Alapon

সেক্স ওয়ার্কার...

১.
সামনেই এক আত্মীয়ের বিয়ে। নিউ মার্কেটে এলাম গিফট কিনতে।

নিউ মার্কেটে এলে খুব সাবধানে থাকতে হয়। দোকানদারগুলো মহা ধূর্ত। একটি এদিক সেদিক হলেই আজেবাজে জিনিস ধরিয়ে দেয়। তার উপর দামও চায় গলাকাটা। ২০০ টাকার জিনিস চোখ বন্ধ করে ২০০০ টাকা বলবে। লজ্জা শরমের বালাই নেই।

আগে আগে আমি খুব ঘাবড়ে যেতাম। ২০০০ টাকা দাম চাইলে ভয়ে ভয়ে বলতাম ১২০০। দোকানদারগুলো চোখ মুখ কুচকে এমন একটা ভাব করত, যেন আমি গন্ড মুর্খ, গেঁয়ো। এই জিনিস জীবনে প্রথম দেখেছি। লজ্জা পেয়ে হয়তো বাড়িয়ে বলতাম ১৫০০। ওরা খুব সুন্দর করে প্যাকেট করে দিত।

এখন বুঝি এ সবই ওদের চালাকি। ঠকে ঠকে আমিও এখন খুব সতর্ক। ওদের মুড ধরাকে মোটেও পাত্তা দেই না। বরং এখন আমিই চোখ মুখ কুঁচকে থাকি। এমন ভাব করি, যেন এই দোকানের জিনিস সবই ফালতু। দর দামও শুরু করি একেবারে নিচ থেকে। আস্তে আস্তে বাড়াই।

এই বুদ্ধিতে ভালই কাজ দেয়। এখন লোকগুলো উলটো আমাকে তোয়াজ করে। মুখের হাসি যেন আর সরে না। বুঝতে পারে, আমাকে আগডুম বাগডুম বুঝিয়ে কোন লাভ নেই।

একটা শো পিস পছন্দ করলাম। দর দাম করে টাকা দিতে যাব। এমন সে সময় কে যেন পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল “আরে মারিয়া তুই?”

আমি চমকে পেছনে তাকালাম। দেখি-হেলেন। কলেজ জীবনে আমরা খুব ক্লোজ ছিলাম। এক সাথে ছাত্র রাজনীতি করেছি। শ্রেণি সংগ্রামের স্বপ্ন দেখেছি। মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেলিন গুলে খেয়েছি। কলেজের পর আমি চলে আসি ঢাকায়। এরপর হেলেনের সাথে আর যোগাযোগ হয় নি।

“আরে তুই কোত্থেকে?” আমি হেলেনকে জড়িয়ে ধরলাম।

“নিউ মার্কেটে এসেছিলাম একটা কাজে। তোকে দেখে তো প্রথমে চিনতেই পারি নি। কমরেড মারিয়া কি করে হুজুরাইন হয়ে গেল! আমিতো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না” হেলেন স্বভাব সুলভ ভাবে চেঁচিয়ে উঠল।

জবাব দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। দোকানের লোকজন সব আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। হেলেনকে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। ঢুকলাম একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে। দু জনের জন্য স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিলাম।

“তুই কোথায় আছিস? কি করছিস”

হেলেন ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিল। ভিজিটিং কার্ড। আমি চোখ বোলালাম। কার্ডে লেখা – মানসিঃ এসো আলোর পথে।

হেলেনের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।

হেলেন বলল “আমি একটা এনজিও চালাই।“

“তোর নিজের?”

“ফান্ড রেইজ করা, এনজিওর কাজ চালানো সব আমিই করি। সে হিসেবে আমার নিজের বলতে পারিস”

“কি নিয়ে তোদের কাজ?”

হেলেনের মুখে কিছুটা ইতস্তত ভাব। এদিক সেদিক তাকাল আশেপাশে। গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল “আমি সেক্স ওয়ার্কারদের নিয়ে কাজ করি”

হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম “ও আচ্ছা”। আমার চোখ নামানো। আমি বুঝতে পারছিলাম, হেলেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও সামলে নিল।

কিছুক্ষনের নিরবতা। ইতিমধ্যে স্যান্ডউইচ আর কফি দিয়ে গেল।

একটু পরে হেলেনই মুখ খুলল “তোর খবর তো বললি না। কোথায় আছিস? কি করছিস?”

স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে জবাব দিলাম “আমি? তেমন কিছু করছি না। পুরোদস্তর হাউজওয়াইফ বলতে পারিস”

হেলেনের মুখে হাসি ফুটল “তাই নাকি? তা তোর জামাই কি করে?”

“ও আছে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে...তোর জামাই?”

“জানি না”

“তোর জামাই, অথচ তুই জানিস না...এর মানে কি? চোরা কারবারি নয়তো?” আমি টিপ্পনী কাটলাম।

হেলেন পালটা হাসল “ জানিনা, কারণ তার সাথে আমার এখনো দেখা হয় নি। আমি বিয়ে করি নি”

“তাই বল। তা বিয়ে করিস নি কেন? সারা জীবন চিরকুমারী থাকবি?”

“আরে নাহ! আমি খুব সাধারণ মানুষ। অতটা আদর্শবাদী নই। বলতে পারিস হয়ে উঠে নি। তা তোর সন্ধানে পাত্র আছে নাকি?”

“পাত্র? কেমন পাত্র চাস? অ্যালুমিনিয়ামের নাকি মেলামাইনের? বল, নিউমার্কেট থেকে কিনে দেই” আমি হাসলাম।

হেলেনও হেসে উঠল “তুই হুজুরাইন হলে কি হবে? আগের মতই ফাজিল রয়ে গেছিস।“

“জানিস তো, কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না”

“তোকে দেখে আমার আসলেই অবাক লাগছে। এক সময়ের কমরেড কি করে হুজুরাইন হয়ে গেলি? কাহিনী কি?”

“সে অনেক কথা। পরে বলব” আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম “আজ উঠতে হবে রে। বেশ কিছু কেনাকাটা বাকি”

হেলেনও উঠল “এক কাজ কর। তুই একদিন আমার অফিসে চলে আয়। চুটিয়ে গল্প করা যাবে। আসার আগে একটা ফোন দিয়ে আসিস। আমি সাধারণত বিকেল ৪ টার পরে ফ্রি থাকি। অবশ্য চাইলে যে কোন ছুটির দিনেও চলে আসতে পারিস। আমার বাসা অফিসের উপর তলায়।“

আমি হেলেনকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বিদায় নিলাম।
.
.
২.
এক শনিবারে হেলেনের অফিসে গেলাম।

আমার বর অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। ভাবলাম হেলেনের অফিস থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়।

হেলেন অফিসেই ছিল। আমাকে দেখে খুব খুশি। বলল “আজকেই একটা জরুরী মিটিং ছিল। এক বিদেশী ডোনারের সাথে। শেষ মুহূর্তে মিটিংটা ক্যান্সেল হয়ে গেল। এই মুহূর্তে হাতে তেমন কাজও নেই। তুই আসাতে ভালই হল। মন খুলে আড্ডা দেয়া যাবে। তা কি খাবি? চা না কফি?”

“শুধুই চা কফি খাওয়াবি? আর কিছু না? অফিসগুলো সব এক রকম। তোদের ব্যাকরণে চা কফি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তোর অফিসে আজ প্রথম এলাম। আরও ভাল কিছুর অফার করতে পারতি!”

প্রাণখোলা হাসিতে হেলেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল “অফিস কি হোটেল নাকি রেস্তরা যে শখানেক আইটেম থাকবে? অফিসে চা কফি ছাড়া আর কিছু রাখা সম্ভব নয়। তাইতো চা কফির কথা বললাম। অন্য কিছু খেতে চাইলে বাইরে থেকে আনাতে হবে। আনাব?”

“আরে নাহ! তোর সাথে মজা করলাম। আপাতত কফি হলেই চলবে”

হেলেন সুশ্রী চেহারার এক মেয়েকে ডেকে কফির অর্ডার দিল।
মেয়েটা যেতেই হেলেনের চেহারা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। একটু আগের হাসি খুশি ভাবটা নেই।

হেলেন নিজ থেকেই বলল “আমার এখানে যারা কাজ করে, তারা সবাই প্রাক্তন সেক্স ওয়ার্কার। ওদের হাতের চা\কফি খেতে আপত্তি নেই তো?”

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় আমিও কিছুটা বিব্রত “ন…না! আপত্তি থাকবে কেন?”

হেলেন কিছুটা শ্লেষের সাথেই বলল “তোর মত আরও অনেকের সাথেই আমার কথা হয়। দেখা হয়। আমি সেক্স ওয়ার্কারদের নিয়ে কাজ করি জেনে তাদের চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। এমনভাবে তাকায়, যেন আমি নিজেও ঐ পেশার মানুষ। সেক্স ওয়ার্কারদের হাতের খাবার খেতে তারা ঘৃনাবোধ করে। যেন তাদের জাত চলে যাবে।“

হেলেন কিছুক্ষণের জন্য থামল। তারপর আবার বলা শুরু করল “অথচ তারা বোঝার চেষ্টা করে না, আমি এই সব মানুষদের আলোর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। তাদেরকে একটা ঠিকানা দেয়ার চেষ্টা করি। কাজ করি যাতে তারা ঐ পেশা ছেড়ে ভাল কোন পেশা বেছে নেয়। আলোর পথে ফিরে আসে।

এই যে একটু আগে মেয়েটাকে দেখলি, ওর নাম আশা। মোটামুটি ভাল পরিবারের মেয়ে। বিদেশ গিয়েছিল ভাগ্য ফেরাবে বলে। কথা ছিল ওর চাকুরী হবে। মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে।

কিন্তু কিসের কি? সেখানে গিয়েই ও হয়ে যায় যৌন দাসী। তার মালিক তার উপর শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। প্রতিবাদ করলে খাবার পানি বন্ধ করে দিত। দিনের পর দিন একটা রুমে আটকে রাখত। এক সময় ও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে”

“তারপর?” আমি জানতে চাইলাম।

“সহ্য করতে না পেরে ও একদিন পালায়। পুলিশের সহায়তায় দেশে ফিরে আসে। কিন্তু এদেশের মানুষ, এদেশের সমাজে ওকে মেনে নেয় নি। ভাগ্যের পরিহাসে ওর ঠাঁই হয় নিষিদ্ধ পল্লিতে।

আমরা ওর খোঁজ পেয়ে নিয়ে আসি আমাদের এখানে। এখানেই আশা তার মেয়ে সহ থাকে, খায়, ঘুমায়। অবসর সময়ে সেলাইয়ের কাজ করে। ওর মত আরও অনেকে একই কাজ করে। আমরা তাদের সেলাই করা কাপড় বাজারে বিক্রি করি। লাভের একটা বড় অংশ ওদের খাতায় জমা হয়।“

“তোর এখানে এমন কতজন আছে?”

“এই মুহূর্তে আছে প্রায় ২৫ জনের মত। জানিস, ওদের একেকজনের কাহিনী বড়ই করুণ। আত্মগ্লানি আর প্রতারণার ইতিহাস।

কেউ কেউ আছে ভালবাসার মানুষের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছে। এক সময় সেই ভালবাসার মানুষটি তাকে বিক্রি করে দিয়েছে নিষিদ্ধ পল্লিতে। পরিবারের অমতে বাড়ি ছেড়েছিল। তাই বাড়িতে ফিরে যাবারও সুযোগ নেই। এখান থেকে বের হবারও উপায় নেই। এই পেশাতেই তাদের দেহ আটকা পড়েছে।

এমন মেয়েদের সংখ্যাই এখানে বেশি।

কেউ আছে, যাদেরকে দালালেরা ঢাকা নিয়ে এসেছে। চাকুরি দিবে বলে। কিসের চাকুরী কিসের কি? কিছু বুঝে উঠার আগেই ওরা বিক্রি হয়ে যায়। ফেরার কোন পথ থাকে না।

আবার কিছু আছে যাদের জন্ম বেড়ে উঠা এই নিষিদ্ধ পল্লিতে। যারা জানে না, তাদের বাবা কে? সমাজও তাদেরকে ভাল চোখে দেখে না। এক সময় এটাকেই তারা নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়। মায়ের পেশাকেই বেছে নেয় জীবিকা হিসেবে”

কথা বলতে বলতে কফি এলো। আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম “তোরা আর কি কি কাজ করিস?”

“আমরা তাদেরকে স্বাস্থ্যসেবা দেই। মাতৃত্বকালিন চিকিৎসার ব্যবস্থাকরি। বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করি। তাছাড়া আমাদের আরও কিছু কার্যক্রম আছে। এই যেমন এই সব বাচ্চাদেরকে স্কুলগুলোতে ভর্তি করতে চায়না। আমরা চেষ্টা করছি, বাচ্চাগুলো যাতে মায়ের পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি হতে পারে। যাতে তাদের মায়েরা কাজের স্বীকৃতি পেতে পারে”

“কাজের স্বীকৃতি মানে?” আমি কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইলাম।

“জানি এই কথা শুনলে তুই চমকে উঠবি। তোদের মত ভদ্র মানুষদের চমকে উঠারই কথা” হেলেনের গলা কিছুটা উদ্দীপ্ত শোনাল “এরা তো বাইরের কেউ নয়। এই সমাজেরই মানুষ। এই সমাজের অতি ভদ্র লোকেরা রাতের আঁধারে এদের ব্যবহার করে। দিনের বেলায় চিপসের প্যাকেটের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই তো হয়ে আসছে। তবে তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি কোথায়? কেন ওরা আর দশজন মানুষের মত মাথা উচু করে চলতে পারবে না?”

“দেখ দোস্ত! রাগ করিস না” আমি হালকা হেসে পরিবেশটা সহজ করতে চাইলাম “তুই যে কাজগুলো করছিস, তা নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। কোন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসা পুণ্যের কাজ। তবে তোর শেষের কথার সাথে আমি একমত নই”

“কেন?” হেলেনের গলার স্বরে সুস্পষ্ট কাঠিন্য। তীব্র প্রতিবাদী ওর দু চোখ।

“প্রথম কথা হল, কাজটা সমাজের চোখে, আইনের চোখে অপরাধ। ধর্ম, নীতি নৈতকতার দিক দিয়েও তাই। অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিই অপরাধী। সমাজে যারা অপরাধ করে তাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন যুক্তি থাকে।

যে খুন করে, সেও বলে সমাজ আমাকে খুনি বানিয়েছে। যে মাদক বিক্রি করে তাদেরও অনেকেই পরিস্থিতির শিকার। এখান থেকে তাদের ফিরে যাবার উপায় নেই। তাই বলে আইনের চোখে তারা ক্ষমা পায় না। আইনের চোখে তারা অপরাধী।

এখন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বলেই কি আমরা তাদের কাজকে স্বীকৃতি দেব? স্বীকৃতির দাবী জানাব? চাইব একজন খুনি, মাদক ব্যবসায়ী সমাজে মাথা উচুঁ করে চলুক?

তাছাড়া তোদের এই sex worker টার্মটা নিয়েও আমার আপত্তি আছে। জীবিকার প্রয়োজনে আইন ও ন্যায়সংগত যে কোন কাজকে আমরা work বলি। কিন্তু এই কাজতো তেমন নয়।

তোরা কখনও কখনও sex worker বলে এই পেশাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করিস। চেষ্টা করিস অপরাধটাকে লঘু করার। এর প্রতি মানুষের যে ঘৃনা আছে তা মুছে ফেলার। এমনভাবে বলিস, যেন টাকার বিনিময়ে এরা সমাজে কোন সেবা দিয়ে যাচ্ছে...এভাবে যদি বিচার করিস, তবে চোরকে তুই কি বলবি? Theft worker? খুনিকে কি বলবি? Killing woker?”

“তুই কিসের সাথে কি মিলাচ্ছিস? চোর, ডাকাত, খুনি…এরা তো সরাসরি মানুষের ক্ষতি করে। অন্যের অধিকার কেড়ে নেয়। অন্যকে আঘাত করে। তাদের সাথে তুই এদের মিলাচ্ছিস কেন? এরা তো কারও কোন ক্ষতি করছে না”

“এটাই যদি যুক্তি হয়, তবে মাদক ব্যবসাকে তুই অন্যায় বলবি কি করে? মাদক ব্যবসায়ী একইভাবে কারো ক্ষতি করে না। যারা মাদক কিনতে চায়, টাকার বিনিময়ে তাদেরকে সার্ভিস দেয়। তাহলে এটাও নিশ্চয় অপরাধ হতে পারে না।“

“এটা তোর খোঁড়া যুক্তি। মাদক মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর এটা সবাই জানে। তাছাড়া যারা ড্রাগ এডিক্ট, তাদের একেকটা পরিবারে কি অবস্থা খবর নিয়ে দেখ। ড্রাগের জন্য এরা পরিবারের জীবনকে নরক বানিয়ে ফেলে। এর সাথে এই তুলনাটা হাস্যকর”

আমি খেয়াল করলাম, হেলেনের নাকের পাটা রীতিমত কাঁপছে। ও যখন রেগে যায়, তখন ওর নাকের পাটা ফুলে যায়।

আমি হেসে দিলাম” তুই কিন্তু রেগে যাচ্ছিস! মনে আছে, আমরা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন করতাম? বলতাম আমাদের কাছে যুক্তিটাই সব। আমি আমার কথা বলছি। নিজের মত করে যুক্তি দিচ্ছি। তুই যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করবি। কিন্তু রেগে যাচ্ছিস কেন?”

হেলেনও হেসে দিল “আচ্ছা, ঠিক আছে। রাগ করব না। কি বলছিলি বল”

আমি আবার বলা শুরু করলাম “মাদকের মত এটাও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। এর কারণে গনোরিয়া, সিফিলিস সহ নানা ধরনের ব্যাধি হয়। মরণঘাতি এইডস হবার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায়ও এর প্রতি সহমর্মীতা দেখানোর কোন কারণ নেই।

ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম। তোর কাছে তার আবেদন নাও থাকতে পারে। আয় আমরা মানবিক দিক দিয়ে বিচার করি।

এই পেশাকে স্বীকৃতি দেয়া মানে পরিবার ধ্বংস করা। এটার যদি অবাধ সুযোগ থাকে, তবে মানুষ বিয়ে করবে কেন? কেন বাচ্চা কাচ্চার দায়িত্ব নিবে? স্বল্প কিছু টাকা খরচ করে নিজের জৈবিক চাহিদা পুরন করলেই তো হয়। দায় দায়িত্ব নেয়ার ঝামেলা নেই।

আবার যে বিয়ে করেছে, সেও সুযোগ পেলে এদের কাছে আসবে। এভাবে পরিবার প্রথা হুমকির মধ্যে পড়ে। আর পরিবার ধ্বংস হওয়া মানে প্রকারান্তরে সমাজ ও মানব সভ্যতা বিপন্ন হওয়া।

আবার ভেবে দেখে, এর স্বীকৃতি দেয়া মানে এটাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে কেউ না কেউ এদের খদ্দের হবে। তারা কারা? আমা্দের বাবা ভাই স্বামী যদি এদের কাছে যায়, তবে কি আমরা তাকে ভাল চোখে দেখব? আমরা যদি ভাল চোখে না নেই, তবে কাদের বাবা ভাই স্বামীর জন্য আমরা এইসব দোকান খুলে রাখছি?

আরও একটা দিক আছে। এ পেশাকে স্বীকৃতি দেয়া মানে আরও হাজারটা নারীর এই পেশায় আসা। দালাল কিংবা দুষ্ট লোকেরা আরও বেশি পরিমাণে সক্রিয় হবে। আরও বেশি পরিমাণ নারীকে প্রতারিত করবে। এ পেশায় আসতে বাধ্য করবে। অর্থনীতির Demand and supply নীতির মত। সেটা কি আমাদের কোনভাবে কাম্য?

তাই প্রচেষ্টা হওয়া উচিৎ ভিন্ন। স্বীকৃতি নয়, এই পেশা নির্মূল হওয়া উচিৎ, নিশ্চিহ্ন হওয়া উচিৎ। কিন্তু কেন যেন, এ নিয়ে তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তোরা এই পেশার স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর। কিন্তু পেশাটা যাতে চিরতরে বন্ধ হয়, সে নিয়ে তোদের তৎপরতা কম। অন্তত আমার তাই ধারনা”

হেলেন কি একটা বলতে যাবে, অমনি ফোন বেজে উঠল। হেলেন ফোনে কতক্ষণ হু হ্যাঁ করল।

ফোন শেষে আমার দিকে তাকিয়ে সলাজ হাসল “দুঃখিত দোস্ত! আমাকে এখন উঠতে হবে। আমার সেই ডোনার ফোন দিয়েছে। ঘন্টাখানেক পরে আমাদের সাথে মিটিংয়ে বসবে। তোর সাথে কথা বলে অনেক ভাল লাগল। আবার আসিস। কথা তো পুরো শেষ হয় নি। তাছাড়া তোর হুজুরাইন হবার গল্পও তো শোনা হল না”

“কোই মুশকিল নেহি। মিলেংগে ফের জরুর। পিকচার আভি বাকি হ্যায় গুরু!”

দুজনেই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম।


পঠিত : ১৯১৬ বার

মন্তব্য: ০