Alapon

খন্দকের যুদ্ধঃ মুখোমুখি মুসলিম ও কুরাইশ সম্মিলিত বাহিনী

দশ হাজার সৈন্যের কুরাইশ-ইহুদি-বেদুইন কনফেডারেশন যথাযথ প্রতিশোধের বাসনা নিয়ে সমভিব্যাহারে মদিনা দখলের জন্য পাড়ি জমাচ্ছে, উদ্দেশ্য তাদের দুইদিনের মধ্যে মদিনার নিয়ন্ত্রণ নেয়া। ক্যালেন্ডারে তখন ৬২৭ সালের মার্চ মাস। ওহুদের যুদ্ধের ক্ষত এখনো শুকোয়নি কুরাইশদের৷ যুদ্ধে জয়ী হয়েও বোধহয় এমন পরাজিত কেউ কখনো হয়নি। তাইতো জোটের নেতা আবু সুফিয়ান একটু বেশিই উৎসাহী।

ঘন ঘন যোদ্ধাদের প্রেরণাদায়ক বক্তব্য আর জ্বালাময়ী উস্কানি দিয়ে উজ্জীবিত করছে মদিনা জয়ের সম্ভাব্য নায়কদের৷ এবার মদিনাবাসীদের কচুকাটা করেই ক্ষান্ত হবে সে। দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে যখন অমুসলিম যৌথবাহিনী মদিনার উপকন্ঠে পৌছাল তখন দেখা দিল এক মহাবিপত্তি। আবু সুফিয়ানের কপাল ঘামতে লাগল৷ ঘটনা কী?  তার কারণ জানতে হলে আমার সাথে প্রবেশ করতে হবে ইসলামের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী আহযাবের যুদ্ধে।

এই স্থানেই খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়;
এই স্থানেই খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়; Source: Wikimedia

আহযাবের যুদ্ধ শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধও বটে। পরিখা খনন করে কুরাইশদের প্রতিরোধ করা হয়েছিল বলে এ যুদ্ধ খন্দকের যুদ্ধও নামে পরিচিত। শত্রুগণ যৌথবাহিনি গঠন করে আক্রমণ পরিচালনা করেছে বলে পবিত্র কোরানে  এ যুদ্ধকে আহযাবের যুদ্ধ নামে স্বীকার করা হয়েছে৷ শত্রুরা কয়েকদিন জন্য মদিনা অবরোধ করে রাখার কারনে এ যুদ্ধ মদিনা অবরোধ বা Siege of medina নামেও পরিচিত।

কেন সংঘটিত হয়েছিল আহযাবের যুদ্ধ? 

আহযাবের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল৷ এরই মধ্যে ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশরা জয়লাভ করলেও কার্যত তাদের তেমন কোন লাভ বা মুসলিমদের তেমন ক্ষতিও হয়নি। তারা না হত্যা করতে পারল মহানবীকে (সাঃ), না দখল করতে পারল মদিনা। মদিনার সাথে মক্কার সংযোগ সাধন করে হাসিল করতে পারেনি বাণিজ্যেরও সুবিধা। উল্টো দেখা গেল মদিনায় মুসলমানদের প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে, ইহুদিদের মদিনা থেকে বিতাড়ন করে মদিনাবাসী নিজেদের হাত শক্তিশালী করতে লাগল। মদিনার এ উত্থানে গোদের উপর বিষফোঁড়া দেখা দিল মক্কাবাসীর।

নিজেদের সামাজিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক সুবিধা অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া কুরাইশগণ নতুন আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগল। এদিকে মদিনায় বসবাসরত বেদুইন সম্প্রদায় মুসলমানদের উপর কিঞ্চিত বিরক্ত ছিল৷ মহানবী (স.) তাদের লুটতরাজের কারণে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিতে থাকেন। যার ফলে মুসলমানদের প্রতি বেদুইনদের ক্ষোভ কুরাইশগণ কাজে লাগিয়ে তাদের দলে সফলভাবে ভেড়াতে সক্ষম হয়। বেদুইনরাও প্রতিশোধ গ্রহণের এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। ওহুদের যুদ্ধের পর বনু কায়নুকা এবং বনু নাযির গোত্রের ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে মহানবী (স) তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।

যুদ্ধপরিকল্পনা
যুদ্ধপরিকল্পনা ; Source: Wikimedia

বহিস্কৃত ইহুদিরা পরবর্তীতে খাইবারের ওয়াদিয়ুল কুরা এবং সিরিয়ার বাণিজ্যপথে নিজেদের বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানকার আদি ইহুদি অধিবাসীদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে। তাদের ধারাবাহিক প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে দুমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা মুসলিম বাণিজ্য কাফেলাকে নানা ছুতোয় হয়রানি করতে থাকে। ইহুদি গোত্রগুলো মদিনা আক্রমণে এতটাই উন্মুখ ছিল যে,  বনু নাযির গোত্র তাদের এক বছরে উৎপাদিত সব খেজুর গাতফান গোত্রকে দিতে রাজি হয়ে গেল৷ বনু গাতফানের সাথে বনু আসাদও একজোট হল। ওদিকে খাইবারের বনু নাযির মদিনা আক্রমণ করতে কুরাইশদের তাগাদা দিতে থাকল। যদিও পরবর্তীতে তারা কেউই মদিনা আক্রমণে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করেনি।

মুখোমুখি মুসলিম ও কুরাইশ কনফেডারেশন

আরবের তিন মুসলিম বিরোধী পক্ষকে সাথে নিয়ে জোটের নেতা আবু সুফিয়ান গঠন করে যৌথবাহিনি। ওহুদের যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত আবু সুফিয়ান এবার তার দশহাজার সামরিক সদস্যের উপর রোমাঞ্চিত। এ যুদ্ধে কুরাইশ, ইহুদিরা মুক্তহাতে বিলিয়ে দেয় টাকাপয়সা, যেন কোনভাবেই নিজেদের হারতে দেয়া যাবেনা। ৬২৭ সালের মার্চের শেষের দিকে অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মদিনা অবরোধে যাত্রা শুরু করে যৌথবাহিনি।

এদিকে কুরাইশদের আগমনের সংবাদ পেয়ে মহানবী এক জরুরী বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে করণীয় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে নগরের ভেতর থেকেই আক্রমণ প্রতিরোধ করা হবে। ওহুদের যুদ্ধে বাইরে যুদ্ধ করতে গিয়ে এর ফলাফল কি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করে সবাই এই সিদ্ধান্তেই অটল থাকে। যুদ্ধের জন্য মুসলিমরা ছাড়াও মদিনা সনদে স্বাক্ষর করা অপরাপর গোত্রও সৈন্য দিতে রাজি হয়৷ সৈন্য সংগ্রহ শেষে দেখা গেল সাকুল্যে ৩ হাজার সৈন্য যোগাড় করা গেছে। ৩ হাজার সৈন্য দিয়ে কিভাবে কুরাইশদের ১০ হাজারের মোকাবেলা করবেন এ নিয়ে অনেকে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এমন সময় এক অসাধারন যুদ্ধপরিকল্পনা নিয়ে হাজির হলেন সাহাবি সালমান ফারসী। তিনি মহানবী (স) কে বুঝালেন, অরক্ষিত স্থানে যদি পরিখা খনন করা যায় তবে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এই পরিকল্পনা সবার মনপুত হল। দক্ষিণ দিকে ঘন খেজুরবাগান থাকার কারণে এ জায়গা যোদ্ধাদের যাতায়াতের জন্য সুবিধাজনক মনে হল। আর পূর্বদিকে ছিল বনু কুরাইযা ও বাদবাকি ইহুদিদের বসতি। ফলে এদিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল না,  যেহেতু যৌথবাহিনিতে ইহুদিদের উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু নগরীর উত্তর ও পশ্চিম দিক ছিল একেবারে অরক্ষিত। তাই এই দুদিকেই পরিখা খনন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। যথারীতি পরিখা খনন শেষ হয়ে গেলে দেখা গেল উত্তর-পশ্চিমে শক্ত নিরাপত্তা বলয় গড়ে উঠেছে।

আহযাবের যুদ্ধ
আহযাবের যুদ্ধ
Source: mustafa20 – DeviantArt

এছাড়া কোন যোদ্ধার পক্ষে পরিখা অতিক্রম করার কোন সুযোগ থাকল না, একান্তই যদি করতে হয় তবে তার উচিত ভেতরে নামা। আর ভেতরে নামলে সে যে ফাঁদে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। ওদিকে যুদ্ধবাজনা বাজিয়ে আবু সুফিয়ানের বাহিনী যখন মদিনার প্রান্তে এসে পৌছল তখন কোন মুসলিমের নাম নিশানা না দেখে সে বিপুল উদ্যমে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগল। সে ভাবল মদিনা অভিযানের খবর পেয়ে হয়তো মুসলিমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কুরাইশরা যখন আরো অল্প অগ্রসর হল তখন পুরো যৌথবাহিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। যুগার্ধ্ব এ যুদ্ধপরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব কুরাইশরা পরিখার পাশেই তাদের তাবু স্থাপন করে।

এদিকে যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বেই ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ অবহিত হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) আউস ও খাযরাজ গোত্রের দুই নেতাকে বনু কুরাইযার সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠালেন। কিন্তু বনু কুরাইযা কুরাইশদের সাহায্য করার নীতিতে অবিচল থাকল। এর প্রতি আক্রমণ হিসেবে মুহাম্মাদ (স)৫০০ মুসলিমকে ইহুদিদের ঘেরাও করার জন্য প্রেরণ করলেন। তাদের কড়া পাহারার কারণে একজন ইহুদিও ঘর থেকে বের হতে পারল না।

অবশেষে যুদ্ধ শুরু হল ৩১ মার্চ, ৬২৭ এ। পরিখা পার হয়য়ার কোন উপায় না পেয়ে এবং পরিখা প্রাচীরের দ্বারে মুসলিম তীরন্দাজদের উপস্থিতি দেখে কুরাইশরা শুরুতেই আশা হারাতে লাগল। প্রথমদিকে তারা দূর থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে পাথর নিক্ষেপ করে দেখল কাজ হয় কিনা। কিন্তু  তাতেও সফল না হয়ে তারা সম্মিলিতভাবে পরিখা প্রাচীর আক্রমন শুরু করল। অনেক চেষ্টার পর একটি প্রাচীরের দুর্বল জায়গায় আঘাত হেনে মুসলিমদের উপর আঘাতের পথ তারা তৈরি করতে পারল। আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা সে স্থানের অবরোধ ভেঙে আক্রমণের একটি রাস্তা তৈরি করে ফেলল। এই পথেই কুরাইশদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আমর মুসলিমদের যে কাউকে মল্লযুদ্ধে আমন্ত্রণ জানাল।

আলী (রা) তার এ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আমরকে হত্যা করে আসেন। একইভাবে নওফেল নামের আরেক কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয়। কার্যত এখানেই যৌথবাহিনির সব আশা আকাংখা ভস্মীভূত হয়ে যায়। এর পরের টানা দুইদিন পরিখা আক্রমণ করেও তার প্রাচীর ভেদ করতে পারল না কুরাইশ কনফেডারেশন। একে একে  কুরাইশদের আশার পিদিম সবদিক থেকে নিভতে শুরু করল। বনু কুরাইযা গোত্র জানিয়ে দিল সেদিন তারা যুদ্ধ করবে না৷ তাদের ধর্মে এদিন যুদ্ধ করা নিষেধ আছে। এদিকে নতুন উপদ্রব হিসেবে মরুঝড় দেখা দিলে আবু সুফিয়ানের বাহিনীর রসদ ফুরাতে লাগল। অবশেষে হতাশাগ্রস্থ কুরাইশ বাহিনী দিশেহারা হয়ে মদিনা থেকে ইস্তফা নিল।

যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা

ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে কোনপক্ষই নিজেদের জয়ী দাবি করতে পারেনি। তবে ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে যৌথবাহিনির পর্যুদস্ত হওয়া মুসলিম বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করে। এ যুদ্ধে ৬ জন মুসলিম সৈন্য নিহত হন। বিপরীতে যৌথবাহিনির ৩ জন সৈনিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক যুদ্ধ সরঞ্জাম ক্ষতির মুখে পড়ে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় ঘটলে হয়তো ইসলামের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হত।

পঠিত : ১৭৬৮ বার

মন্তব্য: ০