Alapon

৪০ কিলোমিটার পথ হেটে বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাতের সাক্ষাত পেলাম

নাম তার পাইন্দু সাইতার/ তিনাপ সাইতার। বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অবস্থিত, যা এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত। যেতে হলে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে ৪০ কিলোমিটার পথ। আবার সেই পথেই ফিরে আসতে হবে। বম ভাষায় সাইতার শব্দের অর্থ ঝরনা। পরে অবশ্য গিয়ে জানা যায় ঝরনাটির নাম তিনাপ সাইতার (Tinap Saitar Waterfall)।

বান্দরবান পৌঁছে বাস থেকে নেমে রোয়াংছড়ির বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে যেতে হবে রোয়াংছড়ি। সেখান থেকে গাইড নিয়ে ২৩ কিমি হেঁটে যেতে হবে রনিন পাড়া। রাতে রনিন পাড়ায় থেকে পরের দিন ৪/৫ ঘণ্টা হেটে (হাটার গতি ও স্ট্যামিনার উপর নির্ভর করে সময় বেশি বা সামান্য কম হতে পারে) পাইন্দু খাল ও বিশাল পাহাড় পেরিয়ে যখন চোখের সামনে অকস্মাৎ উদিত হয়, এই তিনাপ সাইতার, সকল কস্ট, বেদনা নিমেষে পরিণত হয়, অদ্ভুত এক ভালোলাগায়, অদ্ভুত এক মাদকময় নেশায়।



কিভাবে যাবেনঃ
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি ছেড়ে যায়। যেমন শ্যামলি, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, ডলফিন- এর যেকোনো একটি বাসে চড়ে আপনি বান্দরবানের যেতে পারেন। রাত ১০ টায় অথবা সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগান, সায়েদাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে এসব বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নন এসি বাসে জন প্রতি ভাড়া ৫৫০ টাকা। এসি ৯৫০ টাকা।

চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে পারেন। বদ্দারহাট থেকে বান্দারবানের উদ্দেশে পূবালী ও পূর্বানী পরিবহনের বাস যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ২২০টাকা ভাড়া রাখা হয়।

বাস যেখানে থামবে সেখান থেকে রোয়াংছড়ি যাওয়ার বাসস্ট্যান্ডে যেতে টমটম ভাড়া ১০ টাকা। রোয়াংছড়ির বাস এক ঘণ্টা পরপর ছাড়ে, কাজেই বান্দরবানে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ পাবেন। এরপর জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে যান রোয়াংছড়িতে। পৌঁছাতে সময় লাগবে ঘণ্টা দেড়েক। তবে চাইলে হোটেল হিলভিউর সামনে থেকে মাহেন্দ্রও রিজার্ভ নেওয়া যায়। খরচ পড়বে ১০০০-১২০০-এর মধ্যে। ১২ থেকে ১৪ জনের দল হলে মাহেন্দ্র খুবই চমৎকার বাহন। সময় লাগবে এক ঘণ্টার মতো।

রোয়াংছড়িতে নামার পর গাইডকে সঙ্গে নিয়ে যে কয়দিন থাকবেন সেই কয়দিনের উপযোগী চাল, ডাল, মসলা, মুরগি, ডিম, আনাজপাতি যা চান কিনে নিতে পারেন। বলে রাখলে গাইড নিজেও আগেভাগে বাজার করে রাখতে পারে। ভালো গ্রিপের স্যান্ডেল পাওয়া যায় রোয়াংছড়ি বাজারে। জোড়াপ্রতি দাম ১৫০ টাকার মতো পড়বে। এখানে রাধামন নামে একটি হোটেল আছে, ক্লান্ত লাগলে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিতে পারেন। বিশ্রাম শেষে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হবে ‘রনিনপাড়া’।

রনিনপাড়ায় পৌঁছানোর দুটি পদ্ধতি আছে। চাঁদের গাড়িতে যেতে পারেন অথবা হেঁটেও যাওয়া যায়। চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ নিলে খরচ পড়বে ৫৫০০ টাকার মতো। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে খাড়া এক পাহাড়ে কাছে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে ঘণ্টাখানেক হেঁটে যেতে হবে। আর যদি খুবই কষ্টসহিষ্ণু হন আর পাহাড় দেখে মনটা যদি উশখুশ করে, তাহলে রোয়াংছড়ি থেকেই নেমে পড়ুন রাস্তায়। রোয়াংছড়ি শহরের পাশেই পাহাড়ি ছড়া ধরে হাঁটতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। এরপরে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রনিনপাড়া পৌঁছাতে কমসে কম ঘণ্টা ছয়/সাত সময় লাগবে। প্রকৃতিপ্রেমী হলে অবশ্য শুরুতে বেশ উপভোগই করবেন। কখনো দেখবেন পাশের খাড়া পাহাড় উঠে গিয়েছে বহুদূর, কখনো দেখবেন দুই পাশ থেকে বিস্তৃত ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, আবার কখনো হাঁটতে হবে ঠাসবুনোটের জঙ্গলের মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে।

রনিনপাড়ায় পৌঁছে বিশ্রাম নেবেন। এখানে গাইডই সর্বেসর্বা। সেই আপনার থাকা, গোসল, খাওয়ার বন্দোবস্ত করবে। রনিনপাড়ার বেশির ভাগ মানুষই বম জাতির। পাশাপাশি এখানে বেশ কিছু তঞ্চংগ্যাও থাকেন। চায়ের দোকানও আছে, আছে পানির বন্দোবস্ত। আশপাশের দুর্গম অঞ্চলের তুলনায় রনিনপাড়া এক স্বর্গ বললেও চলে। এখান থেকে মোবাইল বা ক্যামেরা চার্জ দিয়ে নিতে পারেন। সৌরবিদ্যুতের কল্যাণে কিছু কিছু বাড়িতে আলোর ব্যবস্থা আছে। রনিনপাড়া পৌঁছে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করতে হয়। তবে আপনার গাইড আগেভাগে সমঝোতা করে রাখলে এই ঝামেলা নাও পোহাতে হতে পারে। পরেরদিন খুব ভোরে তিনাপের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। তাই রনিনপাড়ায় পৌঁছেই যতটা দ্রুত সম্ভব ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করা ভালো।

রনিনপাড়া থেকে তিনাপ সাইতারে যেতে হলে চেষ্টা করবেন যতটা সকাল সকাল সম্ভব যাত্রা শুরু করার। তিনাপ সাইতার রনিনপাড়া থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরত্ব অবস্থিত। যেতে কমবেশি চার ঘণ্টা সময় লাগবে। ভরাপেটে পাহাড়ে হাঁটা খুবই কষ্টকর। তাই হালকা কিছু খেয়ে বেরুনোই ভালো। ব্যাগ-ট্যাগ সঙ্গে নেওয়ার চিন্তা দূরে রাখবেন! সঙ্গে শুধু পানি আর অন্যান্য টুকিটাকি নেবেন। রনিনপাড়া থেকে ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলে পৌঁছাবেন দেবাছড়াপাড়ায়। চাইলে সঙ্গে নুডলস বা স্যুপজাতীয় কিছু নিয়ে এসে এখানে রান্না করতে পারেন।

দেবাছড়া পাড়া থেকে আপনাকে নামতে হবে পাহাড়ি ছড়ায়। এই রাস্তাটি চমৎকার। দুই পাশে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, মাঝে মাঝে গয়ালের দেখা পাবেন। এরা হলো বন্য গরু (গৌর) আর গৃহপালিত গরুর সংকর। চোখ খোলা রাখলে সাপ অথবা কাঁকড়াও চোখে পড়তে পারে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। যেসব পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটবেন, সেগুলো পানি আর শ্যাওলার কল্যাণে খুবই পিচ্ছিল। বেকায়দা আছাড় খেলে হাত-পা ভাঙা বিচিত্র না।

ছড়া থেকে উঠে আপনাকে বেশ খানিকটা পাহাড় বাইতে হবে। এখানকার রাস্তা কষ্টসাধ্য, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ে ওপর থেকেই চোখে পড়বে বিশাল পাইন্দু খাল। পাইন্দু খালের আগে আগে বেশ খাড়া একটা পাহাড়ি রাস্তা নেমে গিয়েছে, এটা দিয়ে নামার সময় একটু সাবধানে নামা ভালো।

তিনাপ সাইতার পাইন্দু খাল দিয়েও যাওয়া যায়, আবার কিছুটা ঘুরপথে পাহাড় দিয়েও যাওয়া যায়। পাইন্দু খালের রাস্তা বেশি সুন্দর সেই সঙ্গে বিপদের আশঙ্কাও কিঞ্চিত বেশি। খালের কোনো কোনো জায়গায় প্রচণ্ড স্রোত, পা রাখাই দায়। গাইড দক্ষ হলে অবশ্য অনায়াসে আপনাকে এগুলো পার করিয়ে নেবে। তবে বর্ষাকালে পাইন্দু খাল দিয়ে না যাওয়াই ভালো। সাতাঁর না জানলে তো অবশ্যই না।

তবে যে পথেই যান, তিনাপের কাছাকাছি পৌঁছালেই পানির গর্জন কানে আসবে। তারপরে আর কি, সামনেই দেখবেন সেই প্রকাণ্ড জলপ্রপাত। আশপাশে পড়ে আছে বিশালকায় সব পাথর আর স্রোতের তোড়ে ভেসে আসা গাছ। আর দুই পাশ দিয়ে খাড়া জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় শত ফুট উপরে উঠে গিয়েছে। যেকোনো একটা পাথরে উঠে যান, কিংবা প্রপাতের তলায় গিয়ে ঠান্ডা পানিতে গোসল করুন। শরীর মন জুড়িয়ে আসবে। যাত্রাপথের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য এর থেকে বড় টনিক আর নেই। নিজের চোখে দেখলেই বুঝতে পারবেন, অফিশিয়াল কোনো ঘোষণা না থাকলেও কেন তিনাপকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত বলা হয়! জলপ্রপাতের পানিতে গোসল করে, বিশ্রাম নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরুন। এ রকম চমৎকার একটা জলপ্রপাত দেখার পর, ফিরতে আর বিশেষ শারীরিক কষ্ট হওয়ার কথা না।

আরেকটা রুট হলো – বান্দরবান-রোয়াংছড়ি-কেপ্লাংপাড়া-পানখিয়াংপাড়া-রনিপাড়া-দেবাছড়াপাড়া-তিনাপ সাইতার-আত্তাপাড়া-রুমা-বান্দরবান।

এক্ষেত্রে হাটা বেশি কিন্তু ট্রাইলটা অসাধারন। বান্দরবান থেকে মাহিন্দ্রা (ভাড়া ৬০০-৮০০ টাকা) বা চান্দের গাড়ি (ভাড়া ৮০০-১০০০ টাকা) করে রোয়াংছড়ি। রোয়াংছড়ি বাজার থেকে একজন গাইড সাথে নিয়ে আর্মি ক্যাম্প ও থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। রোয়াংছড়ি থেকে হেটে কেপ্লাংপাড়া, পানখিয়াংপাড়া হয়ে রনিপাড়া, রনিপাড়া আর্মি ক্যাম্পে অনুমতি নিতে হবে, রাতে রনিপাড়া থকতে হবে (থাকা জন প্রতি ১০০-১৫০ টাকা, খাওয়া জন প্রতি ১০০ টাকা)। পরদিন রনিপাড়া থেকে দেবাছড়াপাড়া হয়ে তিনাপ সাইতার, সেখান থেকে নতুন পাড়া হয়ে আত্তাপাড়া, রাতে আত্তাপাড়া থকতে হবে (থাকা জন প্রতি ১০০ টাকা, খাওয়া জন প্রতি ৮০ টাকা)। পরদিন আত্তাপাড়া থেকে চান্দের গাড়ি (ভাড়া ৪০০০-৬০০০ টাকা) করে রুমা হয়ে বান্দরবান।



কোথায় থাকবেনঃ
রোয়াংছড়িতে রাধামন নামে একটি হোটেল আছে। কক্ষপ্রতি ঘণ্টায় ১৫০-২০০ টাকা ভাড়া নেবে। চাইলে এখানে রাতও কাটাতে পারেন। এসি রুম ১৫০০ টাকা আর নন এসি রুম ৫০০ টাকা নিবে। রাধামন ছাড়াও প্রায় একই খরচে একই সুবিধাসমেত বেশ কয়েকটি হোটেল পাবেন। এ ছাড়া রনিন পাড়ার আদিবাসীদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা আছে যা গাইডই ব্যবস্থা করে দেবে।

গাইডঃ
ঢাকা থেকেই গাইডের সঙ্গে কথা বার্তা বলে রাখতে হবে। গাইডের খরচ দিনপ্রতি অন্তত ৫০০ টাকা, বাকিটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। এর সঙ্গে রনিনপাড়ায় প্রতি রাত থাকা বাবদ ১৫০ টাকা আর সেই সঙ্গে রান্না, লাকড়ির খরচ ইত্যাদি বাবদ কিছু দিতে হয়। বাজার আপনি গাইডকে সঙ্গে নিয়েও করতে পারেন, অথবা গাইড নিজেই আগেভাগে করে রাখতে পারে।

এই জায়গাটা এখনো ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে প্রচলিত না। কাজেই গাইড আপনার গলা কাটার চেষ্টা করবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। মানুষ হিসেবে এখানকার সবাই বেশ অতিথিপরায়ণ ও সৎ। কাজেই বেশি দরদাম করতে না যাওয়াই ভালো। এ রকম একজন গাইডের নাম জেমসন। উনি রনিনপাড়ায় বেশ নাম-ডাকওয়ালা মানুষ। তার মোবাইল নম্বর (০১৮৭৯৫১৫০৮২/০১৫৩২৪৫৭২২০)।

পঠিত : ৬৮৫ বার

মন্তব্য: ০