Alapon

আমার ইসলামে ফিরে আসার গল্প...

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। তাপমাত্রা কিছুটা কমা শুরু করেছে। গাছের পাতাগুলো লাল, হলুদ, কমলারঙ ধারণ করছে।

তখনো আমি মুসলমান হইনি, খৃষ্টান ছিলাম। ধার্মিক খৃষ্টান নই, নামেমাত্র খৃষ্টান।

১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টেক্সাসের বিজপোর্টে আমার জন্ম। আমার পুরো পরিবার ছিলো খৃষ্টান। ব্রিজপোর্ট হাই-স্কুল থেকে ২০০০ সালে পড়ালেখা সমাপ্ত করি। সময়টা বেশ ভালোই কাটছিলো।

২০০১ সালে আমার জীবনে নেমে আসে মহা বিপর্যায়। রঙ্গিন আকাশে হঠাৎ কালো মেঘের ঘনঝাপটা। টেক্সাসের ডিকাতোর শহরে কার এক্সিডেন্ট করি! এক্সিডেন্টের পর অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে রই। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে। হাত-পা নাড়াতে পারছিলাম না। ডাক্তার এসে বললো, আমার কোয়াড্রিপ্লেজিক (Quadriplegic) হয়েছে। গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে।

জাস্টিন শহরের Longmeadow Care Center নামের একটা নার্সিং হোমে আমাকে ভর্তি করা হয়। এই নার্সিং হোমের বেশিরভাগ রোগীর বয়স ৯০-১০০ বছর। একমাত্র আমিই যুবক, ২১ বছরের একজন প্যারালাইজড যুবক।

প্রথমদিকে নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খেতে হতো। এভাবে খাবার খাওয়া অনেক কষ্টকর ছিলো। আস্তে আস্তে চেষ্টা শুরু করলাম খাবার চিবিয়ে খেতে। চিবিয়ে খাওয়ার অদম্য চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলাম।

নার্সিং রুমে আমার এক রুমমেট ছিলো। তার নাম মার্ক। তার একটা লিভারের প্রয়োজন ছিলো। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর জন্য সে অপেক্ষা করছিলো। 
সে ছিলো খৃষ্টান , গলায় সবসময় ক্রুশ ঝুলিয়ে রাখতো।

অল্পদিনের মধ্যেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। নার্সিং রুমের মধ্যে বসে বসে আমরা নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। স্রষ্টা, জীবন এগুলো থাকতো আমাদের আলোচনার মূল টপিক।

একদিন শুনতে পেলাম মার্ককে এক লোক লিভার ডোনেট করবেন। মার্ক আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। মার্ককে বিদায় জানালাম। কে জানতো, এই বিদায়ই হবে শেষ বিদায়?

লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার সময় অপারেশন টেবিলে মার্ক মারা যায়! মার্কের মৃত্যুসংবাদে যেনো স্বজন হারানোর আর্তনাদে আমি চিৎকার করে উঠলাম। মার্কের বোন মার্কের শেষ স্মৃতি গলায় ঝুলানো ক্রুশটি আমাকে দিয়ে যান। ক্রুশটি আমার বেডের পাশে রাখতে বললাম।

নার্সিং রুমে একাকী দিন কাটানো শুরু হলো। অবশ্য আমার পরিবার আমার জন্য একটা ভয়েস কমান্ড কম্পিউটারের ব্যবস্থা করেছিলো। ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে আমি ইন্টারনেটে ব্রাউজিং করতে পারতাম।

মার্ককে হারানোর সাতবছর কেটে গেল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। রাতে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম।

আমি মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়ানো। মরুভূমির বাতাস বইছে, বালি উড়ছে। তখন দেখলাম (আনুমানিক) ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা এক লোক আমার দিকে আসছেন। আমার কাছে এসে ক্রুশটি দেখিয়ে বললেন,
"আল্লাহ এই জন্য তাঁর রাসূল পাঠাননি, যেন মানুষ তার উপাসনা করে। বরং আল্লাহ রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন যাতে মানুষ আল্লাহর উপাসনা করে। যীশু হচ্ছেন কেবলমাত্র একজন মানুষ। তিনি বাজারে যেতেন, খাবারও খেতেন।"

এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গার পরপরই আমি আনমনে বলে উঠলাম, "আসহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুল্লাহ।"

আমি তখন জানতামও না, মুখ দিয়ে যা বললাম এগুলোর মানে কী। কোনো এক অদ্ভূত শক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে আমি এগুলো বললাম। আমার মনে পড়লো স্বপ্নে দেখা লোকটা নিজেকে 'মুহাম্মাদ' (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে পরিচয় দিয়েছিলো। আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

কম্পিউটারে ভয়েস কমান্ড করলাম 'মুহাম্মাদ' বলে। সার্চ রেজাল্টে ইসলামের অনেকগুলো বিষয় আসলো। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, ঘুম ভাঙ্গার পর মুখ দিয়ে আমি যা উচ্চারণ করেছি সেগুলো হলো ইসলামের টেস্টিমনি। ইসলাম নিয়ে আমি পড়া শুরু করলাম। আমি বুঝতে পারলাম আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কোনো কাকতালীয় ব্যাপারও নয়। আল্লাহ চাচ্ছেন আমাকে হেদায়াত দিতে। আমি তখন মনেপ্রাণে মুসলমান হয়ে যাই।

Chat Room এ গিয়ে আমি জানালাম, আমি কুর'আন শিখতে চাই। স্কাইপিতে একজন আমাকে আরবী বর্ণমালা শিখিয়ে দিলেন। নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে আমি কুর'আনের দশটি সূরা মুখস্থ করি। তারপর আমার মনে হলো, আমাকে কুর'আন বুঝতে হবে।

'How to understand the Quran' বলে সার্চ দিলাম। অমনি পেয়ে গেলাম আমেরিকার একজন মুসলিম স্কলারের ইউটিউবে কুর'আন নিয়ে লেকচার ভিডিও, নোটস। সবগুলো ভিডিও দেখলাম, নোটসগুলো পড়লাম।

আমাদের নার্সিং হোমে মিসরের এক লোক ছিলো। সে সার্ভিসিং এর কাজ করতো। সে ছিলো মুসলমান, তবে ধর্মকর্ম পালন করতো না। এমনকি সপ্তাহে জুম্মার নামাজও পড়তো না। মাঝেমাঝে ধর্মের কথা মনে পড়লে সে নার্সিং হোমের কাছাকাছি একটা চার্চে যেতো। চার্চে গিয়ে সে প্রার্থনা করতো, অথচ সে ছিলো মুসলমান!

একদিন আমি রুমে বসে সূরা আসর তেলাওয়াত করছিলাম। ঐ সময় মিসরের লোকটি আমার রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার যাচ্ছিলো। আমার তেলাওয়াত শুনলো। আমার রুমে ডুকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি এতক্ষণ কী শুনছিলে?"
আমি বললাম, "কই? আমি তো কিছু শুনছিলাম না। বরং আমি কুর'আন তেলাওয়াত করছিলাম।"

আমি মুসলমান হয়ে গেছি শুনে লোকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে।

আমাকে বললো, "আমেরিকার টেক্সাস শহর। চারদিক ভর্তি চার্চে। নার্সিং হোমের বিছানার পাশে ঝুলানো একটা ক্রুশ নাড়ানোর ক্ষমতা তোমার নাই। আর তুমি কিনা মুসলমান হয়ে গেছো?"

আমি তাকে আমার সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে সে বললো, "নার্সিং হোমের একজন প্যারালাইজড খৃষ্টানকে যদি আল্লাহ স্বপ্নের মাধ্যমে হেদায়াত দিতে পারেন তাহলে আল্লাহ আমাকেও হেদায়াত দিতে পারেন। আমি আবারো আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে চাই।"

মিসরের এই লোকটি আমার জন্য দু'আ করলো, যাতে আমি ঐ লোকটির সাক্ষাৎ পাই যার ভিডিও দেখে আমি কুর'আন বুঝতে শিখেছি।

একদিন দেখলাম সেই স্কলার আমার রুমে এসেছেন। অথচ তার সাথে আমার কোনো ধরণের যোগাযোগই হয়নি। আমার মিসরের ঐ বন্ধুটি আবার নতুন করে যখন ইসলাম মানা শুরু করলো তখন টেক্সাসের ফোর্টওয়ার্থ মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গেলো। সেখানে দেখা হলো ঐ স্কলারের সাথে, যার ভিডিও দেখে আমি কুর'আন বুঝতে শুরু করি। সে আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী তাকে বললে তিনি তাকে সাথে নিয়ে চলে আসেন আমাকে দেখতে।

আমাকে দেখার পর সেই স্কলার বললেন, "আমি শুনেছি তুমি কুর'আনের দশটি সূরা মুখস্থ করেছো। আমাদেরকে একটি সূরা তেলাওয়াত করে শুনাবে?"

আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাই। তাদেরকে সূরা আসর তেলাওয়াত করে শুনাই। আমার তেলাওয়াত শুনে সেখানে এমন একজনও ছিলেন না যার চোখ দিয়ে পানি ঝড়েনি। সবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগলো।

আমার মনে হলো, আমি মুসলমান হলাম ঠিকই, কিন্তু আমি জীবনে কখনো নামাজই পড়লাম না, মসজিদে গেলাম না, তাহলে আমি কিসের মুসলমান? 
একদিন জুম্মার নামাজে যাবার জন্য আমি নার্সিং হোমের নার্সদেরকে অনুরোধ করি। তখন আমার স্পেশাল ভ্যানটি ছিলো না, সাধারণ ভ্যানে করে মসজিদে যাই। এতে আমার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগে। অসহ্য ব্যাথা নিয়ে আমি নার্সিং হোমে ফিরে আসি।

নার্সরা আমাকে বললো, "তোমার মেরুদণ্ডে এমন আঘাত লেগেছে যে, তুমি আগামী ছয় মাস এই বিছানায় বসতে পারবেনা। বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।"

একদিন মসজিদে নামাজ পড়তে যাবার জন্য এরকম অসহ্য ব্যাথা, ছয় মাস শুয়ে কাটানোর পরিণতি!

তিন মাস পার হবার পর সেই স্কলার আবার আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাকে আমার জীবনের প্রথম নামাজ পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে বলি,

"আমি আমার জীবনে এর চেয়ে শান্তির জায়গায় যাইনি, যতোটা শান্তি আমি ঐ মসজিদে যেয়ে পেয়েছি। আমি সুস্থ হবার পর কি করবো জানেন? আমার চেয়ারটা ফেরত পেলে আমি আবার যাবো ঐ মসজিদে নামাজ পড়তে!"

(লেখাটি আমেরিকার নওমুসলিম রবার্ট ডেভিলার ইসলাম গ্রহণের সত্যিকারের কাহিনী অবলম্বনে লিখা।)

পঠিত : ১৫০৩ বার

মন্তব্য: ০