Alapon

তাজউদ্দিন আহমেদকে স্মরণে আমরা কার্পণ্য করছি না তো?

১।
স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রত্যেকটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর আইডিয়াগুলোর এক্সিকিউশনের মূল দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীনের সমান্তরালে ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজটুকু বঙ্গবন্ধু সরাসরি তত্ত্বাবধান করতেন। কিন্তু তাজউদ্দীনের মেধা ও কমিটমেনটের প্রতি বেশি আস্থার কারণে যুদ্ধকালীন সরকার চালানোর কাজ পেলেন তাজউদ্দিন। কি অসামান্য দক্ষতায় মুশতাক গঙের চক্রান্তকে হটিয়ে ভারত সরকারের সহায়তায় তাজউদ্দিন দেশকে বিজয়ের দিকে নিয়ে এলেন সে এক বিস্ময়।

আবার অর্থ মন্ত্রীর পদ থেকে বাদ পরা, সোভিয়েত প্রেসক্রিপশনে বঙ্গবন্ধুর করা বাকশালের বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে মূল নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত পোষণের ইতিহাস আমরা পাবো। কিন্তু যা আমরা পাবো না, ইতিহাসের অলিগলি তল্লাশি করেও তা হলো তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যহীনতার কথা; কুচক্রীরা সকল মেধা ঢেলেও তাজউদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো দলিল হাজির করতে পারেনি।

২।
আবুল হাশিম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠক করেন ৷ ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন ৷ তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য।

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে শেখ মুজিবের সাথে তিনিও যোগদান করেন। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম সদস্য। এই বছরের ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুণঃনির্বাচিত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

৩।
তাজউদ্দিন ছিলে দুই দশকেরও অধিক কাল ধরে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হবার পর থেকে সকল দলীয় নীতি ও কর্মসূচীর অন্যতম মুখ্য প্রণেতা, দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার-বিমুখ সংগঠক। ’৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরেই ছিল সম্ভবত তাঁর স্থান। ২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানী আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দিনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন যাতে ‘শীঘ্রই তাঁরা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন’।

তারপর এক নাগাড়ে প্রায় তেত্রিশ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দিনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি-যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাঁকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭শে মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোন নেতৃস্থানীয় সদস্যের সাথে আলাপ-পরামর্শের কোন সুযোগ তাজউদ্দিনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাঁদের কোন বিলম্ব ঘটেনি: (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসাবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া।

প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা-আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দিন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০শে মার্চের সন্ধ্যায়। মুজিবনগর সরকার গঠন করে পুরো মুক্তিযুদ্ধে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তাজউদ্দিন আহমেদ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দুই দফা বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাবার অধিকার প্রদান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস সাধারণভাবে জ্ঞাপিত হয়. নয় মাসের যুদ্ধে তাজউদ্দিন আহমেদের বুদ্ধিমত্তা এবং রণকৌশল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করে।

২২ ডিসেম্বর,১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধু ৩০ বছরের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভুল বুঝেন। ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

১৫ই আগস্ট,১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ২৩ শে আগস্ট তাজউদ্দিন আহমদসহ ২০ জনকে সামরিক আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হয়। ৩রা নভেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম,কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলী এর সাথে কারাগারের অভ্যন্তরে তিনি শহীদ হন।

৪।
তাজউদ্দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়ার মতো, বৃক্ষ মরে গেলে ছায়া যেমন মরে যায় তেমনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর ছায়াও মরে যায়। বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীনকে তাই ইতিহাসও আলাদা করতে পারেনি। শুভ জন্মদিন বঙ্গতাজ; বাংলার শ্রেষ্ঠ এক সন্তানকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্রঃ
১) MULDHARA,1971
2) উইকিপিডিয়া

লিখেছেনঃ ড.কাওছার আহমদ 
সহকারী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

পঠিত : ১৮৭০ বার

মন্তব্য: ০