Alapon

সাইয়্যেদ কুতুবঃ ফাঁসীর মঞ্চ থেকে উৎসারিত হেরার দ্যুতি

আজ ২৯ আগস্ট। সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের ৫২ তম শাহদাতবার্ষিকী। আজ থেকে বহু বছর আগে নিজের জীবন বাজী রেখে এই মহান মানুষ তার সারাজীবন উৎসর্গ করে আমাদের কাছে সাক্ষী হয়ে রয়েছেন। নীল নদের উপত্যকায় ফেরাউনের দেশে আল্লামা সাইয়েদ কুতুব শহীদ ১৯০৬ সালে মিসরের উসউত জেলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই মহান ব্যক্তির বংশীয় উপাধী হচ্ছে কুতুব। পিতার নাম হাজী ইব্রাহীম কুতুব এবং মাতার নাম ফাতিমা। পিতামাতা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। সাইয়েদ কুতুবের পরিবারের সবাই প্রায় আলেম এবং উচ্চ শিক্ষিত। পরিবারের সবাই ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতেন। সাইয়েদ কুতুবরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। সাইয়েদ কুতুব,আমিনা কুতুব,মুহাম্মদ কুতুব,হামিদা কুতুব এবং নাফীসা কুতুব। 

সাইয়েদ কুতুব সবার বড় ছিলেন। তিনি ছিলেন খুব মেধাবী। শৈশবেই পবিত্র কোরআন মজিদ হেফজ করেন। শিক্ষা জীবন শুরু করেন তাজ হিমিয়াত দারুল উলুম মাদ্রাসায়। সে মাদ্রাসায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কোরান, হাদীস, ফিকাহ, ইসলামী সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৯২১ সালে ধমীর্য় জ্ঞান চর্চার জন্যে ভর্তি হন কায়রোর বিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুমে। সে প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৩৩ সালে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। সাইয়েদ কুতুব শহীদের বিভিন্ন ভাষার পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন ১৯৩৩ সালেই। তারপর ১৯৪০ সালে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে তিনি বদলি হয়ে সাংস্কৃতিক বিভাগে স্থানান্তরিত হন। ১৯৪৮ সালের ৩রা নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিনি আমেরিকাতে গমন করেন।
 
জাহাজে ভ্রমণ করার সময় সাইয়েদ কুতুবের এক ঐতিহাসিক বিরল একটি ঘটনা:  
সাইয়েদ কুতুব শহীদ(রাহঃ) সমুদ্র পথে আমেরিকাতে যাচ্ছেন। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে জাহাজ চলছে। পানির কল কল শব্দে তিনি আল্লাহর সৃষ্টির নিয়ে ভাবছেন। নিজের মনের মধ্যে বার বার একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- আমি কি সেই আমেরিকাতে যাচ্ছি, যারা খাওয়া ও ঘুমকে যথেষ্ট মনে করে। যারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে! যাদের জীবনে বৈধ কি অবৈধ এর কোন সীমারেখা নেই। তিনি মনে মনে স্থির করলেন আমেরিকাতে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করবেন। আল্লাহর এই বান্দা জাহাজেই পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। সাইয়েদ কুতুব তার কক্ষে অবস্থান করছেন। বাহির থেকে কে যেন দরজায় নক করছে। তিনি দরজা খুলেই চমকে উঠলেন। এক সুন্দরী রূপসী যুবতী নগ্নপ্রায় দেহে তার সামনে দন্ডায়মান। সাইয়েদ কুতুবকে সুন্দরী রমনী বললেন। জনাব,আমি কি আজ রাতে আপনার রুমের মেহমান হতে পারি? সাইয়েদ কুতুব জবাব দিলেন, দুঃখিত। রুমে একটিই খাট। আর তা একজনের জন্যই নির্ধারিত। কুতুবের এই কথা শুনার পর যুবতী বলল, খাট এত প্রশস্ত যে, এতে দুজনই থাকা যায়। যুবতী ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আল্লাহর ভয়ে ভীত সাইয়েদের মন যুবতীর দিকে একটুও টলেনি। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। কু-প্রবৃত্তির উপর নৈতিকতার এর চেয়ে বড় জয় আর কি হতে পারে? চাওয়া পাওয়ার এই দুনিয়াতে নারীর প্রতি অবৈধ লোভ লালসা জন্মায় না কেবল দ্বীনদার পরহেজগার মুমিনের।

চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ:  
সাইয়েদ কুতুব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিকট খুবই প্রিয় ছিলেন। তাঁর অনুপম চারিত্রিক মাধুর্যে সবাই মুগ্ধ ছিলেন। আমেরিকাতে থাকার সময়ই সাইয়েদের মানসিক পরিবর্তন হয়। তিনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৫২ সালের ১৮ই মে ইস্তফাপত্র জমা দেয়ার সময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ইসমাইল আল কাবানী। মন্ত্রী মহোদয় পুনরায় চাকুরীতে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুরোধ জানান। এমনকি একবছর পর্যন্ত সাইয়েদ কুতুবের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করা হয়নি।

ইখওয়ানুল মুসলিমীনে যোগদান :
সাইয়েদ কুতুব(রাহঃ) ১৯১৯ সালের জাতীয় আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকুরী থেকে পদত্যাগ করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৩ সালে তিনি ইখওয়ানে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন মিশর চাই-ইখওয়ানের এ শ্লোগান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এ জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাড়াঁয় ইখওয়ানের হাজারো নেতা-কর্মীদের উপর। আর চলতে থাকে রাষ্ট্র শক্তির অত্যাচার নির্যাতনের ষ্টীম রোলার।  সেই নির্যাতনের ধারাবাহিকতায়  শহীদ হাসানুল বান্নাকে ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী শহীদ করা হয়। মিসরের তৎকালিন খোদাদ্রোহী সরকার ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হতে পারেনি। জালেম সরকার ইখওয়ানের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছিলো। এই দ্বীনি সংগঠনের সাথে জড়িত নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সায়েদ কুতুব সেই সময় আমেরিকাতে ছিলেন। তিনি শহীদ হাসানুল বান্নার শাহাদাতের খবর পত্রিকায় পড়ছেন। সায়েদ কুতুব দীর্ঘদিন থেকে সংস্কারবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য একটি যুব সংগঠন করার চিন্তা করেছিলেন। তার সেই চিন্তা ও স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন ইখওয়ানের মধ্যে তিনি দেখতে পান।

সাইয়েদ কুতুবের প্রথম কারাবরণ :
১৯৫৪ সালে ফেরাউনের উত্তরসূরী জামাল আবদুন নাসের ইংরেজদের সাথে ইঙ্গ মিসর চুক্তি সম্পাদিত করেন। ইখওয়ান ইঙ্গ মিসর চুক্তির বিরোধিতা করার কারণে জামাল আবদুন নাসের ইখওয়ানদের উপর দমন,নিপীড়ন,অত্যাচার,নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালিয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাবন্দী করে। এর মধ্যে ৬ জন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন জ্বরে আক্রান্ত। তিনি অসুস্থতায় বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। এই অবস্থায়ই তার হাতে পায়ে লোহার শিকল লাগিয়ে অন্ধকার কারাগারের দিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন পথের মধ্যেই তিনি কয়েকবার জ্ঞান হারা হয়ে পড়ে যান। সামরিক কর্মকর্তা তাকে জেলখানায় পাঠানোর সাথে সাথেই এই মহামানবের উপরে নেমে আসে বর্বরতার বিভীষিকাময় নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন। সরকারের লেলিয়ে দেয়া হিংস্র হায়েনারা তাকে অমানুষিকভাবে প্রহার করতে থাকে।

পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বেলাল খাব্বাবের ঘটনা যেমন তুলি দিয়ে মুছে দেওয়া যাবে না। তেমনিভাবে সাইয়েদ কুতুবের উপর রাষ্ট্রশক্তির লোমহর্ষক অত্যাচারের কথাও মুসলিম জনগণ ভুলে যাবে না। মিসরের ভুখন্ডে ফেরাউনের মমি করা লাশ অক্ষত অবস্থায় যে আল্লাহ রেখেছেন। তিনি আজও আছেন। কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। সুতরাং ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। সাইয়েদ কুতুবের উপর ভয়ংকর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। কুকুরটি সাইয়েদ কুতুবের পায়ে কামড় দিয়ে টেনে হেঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে। শুধু কি তাই! ফেরাউনের প্রেতাত্মারা একবার তার মাথায় গরম পানি আবার কিছুক্ষণ পরেই ঠান্ডা পানি ঢেলে দিত। তার দেহে আগুনের ছেঁকা দেওয়া হত। এত নির্যাতনের পরও তিনি ছিলেন ঈমানের বলে বলীয়াণ। অত্যাচার নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারলে বলতেন আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ। 

১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে সাইয়েদ কুতুবকে ১৫ বছর কারাদণ্ডের আদেশ শুনানো হয়। সে সময়টিতে তিনি এত বেশি অসুস্থ ছিলেন যার ফলে আদালতের আদেশটি শোনার জন্যে কাঠগড়ায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে সাইয়েদ কুতুব আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারাগারের আইন অনুযায়ী চিকিৎসার বিধান থাকলেও তাঁর চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সাইয়েদ কুতুবের এই অসুস্থতার পিছনে নির্যাতনই প্রধান কারণ ছিল। এমনও হয়েছে একাধারে ৪ দিন একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। খানাপিনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার সামনে অন্যরা পানি পান করত। কিন্তু নিষ্ঠুর জালিমেরা সাইয়েদকে এক গ্লাস পানিও পান করতে দিত না। 

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এত অমানবিক নির্যাতনের পরও কালেমার দাওয়াত,জিহাদ ও আন্দোলনের কাজ থেকে তাঁকে বিরত রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি সময় পেলেই জেলে দাওয়াতী কাজ করতেন। কারাগারেও আসার এক বছর পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে,যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন,যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে,তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। আপনি জেলের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে আরাম আয়াশে থাকতে পারবেন। 

এ প্রস্তাব শুনে সাইয়েদ জবাব দিলেন, আমার অবাক লাগে এ সকল লোকেরা মাজলুমকে বলছে জালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। আল্লাহর শপথ,যদি কয়েকটি শব্দের উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্তি দেয়া হয়-তবুও আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমন ভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট। জেলখানায় যখনই তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হত তিনি বলতেন,যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয়,তাহলে আমাকে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর সন্তুুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয় তাহলে আমি জালিমের কাছে করুণাভিক্ষা চাইতে রাজী নই।

তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন:  
ইসলামী আন্দোলনের জন্য সাইয়েদ কুতুবের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিল তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন। এ তাফসিরটি ১৯৫৪ সালে কারাগারে যাওয়ার পূর্বে তিনি লেখা শুরু করেন এবং কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে শত বাধা শত নির্যাতন সহ্য করেও লেখা বন্ধ করেননি। কিন্তু জালেমশাহী সরকার কারাগারে লেখালেখির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। কোরানের এই প্রেমিক তাতে একটু বিচলিত হয়ে পড়েন। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে কারাগারের লেখালেখির উপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আদালতে একজন প্রকাশক মামলা দায়ের করার পর আদালত লেখালেখির অনুমতি দেন। তিনি কারাগারেই থাকা অবস্থায় ফি যিলালীল কোরআন সমাপ্ত করেন।

কারাগার থেকে মুক্তি:  
১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন সাইয়েদ কুতুব। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ কায়রো সফর করেন। ইরাকের আলেম সমাজের আবেদনের প্রেক্ষিতে ইরাকী প্রেসিডেন্ট মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের এর সাথে বৈঠককালে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ইরাকের প্রেসিডেন্টের সাথে নাসেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বিধায় সাইয়েদ কুতুবকে অবশেষে মুক্তি দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রাখেন। জেলবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাইয়েদ কুতুবকে নিয়ে নতুন করে অপপ্রচার চালানো শুরু হয়। যুগে যুগে ইসলাম বিরোধী কবি,সাহিত্যিক,সাংবাদিকেরা ইসলামের বিরুদ্ধে কলম ধরছেন। এখনও ইসলামের কথা শুনলে তাদের গায়ে আগুন ধরে যায়। 

ইসলাম বিরোধী পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়-সাইয়েদ কুতুব ইসলামের কথা বলেন অথচ তাঁর জীবনে ইসলাম নেই। নরঘাতকদের কলম আরো এক ধাপ সামনে অগ্রসর হয়ে লিখল জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কায়রোর পথ দিয়ে যাবার সময় তাঁর সাথে ছিল স্ত্রী ও বড় মেয়ে। তারা উভয়েই ছিল নগ্ন প্রায়। তাদের মাথায় স্কার্ফ পর্যন্ত ছিল না। এ ধরনের ভিত্তিহীন অপপ্রচারের সম্মুখীন হন সাইয়েদ কুতুব। অথচ তিনি তখন বিয়েই করেননি। সাইয়েদ কুতুবকে নাসের সরকার ভিত্তিহীন মিথ্যা বানোয়াট নাটকের মাধ্যমে দ্বিতীয় বার আবার গ্রেফতার করে। সাজানো নাটকটি ছিল- এক গোয়েন্দা পুলিশ নিজের পকেটে ইখওয়ানের সদস্য হওয়ার ফরম রেখে জামাল আবদুল নাসেরের জনসভায় যায়। সভার কাজ শুরু হলে সে নাসেরকে লক্ষ্য করে পর পর ১২ রাউন্ড গুলী ছুঁড়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে একটি গুলীও কারো গায়ে লাগেনি এবং যে ব্যক্তি গুলী ছুঁড়েছে সেও পালিয়ে যাবার কোন চেষ্টা করেনি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নাসেরের সামনে নিয়ে গেলে জামাল নাসের পুলিশকে অর্ডার করে তার পকেট তল্লাশী করে দেখো ইখওয়ানের কোন কাগজ আছে কিনা? পুলিশ তল্লাশী করে রিমান্ডে নেওয়ার আগেই গদ গদ করে সে বলতে শুরু করল আমি ইখওয়ানের লোক। প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার জন্য ইখওয়ান আমাকে পাঠিয়েছে।

একথা শুনার পর পরই পুলিশের লোকেরা চিৎকার করে উঠল স্যার এই যে দেখুন ইখওয়ানের সদস্য ফরম তার পকেটে। কি অদ্ভুত ভন্ডামি! জামাল আবদুল নাসের তো এই অজুহাতটির খোঁজেই বিভোর ছিল। সাথে সাথে শুরু হল গণগ্রেফতারী। মিসরের প্রেসিডেন্ট ইখওয়ান কর্মীদেরও বিচারের জন্য স্পেশাল সামরিক আদালত বসালেন। এক অধ্যাদেশ জারি করে  গণগ্রেফতারীর বিরুদ্ধে আদালতে আপীল করার সুযোগ রহিত করেন। সাইয়েদ কুতুবকে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীদার আখ্যায়িত করে ইখওয়ানকে তার পদাংকনুসারী বলে প্রচারণা চালিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। সে সময় ৪০ হাজারের বেশি নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। 

সাইয়েদ কুতুব দ্বিতীয়বারে গ্রেফতার হওয়ার আগে নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে বলেছিলেন- আমি জানি জালিমরা এবার আমার মাথাই চায়। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। নিজের মৃত্যুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার তো বরং সৌভাগ্য যে,আল্লাহর রাস্তায় আমার জীবনের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। আগামীকালের ইতিহাসই এটা প্রমাণ করবে যে,ইখওয়ানুল মুসলিমীন সঠিক পথের অনুসারী ছিল নাকি এই জালিম শাসকগোষ্ঠী সঠিক পথে ছিল? 

বিচারের নামে প্রহসন: 
১৯৬৫ সালের ২১ শে ডিসেম্বর সাইয়েদ কুতুব ও তার সঙ্গীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়। ১৯৬৬ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে মিসরের আইন মন্ত্রী ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন কারাগারে। তিনজন ছিলেন পলাতক। দুইজন ছিলেন মহিলা। একজন জয়নাব আল গাজালী আরেকজন হলেন হামিদা কুতুব। বিচারের নামে প্রহসন শুরু হল। অভিযুক্তদের কোন কৌসুলী নেই। এমনকি সুদান মরক্কোসহ কয়েকটি আরব দেশের আইনজীবীরা অভিযুক্তদের পক্ষে আইনি সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন। স্বৈরশাসক নাসের সরকার আইনজীবীদেরকে কায়রো বিমান বন্দরে থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। 

লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আইনজীবী ও পর্যবেক্ষক পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু অনুমতি পায়নি। টেলিভিশনে এই বিচার অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানোর কথা থাকলেও অভিযুক্তরা অভিযোগ অস্বীকার করে কারাগারের নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে শুরু করলে সম্প্রচারের সিদ্ধান্তই বাতিল করা হয়। সাইয়েদ কুতুব কিছু বলতে চাইলেও তাকে কিছু বলতে দেয়া হয়নি। এমনি অবস্থায় ১৮ই মে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আদালতে বিচার প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। 

বিচারক রায় ঘোষণার আগে জামাল আবদুল নাসের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে ১৯৬৬ সালের ২১ শে আগষ্ট রায় ঘোষণা করেন। এই অন্যায় রায় ঘোষণা করার পর আদালতের নথিপত্র যারা লিখছেন তাঁরা চোখের পানি ফেলে কেঁদেছেন। অথচ বেলাল খাব্বাবের অনুসারী সাইয়েদ কুতুব রায় শোনার পর খুশী মনে বলে উঠলেন-আলহামদুলিল্লাহ। সেদিন তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন- আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে,আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে জালেমরা আমার মৃত্যুদণ্ড দেবে। আমি তো এতেই সন্তুষ্ট যে,আমি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা হিসাবে শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি।

সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদন্ডাদেশ শোনার পর বিশ্বনেতৃবৃন্দ হতবাক হন। বিচারের নামে অবিচার দেখে বিশ্ব মানবতা আর্তনাদ করে উঠলো। মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত করার জন্য মিসর সরকারের নিকট আবেদন জানানো হয়। সউদি আরবের তৎকালিন বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজীজ তার একজন মন্ত্রীর মাধ্যমে জামাল আবদুল নাসের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। দণ্ডাদেশ রহিত করার জন্যে। কিন্তু ফেরাউনের উত্তরসূরী নাসের মন্ত্রীর কথা শোনার পর তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বাদলা ফয়সালের মন্ত্রীকে শুনিয়ে নির্দেশ দিলেন আগামীকাল খুব সকালে সাইয়েদ কুতুবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার। 

সাইয়েদ কুতুবের প্রাণ কেড়ে নিয়ে জামাল আবদুল নাসের নিজেকে খুবই পালোয়ান মনে করতে পারতো যদি আজও জামাল নাসের বেচেঁ থাকতে পারতো? ফেরাউন,আবুজেহেল,আবু লাহাব এই নামগুলোর মতোই মিসরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের নাম ঘৃণার চোখে মানুষ মনে করে। সারা দুনিয়ার মুসলিম জনতা হৃদয় দিয়ে হযরত বেলাল,খাব্বাব, খুবায়ের,সুমরাইয়া (রাঃ) মতো সাইয়েদ কুতুব শহীদকে মনে প্রাণে ভালোবাসেন। এর চেয়ে পরম পাওয়া আর একজন মুমিন বান্দার কি হতে পারে? এই মজলুম আল্লাহর প্রিয় বান্দাহকে ১৯৬৬ সালের ২৯শে আগষ্ট ভোররাতে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফাঁসী দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন। সাইয়েদ কুতুব ফাঁসির মঞ্চের দিকে নির্ভিকচিত্তে পা বাড়াচ্ছেন আর তৃপ্তিতে হাসছেন। রাত্রির প্রহর শেষে ফজরের আযান চারদিকে ধ্বনিত হচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসীর মঞ্চে বসলেন। 

কাক ডাকা ভোরবেলা পাখীরা যখন কিচিরমিচির করছে ঠিক এই সময়ে সাইয়েদ কুতুব লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। ইসলামী আন্দোলনের এই মহান সেনাপতির ফাঁসী কার্যকর হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে মিসরের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা উল্লাস প্রকাশ করছে। কিন্তু মিসরের বিভিন্ন কারাগারের কারাবন্দীদের বুকফাঁটা কান্নার রোলে আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ কেঁদেছিল বলেই আজও তিনি হাজারো মানুষের মণিকোঠায় সিক্ত হয়ে আছেন। যতদিন এই আকাশ-বাতাস থাকবে বহমান আল্লাহর কালাম থাকবে অরক্ষিত ততদিন বিশ্বের অগণিত মানুষের প্রেরণার উৎস  হয়ে থাকবে সাইয়েদ কুতুব শহীদ। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করবেন ইনশাল্লাহ।

পঠিত : ৯০৪ বার

মন্তব্য: ০