Alapon

ইসলামে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার

পরিবার, সমাজ এমনকি ইসলামপূর্ব ধর্মও যখন নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি; দেখেছে কেবলই ভোগের বস্তু হিসেবে সে চরম সংকটকালেই নারীমুক্তির বার্তা নিয়ে বিশ্ব মানবতার কাছে হাজির হলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। সৃষ্টিগত দূর্বলতাকে পুঁজি করে নারীর ওপর বয়ে যাওয়া নির্যাতনের অপ্রতিরোধ্য সাইক্লোন থামিয়ে দিলেন কঠোর হস্তে। নির্যাতনের উত্তাল সাগরের ঢেউ থামিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ন্যায় ও ইনসাফের শাস্বত নারী অধিকার। ক্ষেত্রবিশেষে নারীকে দিলেন পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার।

ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে নারীকে পুড়িয়ে মারার আইন রদ করা হয় ১৭৩৬ সালে। আর ইসলাম কন্যা সন্তানকে অভিহিত করেছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে।

নবীজি (সা.) বলেন,
‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান লালন পালন করেছে, পুত্র সন্তানকে কন্যাদের ওপর প্রাধান্য দেয়নি, তাদেরকে উত্তম আদশ শিক্ষা দিয়েছে, তাদেরকে বিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেছে, , সে জান্নাত লাভ করবে। (আবু দাউদ: ৫১৪৯)।

মালিকানার অধিকারঃ
১৮৮২ সলের `Married Women’s Property Act 1882’ এর পূর্বে বৃটিশ আইনে নারীর সম্পত্তিতে ছিল না কোনো অধিকার। বিবাহপূর্ব সময়ে নারীর উপার্জিত সম্পদের মালিকানা বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেত তার স্বামীর হাতে। ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না ইউরোপীয় নারীদের। হিন্দু নারীরা আজো বঞ্চিত উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে। অথচ সভ্যতার দাবিদার বৃটেনেরও তেরো শত বছর আগেই মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন দ্বীপ্ত কণ্ঠে।

পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে,
পুরুষেরা যা কিছু উপার্জন করে তার অংশ এবং মহিলারা যা উপার্জন করবে তার মালিকানা মহিলার। (সুরা নিসা: ৩২)।

একজন পূর্ণ বয়স্ক মুসলিম নারী, তিনি বিবাহিত হন বা নাই হন, কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই সম্পদের মালিক হতে পারেন, মালিকানা হস্তান্তরও করতে পারেন।

মোহরানার অধিকারঃ
হিন্দু ধর্মের হাত ধরে চালু হয়েছিল অভিশপ্ত যৌতুক প্রথা। যৌতুক মানেই মেয়ের কাছ থেকে আদায় করা। ইসলামে যৌতুক নামে কোনো অধ্যায় নেই। অধিকন্তু বিয়েতে যৌতুকের সম্পূর্ণ উল্টো ব্যবস্থা করেছে ইসলাম। পুরুষদের কষ্টর্জিত অর্থ বিয়েতে বাধ্যতামূলকভাবে তুলে দিতে হয় নারীর হাতে। দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহর আদায় করা প্রত্যেক স্বামীর অবশ্য কর্তব্য।

আল্লাহ বলেন,
‘তোমাদের নারীদেরকে তোমনি স্বত:স্ফুর্তভাবে প্রদান করাও বাধ্যতামূলক। (সুরা নিসা: ৪)।
ইসলাম নারীর মোহরানার সর্বোচ্চ স্তর নির্ধারণ করে দেয়নি। কিন্তু সর্বনিন্ম স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারঃ
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে নারীকে ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারও প্রদান করেছে ইসলাম। সুরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
‘আমি ব্যবসাকে করেছি হালাল আর সুদকে করেছি হারাম’।
এই আয়াতে ব্যবসা হালাল হওয়া এবং সুদ হারাম হওয়া নারী পুরুষ উভয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।

রাসুলে কারিম (সা.) এর স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। সাহাবী আসমা বিনতে মাখরাও (রা.) আতর ব্যবসায়ী ছিলেন। একজন পুরুষ হালাল পন্থায় যেসব ব্যবসা করতে পারবে একজন নারীও তা করতে পারবে। তবে হালাল বস্তু ও হালাল পদ্ধতির ব্যবসার শর্তের সঙ্গে নারীর জন্য যোগ হবে পর্দার অলঙ্ঘনীয় শর্ত।

উত্তরাধিকার:
কোনো কোনো ধর্মও যেখানে উত্তরাধিকারে নারীকে বঞ্চিত করেছে সেখানে পৃথিবীর যে কোনো ধর্মের তূলনায় ইসলাম নারীকের সবচেয়ে বেশি দেয়ার কথা বলেছে। উত্তরাধিকারে নারীর হিস্যা চুড়ান্তভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে ইসলাম।

এরশাদ হচ্ছে,
‘পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং নারীদেরও অংশ আছে। তা কম হোক বা বেশি। (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্ধারিত অংশ। (সুরা নিসা: ৭)।

আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সন্তানদের সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন,
এক ছেলের অংশ দু মেয়ের সমান। -সুরা নিসা: ১১।
কন্যা পিতৃ সম্পত্তিতে ভাইয়ের অর্ধেকসহ স্বামীর সম্পদেরও কমপক্ষে অষ্টমাংশ পেয়ে থাকেন।

চাকরির অধিকারঃ
ইসলামে নারীর চাকরির অধিকারও রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিত সাধারণভাবে যে কাজ বা পেশা পুরুষের জন্য বৈধ, তা নারীর জন্যও বৈধ। হজরত জয়নব (রা.) কুটির শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। তিনি চামড়া পাকা করার কাজে দক্ষ ছিলেন। এ কাজে যে অর্থ উপার্জিত হতো তা তিনি আল্লাহর পথে ব্যয় করতেন। -সহিহ মুসলিম।

নারীর দৈহিক সামর্থ্যে সহজসাধ্য যে কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন। তবে কঠোর শ্রমসাধ্য কোনো কাজ যেমন, খনির অভ্যন্তরে, লৌহজাত দ্রব্যাদি নির্মাণ ইত্যাদিতে নারীকে নিয়োজিত করা ইসলাম অনুমোদন করে না। মহিলাদের জন্য পর্দায় থেকে শিক্ষকতা, ডাক্তারীর মতো উপযোগী যেসব পেশায় শালীনতা, মর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রক্ষা করেও দায়িত্ব পালন করা যায় এমন পেশার অনুমোদন দিয়েছে ইসলাম। জরুরী কাজে নারী পর্দার সঙ্গে ঘরের বাইরে যাবে।

হজরত খাদিজা (রা.) রাসুলে কারিম (সা.) এর জন্য হেরা গুহায় খাবার নিয়ে যেতেন। রাসুলে কারিম (সা.) যখন সফরে যেতেন লটারির মাধ্যমে নিবচন করে একজন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এভাবেই নবীজির (সা.) জীবনে নারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা য়ায় একজন পুরুষ যে দায়িত্বপালন করে যে পরিমাণ অর্থ পান একজন নারী সে পরিমাণ কষ্ট করলেও তার মজুরী কম দেয়া হয়। নামে মাত্র বেতনে তাদেরকে কাজের বুয়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা কিছুতেই ইসলামে অনুমোদিত নয়।

ইসলাম মনে করে নারীকেও সমান বেতন ও মজুরি দিতে হবে। ব্যবসা, উত্তরাধিকার কিংবা চাকরির মাধ্যমে পাওয়ার পর সে সম্পদের র্পূর্ন নিয়ন্ত্রণকারীও নারী। একজন পুরুষ যেমন কোনো বিধি-নিষেধ ছাড়াই নিজ সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন, তেমনি একজন মহিলাও কোনো প্রকারের বিধিনিষেধ ছাড়াই তার সম্পত্তির ব্যাপারে সব ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন।

চাকরি, ব্যবসা, উপহার, মোহরানার মতো সম্পদ প্রাপ্তির বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা থাকলেও তাদের সম্পদ ব্যায়ের বাধ্যতামূলক কোনো নারীর ওপর কোনো প্রকার আর্থিক দায় দায়িত্ব চাপায়নি। একজন মহিলার অর্থনৈতিক দায়িত্ব পুরুষের ওপর ন্যস্ত। কন্যার বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত তার ভরণ-পোষনের দায়িত্ব তো পিতার ওপর। বিয়ের পর তা একেবারেই স্বামীর। এরপর তা সন্তানের ওপর। একান্ত যদি কোনো মহিলা স্বেচ্ছায় সংসারে তার উপার্জিত অর্থ খরচ করে তাহলে তা হবে অপূর্ব ভালোবাসার দৃষ্টান্ত।

পঠিত : ২১৫০ বার

মন্তব্য: ০