Alapon

ভারত পানি দেয় শুধু মানুষ মারার জন্য

তিস্তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা কিংবা সমালোচনা কম হয়নি।  আন্দোলনও হয়েছে।  অবশ্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন আন্দোলন হয়নি।  ফারাক্কার বিরুদ্ধে যেভাবে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, গজলডোবার বিরুদ্ধে সে অনুপাতে কিছুিই হয়নি। ফলে ভারতে তেমন কোন প্রভাবও পড়েনি।  উজানে বাঁধ নির্মাণ করার ব্যাপারটি বেআইনি হলেও ভারত এ কাজ দক্ষতার সাথে করে এসেছে গত কয়েক যুগ ধরে।  এতে পরিবেশের বিপর্যয় স্পষ্ট।  

বাংলাদেশে মোট নদ-নদীর সংখ্যা দুই শতাধিক, এর মধ্যে ৫৪টি নদী ভারতের মধ্য দিয়ে এবং ৩টি নদী মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ নদ-নদীর উজানে বাঁধ বা গ্রোয়েন নির্মাণ করে প্রাকৃতিক পানি-প্রবাহ থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশে কৃষি, বাণিজ্য, নৌ-যোগাযোগ, বন ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র এঁটেছে ভারত।

ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে এককালের প্রমত্তা পদ্মার এখন শীর্ণকায় জরাজীর্ণ দশা। যে পদ্মা দিয়ে এক সময় পাটনা পর্যন্ত বড় বড় জাহাজ, স্টিমার চলাচল করত, সে পদ্মা দিয়ে এখন লঞ্চ চলাচল করাও কঠিন।  শুকনো মৌসুমে ভারত উজানের পানি প্রত্যাহার করে নিতে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ করেছে। এদের মধ্যে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় নির্মিত গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতি নদীর ওপর মহারানী বাঁধ, মুহুরী নদীর ওপর কলসী বাঁধ, উমিয়াম ও ধালা নদীর ওপর মাওপু ড্যাম এবং সারী ও গোয়াইন নদীর ওপর নির্মিত মাইন্ডু ড্যাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অর্থাৎ শত শত বাঁধ নির্মাণ করে কথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার সব আয়োজনই সম্পন্ন করেছে।  সম্ভবত সারা বিশ্বের মধ্যে যৌথনদীর উজানে পানি প্রত্যাহার ও বাঁধ নির্মাণের সবচেয়ে বড় বঞ্চনার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।  গঙ্গা ও তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপর বড় ধরনের আগ্রাসন সৃষ্টি করেছে।  আর ভারতের পরিকল্পিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গঙ্গা-বহ্মপুত্র অববাহিকায় এসব নদীবাহিত পলি দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ যে মূলত মানবসৃষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক ভাগাড়ে পরিণত হবে তা বুঝতে মহাবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিস্তার ওপরে একটি বাঁধ (ছবি: GETTY IMAGES)

এবার চলুন দেখে নেয়া যাক, ভারত কি শুধুই উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেয়? বাংলাদেশকে মোটেই পানি দেয় না? না, এ অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা।  নির্জলা মিথ্যা কথা।। ভারত বাংলাদেশকে অবশ্যই পানি দেয়।  তবে তা মানুষ মারার জন্য।  প্রতিবছর বর্ষার মওসুমে ভারত কখনও ফারাক্কা কখনও গজলডোবার দরজা খুলে দেয়।  গতবছরের ন্যায় এবছরও গজলডোবা বাঁধের দরজা খুলে দিয়েছে। 

তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেয়ার কারণে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এরই মধ্যে রংপুরের তিনটি ইউনিয়নের পনেরটি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।।তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গঙ্গাচড়া পয়েন্টে বিপদসীমার তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।  গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, কচুয়া, চড় ইছলি, জয়রাম ওঝা, কোলকোন্দ ইউনিয়নের কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারীসহ বিভিন্ন এলাকার বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করায় অনেক পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।  কাউনিয়া পয়েন্টে যেকোনও সময় বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে।  অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন।  এদিকে আতঙ্কে বাড়ি-ঘর ছেড়ে গবাদি পশু নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।

ভারতের এ বন্ধুত্ব নতুন কিছু নয়।  গতবছরও একইভাবে পরম মমতায় গজলডোবার সবগুলো দরজা খুলে দিয়ে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিয়েছিল ভারত।  আর এ কারণে শুধুমাত্র নীলফামারী সদর ও ডিমলা উপজেলার ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল।  সারাদেশে বন্যার্ত মানুষের হাহাকার ছিল লক্ষ্যণীয়।  হতাহতের সংখ্যাও কম ছিলনা।  পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব, গবাদি পশু ও আবাদকৃত ফসলের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তো ছিলই।  আর এসবই ভারত করছে বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে।  বাংলাদেশকে গলাটিপে হত্যা করার মতো ধ্বংসাত্মক এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারত ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছে, আর বাংলাদেশের সরকার, সব রাজনৈতিক দল, জনসমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব দশর্কের ভূমিকা পালন করছে।
  
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদীর পানি সমস্যাকে ভারত তার নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই দেখিয়ে আসছে।  তবে এসব নদী যে আন্তর্জাতিক নদী তা আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকেও ইতিমধ্যে স্বীকার করা হয়েছে।  বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন এবং যৌথ নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও বঞ্চনার ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।  এখান থেকে মুক্তির উপায় এখনও না খুঁজলে কবে খুঁজবো আমরা?

পঠিত : ৮৯২ বার

মন্তব্য: ০