Alapon

আনা উহিব্বুকি ফিল্লাহ

এক “Love at first sight” বলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে। সোজা বাংলায় প্রথম দেখায় কিছু চিন্তা না করেই প্রেমে পড়া। ছেলেটার ঠিক তা-ই হলো। সে প্রথম দেখায় ক্রাশ খেলো। অবশ্য ক্রাশ খাবার কারণ কিন্তু যথেষ্ট। কোমর পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুলের অধিকারী মেয়েটা যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তখন তার উপর থেকে চোখ ফেরানো বেশ কষ্টসাধ্য। ছেলেটা হঠাৎ আবিষ্কার করে এই একজন সামনে আসলেই সে প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে যায়, হার্ট খুব দ্রুত বিট করা শুরু করে, এমনকি নার্ভাসনেসের কারণে তার হাঁটুও কাঁপতে থাকে।

ছেলেটা তাই বুঝতে পারলো এই মেয়েকে ছাড়া তার পক্ষে বাঁচতে পারা সম্ভব না। যে করে হোক তার তাকে পেতেই হবে। অনেক কষ্টে সে মেয়েটার ফোন নাম্বার জোগাড় করে। চেষ্টা করে মেয়েটার হৃদয়ে একটু হলেও জায়গা করে নিতে। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই রাজি হয় না। কিছু সময় চলে যায়- এক মাস, দুই মাস, তিন মাস। মানবচরিত্রের আজন্ম প্রকৃতি একসময় তাদেরকে একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করে। জীবন সম্পর্কে প্রচণ্ড উদাসীন ছেলেটা হঠাৎই জীবনে নতুন এক প্রেরণা খুঁজে পায়। অসম্ভব শান্তি লাগে তার অপরপাশে মিষ্টি একটা গলা শুনতে পেরে। সারা রাত কথা বলার পরেও তার মনে হয় রাতটা এত দ্রুত শেষ হয়ে গেলো কেন?

আবারো কিছু সময় খুব দ্রুতই কেটে যায়। ১-২-৩ বছর। এরপর ছেলেটা হঠাৎ করে আবিষ্কার করে আকর্ষণে কেন যেন ভাটা পড়ে গেছে। আগের মতো আর তার মেয়েটাকে দেখলে হার্ট দ্রুত বিট করে না, হৃদয়ের সেই প্রশান্তিও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মেয়েটাও বুঝতে পারে সবকিছু আগের মতো নেই। মনোমালিন্য শুরু হয়, একসময় সবকিছু শেষ হয়ে যায়। খুব বিষণ্ণ কিছু দিন কাটে। তারপর? তারপর আবার ছেলেটার চোখে নতুন কাউকে ভালো লাগতে শুরু করে। তারপর আবার …।

দুই আমাদের চারপাশে হওয়া প্রায় ৯০ ভাগ বিয়ে-পূর্ববর্তী রিলেশনের একটা কমন গল্প বলার চেষ্টা করলাম এতক্ষণ। বেশিরভাগ সময়েই সম্পর্কগুলো বিয়ে পর্যন্ত পূর্ণতা পায় না। আর বিয়ে পর্যন্ত গড়ালেও আবেগের সাথে সাথে যখন সীমাহীন দায়িত্ব এসে ভর করে, তখন আবেগগুলো ফিকে হওয়া শুরু করে। ‘একে অপরকে পুরোপুরি বুঝতে পারে’ এমন দাবি করা প্রেমিকযুগল বিয়ের পর আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ নতুন আরেকজনকে। এ কারণেই হয়তো ‘love marriage’ গুলোতে ‘rate of divorce’ অস্বাভাবিক রকমের বেশি। কারণ, এ বিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়নি। তাই এতে আল্লাহর কোনো রহমত থাকে না। প্রথম প্রেম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত পাশে থাকার যে ফ্যান্টাসি সমকালীন সাহিত্যে দেখানো হয়, তা কেবল উপন্যাস কিংবা রূপালী পর্দাতেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। ‘কাছে আসার গল্প’গুলোতে দূরে সরে যাবার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। তাই আজ আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কাছে আসার গল্প বলবো।

আমাদের গল্পের নায়ক মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাঃ)। ধীর-স্থির যুবক। চাচার ঘরে মানুষ হয়েছেন। সমাজের কলুষতা থেকে দূরে নির্জনে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। প্রচণ্ড সৎ ও সত্যবাদী হবার কারণে সবাই তাঁকে আল-আমিন নামে ডাকে। সম্ভবত এ কারণেই তিনি সে সময়ের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার (রাঃ) চোখে পড়েন। তিনি মুহাম্মাদকে (সাঃ) তাঁর হয়ে ব্যবসা করার জন্য প্রস্তাব পাঠান-

“একজন সৎ ও সত্যবাদী মানুষের বড় প্রয়োজন আমার। আপনার আল-আমিন খ্যাতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে আপনার প্রতি। যদি এ বিশ্বাসের মর্যাদা আপনি রক্ষা করেন এবং আমার ব্যবসা-বাণিজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে সন্তুষ্টচিত্তে আমি দ্বিগুণ লভ্যাংশ দিতে রাজি। এ প্রস্তাব মনঃপুত হলে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই।”[১]

মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তিনি খাদিজার (রাঃ) দাস মাইসারাহ ও পণ্যসামগ্রী নিয়ে সিরিয়ার পথে রওনা দিলেন।সিরিয়ায় পৌছে তিনি গির্জার কাছে এক গাছের নিচে বিশ্রাম নিলেন। তখন গির্জা থেকে এক পাদ্রী বের হয়ে মাইসারাহকে জিজ্ঞেস করলো, “গাছটির নিচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছে উনি কে?” মাইসারাহ বললেন, “তিনি হারামের অধিবাসী।” পাদ্রী বললো, “এই গাছে নবী ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি।”[২]

পাদ্রীর এই কথাটি সিরিয়া থেকে ফিরে মাইসারাহ খাদিজা (রাঃ)-কে অবহিত করেন। ঘটনাটি খাদিজার (রাঃ) মনে দাগ কাটে। তিনি তাঁর চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফলকে, যিনি ছিলেন সে সময় তাওরাত ও ইঞ্জিলের একজন বিজ্ঞ পণ্ডিত, পাদ্রীর কথাটি জানান। সব শুনে ওরাকা বললেন,

“যদি এ ঘটনাগুলো সত্য হয় তবে অবশ্যই মুহাম্মাদ এ উম্মতের নবী। আর আমি ভালোভাবেই জানি আমরা যার অপেক্ষা করছি, তার সময় খুব কাছেই।”[৩]

ওরাকার এ কথা খাদিজা (রাঃ)-কে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। এদিকে ব্যবসাতেও মুহাম্মাদ (সাঃ) রেকর্ড পরিমাণ লাভ করে আসেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সততা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি মুহম্মদ (সাঃ)-কে বিয়ে করতে আগ্রহবোধ করেন। বাংলাদেশের কিছু বিজ্ঞানমনষ্ক(!) লেখকরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে রাসূল (সাঃ) সম্পদের লোভে খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেছিলেন। অজ্ঞ (নাকি মিথ্যুক?) লোকগুলো এ কথা কখনোই বলবে না যে ব্যবসা এবং বিয়ের প্রস্তাব কিন্তু খাদিজা (রাঃ) স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-কে দিয়েছিলেন। চাচা আবু তালিবের সাথে পরামর্শ করে মুহাম্মাদ (সাঃ) বিয়েতে রাজি হন। তখন তাঁর বয়স ছিলো ২৫ আর খাদিজা (রাঃ) এর বয়স ছিলো চল্লিশ। তাঁদের বিয়েতে আবু তালিব খুতবা পাঠ করেন।[৪]

বিয়ের পরে কি খাদিজা (রাঃ) এর মোহ কাটতে শুরু করেছিল? না, ঘটনাটি আমাদের বর্তমান সময়ের মতো এগোয়নি। বরং তাঁর মুগ্ধতা বহুগুণে বেড়েছিলো। মুহাম্মাদ (সাঃ), খাদিজার (রাঃ) সম্পদের কোনো অপব্যবহার না করে আগের মতোই সাদা-সিধে জীবনযাপন করতে থাকেন। বিয়ের পর মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে খাদিজা (রাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি নবুওয়্যাতের ঘটনা থেকে। মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন প্রথম ওয়াহীপ্রাপ্ত হন এবং জীবনের আশংকা করে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে প্রবেশ করেন, তখন খাদিজা (রাঃ) তাঁকে বস্ত্রাবৃত করে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন,

“অসম্ভব! আপনাকে কখনো আল্লাহ তা’আলা অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করেন। বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করেন। মেহমানদারী ও সত্যের পথে বিপদাপদে সহায়তা করেন।”[৫]

রাসূল (সাঃ) আর খাদিজা (রাঃ) এতটাই পরিপূরক ছিলেন যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি দ্বিতীয় কোন বিয়ে করেননি। ইবরাহীম (রাঃ) ব্যতীত রাসূলের (সাঃ) সকল সন্তান-সন্ততি খাদিজার (রাঃ) গর্ভেই হয়েছিলো। খাদিজার (রাঃ) মৃত্যু রাসূলকে (সাঃ) এতটাই ব্যথিত করে যে, তিনি যে বছর মারা যান সে বছরকে সীরাতকাররা “দুঃখ ও বিষণ্ণতার বছর” নামে অভিহিত করেছেন।[৬]

রাসূলের (সাঃ) ভালোবাসাও আমাদের ভালোবাসার মতো ঠুনকো ছিল না। তাই মৃত্যুর পরেই তা শেষ হয়ে যায়নি। পরবর্তীতে দ্বীনের স্বার্থে ও ওয়াহীর ইশারায় তিনি বেশ কয়েকটি বিয়েতে আবদ্ধ হন, কিন্তু খাদিজা (রাঃ) সবসময়ই তাঁর স্মৃতিতে অমলিন ছিলেন।

খাদিজার (রাঃ) মৃত্যুর পর একবার তাঁর বোন হালাহ (রাঃ) রাসূলের (সাঃ) সাথে দেখা করতে আসেন এবং ভেতরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অনেকটা খাদিজার (রাঃ) মতোই। সে স্বর শুনতে পেরেই রাসূলের (সাঃ) খাদিজার (রাঃ) কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি বললেন, “হালাহ হবে হয়তো।” আয়েশা (রাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ কথা শুনে তাঁর মনে ঈর্ষার উদয় হলো। তিনি বললেন, “আপনি এখনো সে বৃদ্ধার কথা মনে করেন, তার এমনি প্রশংসা করেন, আল্লাহ যে আপনাকে তার চেয়ে উত্তম বদলা দিয়েছেন।” এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) খুব রাগ করে বললেন, “আল্লাহর শপথ ! আল্লাহ তা’আলা আমাকে তার চেয়ে উত্তম বদলা দেননি। মানুষ যখন আমার উপর ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিলো, তখন সে আমার উপর ঈমান এনেছিলো। যখন সবাই আমাকে মিথ্যুক বলেছে, তখন সে আমাকে সত্যবাদী বলেছে।” [৭]

নবী (সাঃ) যখনই কোন ছাগল জবাই করতেন, তখন খাদিজার (রাঃ) ভালোবাসার স্মরণে সে ছাগলের গোশত খাদিজার (রাঃ) বান্ধবীদের উপহারস্বরূপ পাঠিয়ে দিতেন।[৮]

বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে ছিলেন রাসূলের (সাঃ) জামাতা আবুল আস। তিনি রাসূল (সাঃ) এর কন্যা যায়নাবের স্বামী ছিলেন।মুসলিমগণ যখন বন্দীদের মুক্তির জন্য পণ পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, তখন যায়নাব নিজ গলার হার স্বামীর মুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন। এ হার খাদিজা (রাঃ) যয়নাবের বিয়ের সময় নিজের গলা থেকে খুলে দিয়েছিলেন। রাসূল(সাঃ) এ হার দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তাঁর চোখ পানিতে ভিজে গেলো। তিনি সাহাবীদের বললেন, “তোমরা যদি রাজি থাকো, তাহলে এই হার ফিরিয়ে দাও এবং বন্দীকে পণ ব্যতীতই বন্দীকে মুক্ত করে দাও।”[৯]

আমাদের বর্তমান সময়ে বিয়ের একটা প্রধান কারণ থাকে সাময়িক মোহ ও উদাম যৌনতা। ৪০ বছরের একজন প্রৌঢ়ার সাথে ২৫ বছরের এক যুবকের বিয়েতে এসবের কিছুই ছিলো না। ছিলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং পারস্পরিক চিরস্থায়ী মুগ্ধতা।তাহিরা[১০] ও আল-আমিনের ভালোবাসা তাই একজনের মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায়নি।

তিন আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ভালোবাসা ‘আনা উহিব্বুকি’(I love you) তেই শেষ হয়ে যায়, সেখানে ‘ফিল্লাহি’ (for Allah) কথাটি থাকে না। মহান আল্লাহ তা’আলা এসব চোখ-ধাঁধানো কিন্তু অন্তঃসারশুন্য প্রেম-ভালোবাসা থেকে আমাদের দূরে রাখুক। কিশোর বয়সে আমি মনে করতাম হুজুরদের জীবন ভালোবাসাশুন্য, প্রেমহীন। কিন্তু এখন আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ও পবিত্রতম ‘লাভ স্টোরি’ হুজুররাই লিখে গিয়েছে। আমরা বর্তমান প্রজন্ম স্বল্প আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে অধিক আলোতে অন্ধ হয়ে যাই। এ কারণেই হয়তো রোমিও-জুলিয়েট নিয়ে হাহাকার করা প্রজন্ম খাদিজা (রাঃ)-মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে কিছুই জানে না।

মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের সেই পবিত্র ভালোবাসার সাথে যুক্ত করুন, যে ভালোবাসাতে সততার মুগ্ধতা থাকবে, থাকবে বিপদে আশার বাণী, যে ভালোবাসার কণ্ঠস্বর মৃত্যুর পরেও আবেগতাড়িত করে।

যে ভালোবাসার কারণেই স্ত্রী গভীর রাতে একসাথে তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য স্বামীর মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়, অসম্ভব সুন্দর একটা তারাভরা রাতে গভীর মমতায় আর্দ্র এক কণ্ঠ বলে উঠে- “আনা উহিব্বুকি ফিল্লাহ।“

গ্রন্থসূত্র ও তথ্যাবলী

[১] তোমাকে ভালবাসি হে নবী-গুরুদত্ত সিং, পৃ-৩১

[২] সীরাত ইবনে হিশাম[বাংলা], পৃ-৪৭

[৩] উযনুল আসার, খন্ড ১, পৃ-৫

[৪] সীরাতে মোস্তফা (বাংলা)-মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী, পৃ-১০৩

[৫] সীরাতুল হাবীব-সাইফুদ্দিন বেলাল

[৬] আর রাহীকুল মাখতুম (বাংলা), পৃ-১৩০

[৭] সাহাবী চরিত-মাওলানা যাকারিয়া(রহঃ)

[৮]মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-আব্দুল হামিদ মাদানি

[৯] সীরাতে মোস্তফা (বাংলা)-মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী, পৃ-৩৬৮

[১০] তাহিরা অর্থ পবিত্র। এটি খাদিজার (রাঃ) উপনাম ছিলো

পঠিত : ৬৮৬ বার

মন্তব্য: ০