লাভবান হবে। ক্ষতির দিক একটি হলেও সেটিতে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা এ মুহূর্তে জামায়াতের নেই।

দলটির নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য তাদের আন্দোলনের কর্মী আছে, কিন্তু রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা। এছাড়া সিলেট সিটি নিয়ে জামায়াত বিএনপিকে তিন ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সেটিও জলে যাবে বলে ধারণা করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। শীর্ষ নেতাদের হারানোর পর জামায়াতে তৈরি হয় স্বার্থবাদী খান গ্রুপ। এখন রাজনৈতিক সকল ফায়দা তাদের মুঠোয়। নির্বাচনের প্রার্থী নির্ধারণ নিয়েও দলে ভাঙন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে দলটিতে। অন্যদিকে জামায়াতের সংস্কারবাদী নেতাদের ভাষ্য এর আগে আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক মাস্টার প্ল্যানিং ষড়যন্ত্রে তারা তাদের শীর্ষ নেতাদের হারিয়েছেন। এখন নির্বাচনের পর পরই ফের নতুন কৌশলে ষড়যন্ত্র হবে, তা তাদের মোকাবিলা করার রাজনৈতিক শক্তি নেই। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখায় বহুদিন থেকে বিএনপি ভারতসহ আন্তর্জাতিক দেশগুলোর চাপে আছে। দেশের বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও বিএনপি থেকে সরে গেছে। আদর্শিক অনেক দলীয় নেতাকর্মীও জামায়াতকে জোটে রাখায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদিকে ঘনিয়ে এসেছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ঠিক সেই মুহূর্তে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে দলে রাজনৈতিক সংকটে বিএনপি। তাই সম্প্রতি ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলোর সহানুভূতি পেতে মরিয়া বিএনপি। তাই আন্দোলন এবং নির্বাচনের পাশাপাশি বিএনপি এখন ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতা করতে চাচ্ছে। 

দলটির ধারণা, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ভারত না চাইলে কিছুই হবে না। তাই এখন ভারতের সাথে ধারাবাহিক যোযোযোগ অব্যাহত। কিছুদিন আগে বিএনপি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেছেন। এছাড়া ঢাকাতেও বিএনপির শীর্ষ নেতারা একাধিকবার ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অন্যদিকে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক জিয়াও ভারতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এখন দলের শরিক দল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়াই বিএনপির জন্য প্রযোজ্য হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। 

এছাড়াও ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বিজেপি এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিএনপিকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারতের আস্থা অর্জন করতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়তে হবে। যে দাবি দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও করে আসছে।সম্প্রতি সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং জামায়াতের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জোট থেকে বিএনপির প্রার্থী দেয়া হলেও জামায়াত জোটের আদর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করায়। জোটের সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না আপাতত এটিই দলীয় সিদ্ধান্ত। এরপরও যদি রাজনৈতিক কৌশলে শেষপর্যায়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেক্ষেত্রে জোট থেকে জামায়াত সারাদেশে ৭০টি আসন দেয়ার দাবি তুলে রেখেছেন। যেটি পূরণ করা জোটের পক্ষে সম্ভব  নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভাষ্য, তারা জোট থেকে ৬টি আসনের বেশি জামায়াতকে দেবে না। সম্প্রতি জামায়াত ছাড়ার ইঙ্গিতের পর ক্ষমতাসীনরাও এ সুযোগটি ব্যবহার করতে চাইছে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মত, জামায়াতের যেহেতু ডিগবাজি দেয়ার পুরনো চরিত্র আছে সেহেতু বিএনপি তাদের ছেড়ে দিলে তারা ক্ষমতাসীন দলের কাছে চলেও যেতে পারেন। কারণ জামায়াতের মধ্যে বর্তমানে আদর্শের চেয়েও লাভ এবং লোভের তালিকায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছে। এমন ইঙ্গিতকেই বেশি বিবেচনা করা হচ্ছে। 

গত ১০ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে বিএনপিতে এখন নানান হিসাব-নিকাষ চলছে। আসলে মকবুল আহমাদ কী সত্যই মুক্তি পেয়েছেন নাকি এই সরকার নির্বাচনের কোনো ষড়যন্ত্রের আলোকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে বিএনপির কিছু নেতার মত, এটি বিএনপির মনে সন্দেহ ঢোকানোর জন্যই সরকারের কৌশল হতে পারে। সম্প্রতি জোট থেকে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার ইঙ্গিত, জামায়াতের নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং তাদের কর্মকৌশল কী এ নিয়ে জানতে আমার সংবাদের পক্ষ থেকে দলটির দুই নীতিনির্ধারক ও এক নেতার সাথে কথা বললে উঠে আসে দলটির রাজনীতির মাঠের নানা পরিকল্পনা। 

জামায়াতের নীতিনির্ধারকের ভাষ্য, জামায়াত এখনো বিএনপি ছাড়তে রাজি নয়, তবে বিএনপি যদি তাদের ছেড়ে দেয় তাহলে তাদের কিছুই করার নেই। জামায়াত তাদের রাজনৈতিক গতিতেই পলিসি নির্ধারণ করবে। তবে এই নীতিনির্ধারকরা ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা প্রায় শতাধিক আসনে নির্বাচনে করার প্রস্তুতি রেখেছেন। বিশেষ করে জামায়াতের টার্গেট বিএনপির দুর্গের এলাকাগুলো। 

তাদের ভাষ্য, যে সমস্ত এলাকায় আওয়ামী লীগ দুর্বল সেসব আসনে বিএনপির সাথে বিদ্রোহী হয়ে কিংবা স্বতন্ত্র হয়ে মাঠে প্রচারণায় নামলে ক্ষমতাসীনরা এই সময় তাদের কোনো ধরনের বাধা প্রধান করবে না। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও জেলায়। সব মিলিয়ে ৬০-৭০টি আসনে তাদের প্রার্থী থাকতে পারে বলে ধারণা জামায়াতের এক নীতিনির্ধারকের। এসব আসনে প্রকাশ্যে জামায়াত প্রচারণায় নামলেও কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ তাদের সমস্যা করবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গা ঢাকা দেয়া জামায়াত ফের প্রকাশ্যে আসার সুযোগ হবে। তাই কেন্দ্র থেকে সব প্রার্থীদের এখন নার্সিং করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় তারা জোটে থেকে কী পেয়েছে এমন প্রশ্নে দলটির এক শীর্ষ নেতার যুক্তি হলো জামায়াত থেকে বিএনপি কী পেয়েছে সেটা তাদের দলীয় শীর্ষ ব্যক্তিরা বলতে পারবেন। তবে বিএনপির এই দীর্ঘ জোটে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির তিনটি শ্রেণিকে আকর্ষণ করতে পেরেছেন। এক. বিএনপির বুদ্ধিজীবী দুই পেশাজীবী এবং বিএনপির তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে জামায়াত রাজনৈতিক আদর্শের দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছে। বরাবরই জাতীয় ইস্যুতে জামায়াত যে ভূমিকা পালন করছে সে ইস্যুতে এ তিন শ্রেণির কাছ থেকে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন পেয়েছেন, পেয়ে যাচ্ছেন। জামায়াতের দুই নীতি নির্ধারকের বড় আতঙ্ক তারা সাময়িক কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগের অন্তরালে তাদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বড় ষড়যন্ত্রের ফাঁদ অপেক্ষা করছে। যা এখনকার নেতৃত্ব পর্যায়ের যারা আছে তাদের জন্য মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। কারণ জামায়াতের মধ্যে এখন বড় নেতৃত্ব শূন্যতা রয়েছে। ভোগবাদী নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। গ্রুপিংয়ে নেতৃত্ব তৈরি করা হচ্ছে। দলে চৌকস নেতার বড় সংকট। আধ্যাত্মিক নেতা নেই বললেও চলে। শীর্ষ নেতাদের হারানোর পর দল এখনো কোমর সোজা করতে পারেনি। নির্বাচনকেন্দ্রিক পদের জন্য একটি সমালোচিত গ্রুপ দলের আদর্শের সাথে বেইমানি করতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের। তাহলে সেটি কী এমন যে, জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে জোট করবে? তার ধারণা এটি হবে না, তবে সাময়িক একটা সমঝোতা হতে পারে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াতের জন্য অগ্নিপরীক্ষা অপেক্ষা করছে বলেও মত তাদের। সেই মাস্টার প্ল্যানিংয়ে দল বড় গর্তে পড়ে আরেকবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া প্রত্যেক দলেই প্রার্থী হওয়ার লোভ থাকে, সে ক্ষেত্রে জামায়াতও ব্যতিক্রম নয়। একদিকে জামায়াতের রয়েছে ত্যাগী নেতা অন্যদিকে ব্যবসায়িক প্রভাব। সে ক্ষেত্রে প্রার্থী হওয়ার নাম এলে অর্থের দিকটা বিবেচনা করা হয়। আর এ ইস্যুতে ত্যাগী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়। ফলে ভাঙনেরও বড় দিক রয়েছে দলটিতে। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে জামায়াতের নির্বাচনের প্রস্তুতি কী ও জোটগতভাবে দলটি জোটের কাছে কতটি আসন প্রত্যাশা করে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর আমীর এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রত্যকটি রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রস্তুতি নেয়, সেভাবে জামায়াতও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ক্ষত্রে তিনি অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনের আগেই জামায়াতকে মাঠে নামতে দেয়া হচ্ছে না, প্রকাশ্য কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জামায়াতের এই নীতিনির্ধারক বলেন, সারাদেশে যেসব আসনে জামায়াত আগে নির্বাচন করেছে সেগুলোয় তাদের শক্ত প্রস্তুতি চলছে। কেন্দ্র থেকে তাদের নার্সিং করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সেই আলোকে জোট থেকে প্রার্থী পাওয়ার জন্য কর্মকৌশল চালানো হচ্ছে।

 #সেরা ব্লগার প্রতিযোগিতা (সংগৃহিত)

পঠিত : ৮০০ বার

মন্তব্য: ০