Alapon

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ কাকুই পাক্কা খেলোয়াড়

বাংলাদেশের রাজনীতি আর ভোটের ঘুঁটিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সব সময় বড় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এরশাদের গুরুত্ব বাড়ে। আর তিনিও সব সময় রাজনীতির মাঠে নতুন খেলার জন্ম দেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও হয়তো এবার তেমনই কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোট-মহাজোটের রাজনীতিতে এরশাদের ভারত সফর নয়া মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে। ভোটের আগে হঠাৎ ভারতের আমন্ত্রণে চারদিনের সফর শেষে গতকাল দেশে ফিরেছেন।

আজ সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ কী বার্তা নিয়ে আসছেন এখন সেদিকেই সবার চোখ। আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব রাজনৈতিক দলই এরশাদের এ সফরকে অনেক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। বিএনপির শীর্ষ কিছু নেতার ধারণা, এরশাদ এ নির্বাচনের আগে আওয়ামী জোট ছেড়ে নিজের শক্তি জানান দেবেন। তবে তিনি বিএনপিতে না এলেও রাজনৈতিক শক্তি কিংবা তৃতীয় শক্তির মতো এমন কিছুতে নিজেকে আবির্ভাব ঘটাতে পারেন। তাছাড়া নির্বাচন আসলে এরশাদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েন; রাজনীতি পাড়ায় এমন কথা বহুদিন থেকেই প্রচলিত। তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়, এবার অধিক দল নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল।

এদিকে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের ধারণা, হয়তো এই একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনীতিতে দলের চেয়ারম্যানের ইতি ঘটতে পারে। সেজন্য রাজনীতিতে ইতিহাস হয়ে থাকার সেরা কৌশলটি বেছে নেবেন এরশাদ। এছাড়াও গত ১ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে দলের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এরশাদ দাবি করেছিলেন, ভোট আর রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি একটি বড় ফ্যাক্টর। মানুষ সবসময় পরিবর্তন চায়। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সেই সুযোগ কাজে লাগাবে। গত রোববার দিল্লিতে যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। চারদিনের সফর শেষে গতকাল তিনি দেশে ফিরেছেন। সাথে ছিলেন পার্টির শীর্ষ আরও চার নেতা। দলের মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী এবিএম রুহল আমিন হাওলাদার, সাবেক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু, এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও দলের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় ও জাপা চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর অবসরপ্রাপ্ত খালেদ আখতার।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত, বর্তমানে আওয়ামী লীগ জোটে এরশাদ আর ক্ষমতায়ও আওয়ামী লীগ! এছাড়া দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, প্রধান দুই দলের কাছে ভোটের রাজনীতি সবসময় প্রাধান্য পায় এরশাদের দল। যদিও ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে এই এরশাদের পতন হয়েছিলো কিন্তু রাজনীতি পাড়ায় এখনো এমন কথা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদই পাকা খেলোয়াড়। প্রায় ২৮ বছর তিনি ক্ষমতায় নেই। তাতে কি? কিন্তু রাজনীতিতে তার দাপট চলছে এখনো সমান তালে। সেই সুযোগে এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি রাজনীতির উত্তাপে সময়ের আলোকে গায়ে সুগন্ধি মাখতে পারেন।

১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা মহাজোট করেছিল। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও অনেক নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে সাথে রাখতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। এখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে রয়েছেন এরশাদ। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই এরশাদ রাজনীতিতে ফের নতুন কিছু ঘটাতে পারেন। হঠাৎ রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে এরশাদের ভারত সফরের পর রাজনীতি পাড়ায় ফের এরশাদ নিয়ে গুঞ্জন বাড়ছে। তিনি ভারত থেকে কী বার্তা নিয়ে আসছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে এরশাদ দলের কী ভূমিকা থাকবে, ভারত থেকে এরশাদ কী পাচ্ছেন? আর যেহেতু নানা ইঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে, ভোটের আগেই ভারতের কাছে এরশাদের গুরুত্ব সেহেতু নতুন কিছু তৈরি হচ্ছে বলেই মত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা জনপ্রিয়তার লোভে জাতীয় পার্টি এবার হয়তো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। যেহেতু রাজনীতিতে এরশাদের ডিগবাজি পুরনো চরিত্র, এটি তার বিচিত্র কিছু নয়। এদিকে আওয়ামী লীগ এবার অধিক সংখ্যক দল নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার তৎপরতার লক্ষণ দিন দিন বাড়ছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না এলেও আগে থেকেই ছক তৈরি করে রাখছেন ক্ষমতাসীন দল। তাছাড়া গতকাল কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাতের পর রাজনীতিতে সন্দেহের তীর আরও বাড়ছে। যেহেতু ২০ দলীয় জোটে জামায়াত আছে সেহেতু বাম দলগুলো বিএনপির সাথে যাওয়ার আগ্রহ নেই। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট পার্টিকে কাছে টানার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তাছাড়া সম্প্রতি আটটি বাম দল নিয়ে একটি জোট করেছে সিপিবি। সেদিক থেকেই তাদের পাল্লা ভারি। এরশাদ যেহেতু সব সময় জনপ্রিয় ও আলোচিত থাকতে চান সেহেতু নির্বাচনের আগে নতুন কোনো চরিত্রেই হাজির হতে পারেন এটিও উড়িয়ে দিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল। তাছাড়া আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেতাদের ভারত সফরের সঙ্গে এরশাদের সফরের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ নেতারা গত এপ্রিলে দিল্লিতে এসেছিলেন ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে। আর গত মাসে বিএনপির তিন নেতা অনেকটা নিজেদের তাগিদেই দিল্লিতে এসে ভারতের বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও থিঙ্কট্যাঙ্কের সঙ্গে দেখা করেন। সেই জায়গায় এরশাদের দিল্লি সফর কিন্তু পুরোপুরি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে।

গত সপ্তাহে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা নিজে এরশাদের বাসভবনে গিয়ে তার হাতে ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন। দিল্লিতে এরশাদসহ জাতীয় পার্টির অন্য নেতারা রাজধানীর অভিজাত এলাকায় যে পাঁচ তারকা তাজ মানসিং হোটেলে উঠেছেন, সেটাও ভারত সরকারের আতিথ্যেই। ভারতীয় দুটি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এ বছর নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অতীতের চেয়ে অনেক আলাদা। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও জাতীয় পার্টির যোগদান নিয়ে নানা সমীকরণ জানতে চাচ্ছে ভারত।

তাছাড়া ভারতীয় গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি হয়তো প্রধান দুটো দলের মধ্যে আসে না, কিন্তু তাদের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে বরাবরই। বিশেষত বিগত নির্বাচনে বিএনপি না আসায় জাতীয় পার্টি একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আগামী নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কীভাবে বিশ্লেষণ করছে, ভারত সেটা জাতীয় পার্টির মুখ থেকেই শুনেছে। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে জাতীয় পার্টির যে অবদান, তাকে ভারত সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ কীভাবে মূল্যায়ন করছে এটি এরশাদ দিল্লির কাছে জেনেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের মত। এদিকে দিল্লিতে পা রাখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এরশাদকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। দিল্লিতে রাজনাথ সিংয়ের সরকারি বাসভবনে ওই নৈশভোজে দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও।

কয়েকটি গণমাধ্যমের সূত্রে পাওয়া সাউথ ব্লকে সুষমা স্বরাজের দপ্তরে ওই বৈঠক চলে প্রায় ৪০ মিনিট। বৈঠকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বলে দাবি জাতীয় পার্টির।দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য এ বিষয়ে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত এখন জামায়াত ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেই একটা সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ একটি তৃতীয় শক্তি এবং কেউ স্বীকার করুক বা না করুক তারা পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দলও বটে। তাছাড়া এরশাদ নিজে একজন সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, কাজেই কেন নয়?’

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মতো না হলেও এবারের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, ভারত এই ফ্যাক্টরটাও মাথায় রাখছে বলে বললেন ভট্টাচার্য। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত বিএনপি এখনো পরিষ্কার করে বলেনি তারা নির্বাচনে যাবে কি না। তবে তারপরও গণতন্ত্রে একটা তৃতীয় শক্তির সবসময়ই কিন্তু বড় ভূমিকা থাকে।’ আসলে আমরা এখনো পর্যন্ত জানি না নির্বাচনি চিত্রটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে। কিন্তু কে বলতে পারে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে একটা বড় ভূমিকা নেবে না? এরশাদের ভারত সফর আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু আমার সংবাদকে বলেন, এরশাদের ভারত সফর নিয়ে বিএনপিসহ সব দলের মধ্যেই জল্পনা-কল্পনা আছে।

তাছাড়া গত নির্বাচনেও এরশাদ এই সরকারকে বৈধতা দেননি। তিনি তখন সামরিক হাসপাতালে আটক ছিলেন। তার স্ত্রীই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশ যেদিকে যাচ্ছে, দেশের সব মানুষের সাথে হয়তো এরশাদ সাহেবের চাওয়া এক জায়গায় এসে যেতে পারে। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আমরা দিল্লিতে এসেছি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সাবেক সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের সাথে বৈঠক হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথেও আমাদের বৈঠক হয়েছে।

কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন ও দেশের সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ঢাকায় এসে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইঙ্গিত দেবেন বলে জানান তিনি।

পঠিত : ৬৮৩ বার

মন্তব্য: ০