Alapon

লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি

লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি...
.
গণহত্যার প্রমাণ সরিয়ে ফেলার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর প্রয়োজন ছিল ডোমদেরকে। প্রায় সব জায়গাতেই তাই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁদের। আর তাঁরা প্রত্যেকেই হয়ে গেছেন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার এক একজন সাক্ষী। তেমনই একজন চুন্নু ডোম। লাশ সরানোর জন্য সুইপার কলোনি থেকে আর সবার সাথে ডেকে নেয়া হয়েছিল তাঁকেও...
.
"১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান।
.
সেখান থেকে আমাকে বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি ট্রাকে করে প্রথমে শাঁখারীবাজারে কোর্টের প্রবেশ পথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়।
.
আমরা উক্ত পাঁচ জন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের যে রাজপথ শাঁখারীবাজারের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তার দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোরের বহু পচা লাশ। ... একটি ঘরে প্রবেশ করে এক জন মেয়ে, এক জন শিশু সহ ১২ জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি।
.
পাঞ্জাবিরা প্রহরায় থাকাকালে সেই সব মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উচ্ছৃঙ্খল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারী জনতাকে মূল্যবান সামগ্রী, দরজা, জানালা, সোনাদানা সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম।
.
লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম- বৃদ্ধা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে “পানি পানি” বলে চিৎকার করছিল, তাকে আমি পানি দিতে পারি নাই ভয়ে, বৃদ্ধাকে দেখে আমি আরো ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবি সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারি নাই।
.
আমরা ১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ শাঁখারিবাজার থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাকে বোঝাই করে তিনশত লাশ ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি।
.
১৯৭১ সনের ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুইপার্শ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালীবাড়ী, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি।
.
২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশ পথে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙ্গালী যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর আমাদের সাথে ছিলেন। এরপর আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত(লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে।
.
প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁঝরা দেখিছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই, যোনীপথ ক্ষতবিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখিছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন জোর করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোঁপা খোঁপা চুল দেখলাম।
.
মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি।
.
১৯৭১ সনের ৩০ মার্চ আমাদের উক্ত পাঁচ জনের সাথে দক্ষিণা ডোমকে সাহায্য করতে দেয়া হয়। আমাদের ট্রাক সেদিন সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙ্গালী লাশ উঠাচ্ছিলাম, তখন অসংখ্য বিহারী জনতা আমাদের চারিদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল, বাঙ্গালীদের পরিণতি দেখে উপহাস করছিল।
.
আমরা সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে আটটি বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছি, কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সবার পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। পচা, ফুলা লাশ তুলতে যেয়ে দেখলাম কারো লুঙ্গি পরা, কারো পায়জামা পরা। আবার কারো দেহে হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামী শার্ট।
.
পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি; প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পেছনের দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা দেখেছি। লাশ দেখে মনে হল, ভদ্র ঘরের অভিজাত বাঙ্গালী যুবকের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে আমরা ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।
.
ফিরে এসে ট্রাক নিয়ে আমরা মিন্টু রোডের লাশ তুলতে গিয়েছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা, ফুলা লাশ তুলেছি, দেখলাম লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর সম্মুখ থেকে দুজন রুপসী যুবতী মেয়ে এবং তিন জন যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলে একটি অর্ধদগ্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি, মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি, ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি।
.
পরের দিন ৩১ মার্চ বাসাবো খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি। সেদিন অসুস্থ্ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে যেতে পারিনি।
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডের পৃষ্ঠা নং ৩৬ থেকে বলছি...
ছবিটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত।
সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতা-জুলাই '১৮"

পঠিত : ২১২৯ বার

মন্তব্য: ০