Alapon

মধ্যপ্রাচ্যের চালকের আসনে এরদোগান, নেপথ্যের কারণ কী?

আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শাসক এরদোয়ান। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে যিনি দেশটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন উসমানীয় খেলাফতের ধর্মীয় ঐতিহ্যের দিকে। নেতৃত্ব শূন্য আরবরা যখন পশ্চিমা বন্ধুত্বের চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে তখন বারবার খালি মাঠে গোল দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছেন এরদোয়ান।

আগে কিছুটা রাখঢাক রেখে কথা বললেও ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রকাশ্যেই মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের অভিভাবকত্ব গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করছেন রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ও তার দেশ। এ বছর ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিরোধপূর্ণ শহর জেরুজালেমে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন অস্থিরতা শুরু হয়। এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা ব্যাপক বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে। যা এখনো থেমে থেমে চলছে।

বিক্ষোভ দমন করতে ইসরায়েল যেভাবে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে তা স্রেফ গণহত্যা। এ বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে আরব হতে হয় না। কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকাও জরুরি না। শুধু দরকার একটু বিবেক বোধের, আর একটুখানি সৎ সাহসের।

কিন্তু মুসলিম বিশ্বাস মতে নিজেদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম বা তৃতীয় পবিত্র স্থান বাইতুল মোকাদ্দাস রক্ষার প্রশ্নে আরব শাসকেরা তা দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক ভোগ-বিলাসীয় যে প্রাসাদ শাসন তারা গণতন্ত্রের কথিত রোল মডেল পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় গড়ে তুলেছে তা হারাবার ভয়ে এবার জেরুজালেম প্রশ্নেও কথা বলতে ভয় বা অনীহা দেখানো শুরু করেছে শেখরা।

আরব শাসকরা যখন স্ব-ভাষী ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর মুখে দেখেও চুপ তখন সে সুযোগটাই কাজে লাগাতে ব্যস্ত তুরস্ক। গত কয়েক বছরে ফিলিস্তিন সহ মুসলিম দেশগুলোর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এরদোয়ানের এমন উচ্চকণ্ঠ তাকে আরবদের একটি বিশাল অংশ, বিশেষ করে মিশরীয় ও ফিলিস্তিনি মুসলিমদের কাছে প্রবাদপ্রতীম মানুষে পরিণত করেছে। ফলে আমরা দেখি ফিলিস্তিনী এক মৃত শিশুর লাশ তুর্কি পতাকায় ঢেকে দাফন হতে।

ফিলিস্তিনি শিশুদের অনেককেই এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করতে দেখা যায়। ফিলিস্তিনের কিশোর-তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরদোগানকে নিয়ে নানা প্রশংসা করছেন। বাংলাদেশের মতো অ-আরব, নিম্ন বর্ণের মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি এরদোয়ান এখন আরব মুসলিমদের কাছেও জনপ্রিয় এক নাম। অনেকেই তাকে নতুন মুসলিম যুগের সূচনাকারী বলছেন।

বাস্তবতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে শত ক্রোশ দূরে থাকা মুসলমানরা আবারও তরবারি যুদ্ধে বিশ্ব শাসনের স্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন! অনেকের মতে, যার সূচনাকারী মি. এরদোয়ান! জেরুজালেম প্রশ্নে শুধু কূটনৈতিক প্রতিবাদেই থেমে থাকেনি তুরস্ক। সভা-সমাবেশ করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে দেশটির সংসদ। এ নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে আবার মুসলিম বিশ্বের আলোচনার মূল আকর্ষণ হয়েছেন এরদোয়ান।

যুক্তারষ্ট্র ও ইসরায়েলের হুমকি-ধামকিকে তোয়াক্কা না করে এরদোয়ান ও তার দল যেভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে তা আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু কেন জেরুজালেম প্রশ্নে তুরস্ক এমন স্পর্শকাতর অবস্থান নিয়েছে? এটা কি শুধুই ধর্মীয় কারণে? আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে ধর্মের চেয়েও তার্কিশ আভিজাত্যবোধ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় জেরুজালেমসহ পুরো আরব বিশ্বই ছিল তুরস্ক তথা উসমানীয় খেলাফতের অধীনে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্য খোয়ানো দেশটি দীর্ঘদিন বিশ্ব রাজনীতিতে নিরব ছিল। কিন্তু তারা আবার সরব হতে চায়। গত এক দশকে অর্থনীতিতে (যদিও গত ২/৩ বছর ধরে তুরস্কজুড়ে নতুন অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে) স্বাবলম্বীতা অর্জনের পর এখন রাজনীতিতেও সফলতা চাচ্ছে এরদোয়ান সরকার। এক্ষেত্রে দেশটির জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে এরদোয়ান সরকার।

জেরুজালেম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে যে খেলা শুরু হয়েছে তাকে তারা নিয়েছে আত্মমর্যাদার লড়াই হিসেবে। আর এ লড়াইয়ে মুসলিম দেশগুলোকে পাশে চায় তুরস্ক, দীর্ঘ ৬শ বছরের উসমানীয় খেলাফতের সময় যা তারা পেয়েছিল। নতুন অর্থনৈতিক শক্তি তুরস্ক চায় বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ ও নতুন দেশ। এ বেলা ফিলিস্তিন হতে পারে তুরুপের তাস। ইতোমধ্যেই আফগানিস্তান, সোমালিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে তুরস্ক ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। ফিলিস্তিনেও তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে।

তুরস্কের এমন প্রতিবাদী অবস্থানের কারণে দেশটি ফিলিস্তিনে ব্যাপক মাত্রায় ব্যবসা করার সুযোগ সুবিধা পাবে। যা তাদের একদিকে ফিলিস্তিনকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেবে। অপরদিকে অন্য আরব দেশগুলোতে প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করবে।

এরদোয়ান সরকারের এমন বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণের পেছনে আরেকটা বড় কারণ হতে পারে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক চাপ। গত কয়েক বছর ধরে ডলারের বিপরীতে তার্কিশ লিরার মানের অধঃপতন হচ্ছে অব্যাহতভাবে। এর একটি প্রভাব তুর্কিদের জনজীবনে পড়ছে। এরদোয়ানকে নিয়ে নানা কারণে বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনা দেশটির অধিকাংশ মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের কষ্টের কথা ভুলিয়ে দেয়।

কারণ যাইহোক, জেরুজালেম প্রশ্নে এরদোয়ান ও তার দেশ যে বলিষ্ঠ মানবিক অবস্থান নিয়েছে। এজন্য আমরা আপাতত তাকে সাধুবাদ জানাই। তুরস্কে বসবাস করা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোও এমন মানবিক আচরণ পাবে বলে আশা প্রকাশ করি। এই সংকটের একটি ম্যাজিকাল ও যৌক্তিক সমাধান কামনা করি।

লেখক: সরোজ মেহদী,
তুর্কি স্কলারশিপ ফেলো।
শিক্ষক, ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

পঠিত : ১৩৮৭ বার

মন্তব্য: ০