Alapon

ইমাম গাযালীঃ যাকে বলা হয় ইসলামের প্রমাণকারী দার্শনিক

রাসূল (সা.) এর প্রতিশ্রুতি অনুসারে, রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে প্রতিটি শতাব্দীতেই ইসলামের একজন  মুজাদ্দিদ বা পুনরূজ্জীবনকারী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটবে। সমকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রকার সমস্যা-সংকটের সমাধানের জন্য তারা দায়িত্ব পালন করবেন। ইতিহাসে এমন প্রতিটি শতাব্দীতেই মুসলিম  উম্মাহর বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সমস্যা সমাধানের জন্য পুনরূজ্জীবনকারী ব্যক্তিত্বের আর্বিভাব ঘটেছে। মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সমকালীন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তারা মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন সংকট থেকে প্রতিরক্ষায় সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তাদের কালজয়ী অবদানের জন্য ইতিহাসের পাতায় তারা স্বতন্ত্র অবস্থানের দাবিদার।

একাদশ শতাব্দীর এরূপ একজন কালজয়ী ব্যক্তিত্ব আবু হামিদ আল-গাযালী। তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি তার সমকালীন এরূপ কিছু ভয়াবহ চিন্তা ও দর্শনকে প্রতিরোধ করেন যা তৎকালীন মুসলিম মানসকে কলুষিত করে তুলেছিল। তার এই প্রচেষ্টার জন্য তাকে হুজ্জাতুল ইসলাম (ইসলামের প্রমাণকারী) হিসেবে  অবহিত করা হয়। গ্রীক দর্শনের প্রভাবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের ভেতরে প্রবেশকৃত বিভিন্ন প্রকার কলুষতার অসাড়তা তিনি তার ক্ষুরধার যুক্তিতর্কের সাহায্যে প্রতিহত করেন। একইসাথে ইসমাইলী মতবাদের প্রভাবে ব্যক্তিকে দেবত্ব প্রদানের চিন্তাধারার ভিত্তিমূলেও তিনি আঘাত করেন।

  জীবন

ইমাম গাযালী ১০৫৮ ঈসায়ীতে বর্তমান ইরানের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তিনি ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভুত, তথাপি তৎকালীন অন্যান্য মুসলিম শিক্ষিত লোকদের মতই তিনি আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন  করেন। শৈশব থেকেই তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও ইসলামী আইন সম্পর্কে অধ্যয়নে লিপ্ত হন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বাগদাদের বিখ্যাত নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন।

শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর ১০৮৫ ঈসায়ীতে তিনি ইসপাহানে সেলজুক প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলুকের দরবারে যোগদান করেন। নিজামুল মুলুক শিক্ষার সম্প্রসারনের জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্য খুবই পরিচিত ছিলেন। তিনি ইমাম গাযালীকে ১০৯১ সালে বাগদাদের নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। বাগদাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমাম গাযালী ছিলেন মর্যাদাবান ও জনপ্রিয় একজন শিক্ষক এবং প্রায়শই তার পাঠদানের সময় নির্ধারিত শ্রেনীকক্ষে ছাত্রদের ভীড় জমে যেত।

১০৯৫ ঈসায়ীতে আল-গাযালী তার নিজের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক চিন্তাগত সংকটে উপনীত হন। তার আত্মজীবনী অনুসারে, তার শিক্ষা প্রদান যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং তা যেন নিজের খ্যাতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়েই পরিচালিত হচ্ছিল।

নিজের আধ্যাত্মিক সংকট উপলব্ধি করে তিনি নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পদ পরিত্যাগ করে দামিশক, জেরুসালেম, হিজাযসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। তার এই ভ্রমণে তিনি তার আত্মার  পরিশুদ্ধতা অর্জনের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন এবং এরসন্ধানে তিনি তার সময়ের প্রচলিত বিভিন্ন দর্শনের পাঠের পরীক্ষণ করেন।

১১০৬ ঈসায়ীতে তিনি বাগদাদে ফিরে আসেন এবং পুনরায় শিক্ষকতা শুরু করেন। আত্ম পরিশুদ্ধি অর্জনে তার দীর্ঘপ্রচেষ্টা সাধারণ মানুষের উপর বিপুলভাবে প্রভাব বিস্তার করে কিন্তু একইসময়ে তিনি কিছু মতবিরোধের সম্মুখীন হন। ফলে তিনি তার জন্মস্থান তুসে ফিরে যান যেখানে তিনি ১১১১ ঈসায়ীতে ইন্তেকাল করেন।  

  দার্শনিক ভ্রান্তিখন্ডন

ইমাম গাযালী তার আত্মজীবনী “আল-মুনকিয মিন আদ্বালাল” (المنقذ من الضلال) গ্রন্থে সত্যকে সন্ধানের জন্য তৎকালীন জনসাধারণ কর্তৃক অনুসৃত বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি ছিল  দর্শনকেন্দ্রিক বিশেষত গ্রীক দর্শনকেন্দ্রিক যার ভিত্তি ছিল গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের দর্শন বিষয়ক আলোচনা।

ইমাম গাযালীর মতে এরিস্টটলীয় দর্শনের বিপদ ছিল দার্শনিকদের প্রদত্ত সমাধানে। দার্শনিক আলোচনার প্রেক্ষিতে উপসংহারে এসে কিছু দার্শনিক বিশ্বাস করা শুরু করেন আল্লাহর অস্তিত্বহীনতায় আবার কেউ চিন্তা করেন, দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আল্লাহর কোন উদ্বেগ বা চিন্তাভাবনা নেই। আল-গাযালী সহকারে মূলধারার মুসলিম দার্শনিকদের কাছে এধরনের চিন্তাভাবনা ছিল ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাতের শামিল।

ইমাম গাযালী লক্ষ্য করেন, মূলধারার সমকালীন কোন মুসলিম দার্শনিকই এই ধরনের দার্শনিক চিন্তাভাবনার যথার্থভাবে যুক্তিখন্ডনে সক্ষম হননি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি নিজে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। ১০৯৫ ঈসায়ীতে তার রচিত “তাহফাত আল-ফালাসাফা” (تهافت الفلاسفة) গ্রন্থে তিনি এই প্রকার দর্শনের ভ্রান্তি প্রদর্শন করে তার যুক্তিখন্ডন করেন।  

এছাড়া তার সমকালীন মুসলিম দর্শনের উপর প্রভাব বিস্তারকারী অপর একটি বৃহত্তম সমস্যা ছিল ইসমাইলি শিয়া দর্শন, যাতে অদৃশ্য অভ্রান্ত ইমামকেই ইসলামী আইন ও ব্যাখ্যার একমাত্র উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাদের মতে, রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত সকল যুগের মানব জাতির পথপ্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং ইমাম হিসেবে পরিচিত একজন বিশেষ পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতিযুগেই পথপ্রদর্শনের জন্য আবির্ভাবের প্রয়োজন রয়েছে।

ইমাম গাযালী তাদের তার আত্মজীবনীতে এরূপ দাবির সমালোচনা করে রাসূল (সা.) এর হাদীস ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাদের চিন্তার ভ্রান্তির উন্মোচন করেছেন। তার যুক্তির মাধ্যমে তিনি প্রমান করেন, রাসূল (সা.) এবং প্রাথমিক যুগের মুমিনদের দ্বীন অনুশীলনের সন্দেহাতীত বর্ণনার ভিত্তিতেই দ্বীনের অনুসরনই দ্বীনের অনুশীলনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর পন্থা।

  ইমাম গাযালী ও বিজ্ঞান

পাশ্চাত্যের তথাকথিত প্রাচ্যবিদরা মুসলিম সভ্যতায় বিজ্ঞান চর্চার বিলুপ্তির জন্য ইমাম গাযালীকে প্রায়শই দোষারোপ করে থাকেন। তাদের মতে, দর্শনকেন্দ্রিক তার সমালোচনা পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মকে বিজ্ঞান চর্চা করা থেকে অনুৎসাহিত করে। বিশেষ করে ইবনে সিনা ও আল-ফারাবীদের মত বিজ্ঞানীদের দর্শনকেন্দ্রিক কিছু আলোচনার সমালোচনা করায় পরবর্তী প্রজন্ম বিজ্ঞান চর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রকৃত সত্যটি সে তুলনায় খুবই সূক্ষ্ম।

ইমাম গাযালী যখন তার দর্শনকেন্দ্রিক বিভিন্ন আলোচনা করেন, তখন তিনি সুস্পষ্টভাবে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য বজায় রেখেছিলেন। তার মতে, কোন বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহনের পূর্বে বরং তা যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিত। বিভিন্ন শাস্ত্রে তার অবদান বিবেচনা করে তার সকল প্রকার মতকেই বিনাবিচারে গ্রহণ করার পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। আল-গাযালী দর্শনকেন্দ্রিক আলোচনা থেকে বিজ্ঞানের আলোচনাকে পৃথক করে বরং পরবর্তী প্রজন্মকে অনুমান নির্ভর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদান করার অনুশীলন থেকে মুক্ত করেন।

পরিশেষে বলা যায়, রাসূল (সা.) এর ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী তার জীবন সম্পূর্ণরূপে ইসলামের জাগরণে অতিবাহিত করেছেন। তার সমকালীন মুসলিম জগতে প্রচলিত বিভিন্ন চিন্তাগত কলুষতার প্রতিরোধ করে তিনি যর্থাথই ‘ইসলামের প্রমাণকারী’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করেছেন।  

পঠিত : ১৪৯৮ বার

মন্তব্য: ০