Alapon

বিনোদনের সাথে ইসলামের সম্পর্ক কতখানি?

ইসলাম একটি প্রাণবন্ত জীবন বিধান। অন্য ধর্মের ওপর ইসলামের শ্রেষ্টত্বের অন্যতম প্রমাণ হলো, এ ধর্ম সকল প্রকার কল্যাণকে স্বীকৃতি দেয় এবং মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির বিকাশে প্রতিবনাধক নয়। আবেগ-অনুভূতি মানুষের জীবনের একটি অনিবার্য অধ্যায়। ইসলাম এটির স্বাভাবিক ও বৈধ বহিঃপ্রকাশকে কখনো বাধা প্রদান করে না। হাসি-কান্না, আনন্দ-আহলাদ প্রাণীজগতের অনিবার্য অংশ হলেও বিনোদন মানব জীবনেরই একটি ঘনিষ্ট অনুসঙ্গ। বিনোদন বিষয়ে ইসলাম কী বলে? এমন প্রশ্নের ঘুরপাক প্রতিটি মুসলিমমানসে। বক্ষমান প্রবন্ধ সে বিষয়েরই কিঞ্চিত আলোকপাত।

আল কুরআনে ইউসূফ (আ.)-এর ভ্রাতাদের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا يَّرْتَعْ وَيَلْعَبْ وَاِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ۰۰۱۲

‘আগামীকাল তাকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিন। সে তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলবে। আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করবো।’

ইমাম আবু বকর আল-জাসসাস (রহ.) আহকামুল কুরআন গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেন, ‘ইয়াকুব (আ.)-এর সন্তানেরা যে খেলা-ধুলার কথার উল্লেখ করেছিলেন, তা ছিল একান্ত বৈধ। নতুবা ইয়াকুব (আ.) কখনো এতে সম্মতি দিতেন না।’

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আশুরা (রহ.) আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর গ্রন্থে বলেন, ‘বিনোদন, শরীরচর্চা ও বিরক্তিভাব কাটানোর লক্ষ্যে বৈধ, খেলাধুলা প্রত্যেক ধর্মে বৈধ ছিল। তবে শর্ত হলো এটি যেনো অভ্যাসে পরিণত না হয়।’

ফকীহ আবুল লাইস আস-সামারকান্দী (রহ.) বাহরুল উলুম গ্রন্থে বলেন, এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, কোনো মুসলিম নিজ শহর থেকে বের হওয়ার পর শরীয়ত-পরিপন্থী নয় এমন বিনোদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা দোষণীয় নয়।

খেলাধুলা ও বিনোদন বৈধ হওয়ার বিষয়ে হযরত আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সংকলিত মুসনাদ কিতাবে বর্ণিত আছে, ঈদের দিনে মসজিদে নবভিতে আবিসিনিয়ার মুসলিমগণ বিভিন্ন খেলাধুলা ও সামরিক কলা-কৌশল প্রদর্শন করছিলেন। এ ধরনের বিনোদনমূলক খেলাধুলার গুরুত্ব অনুধাবন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ.

‘যেন ইহুদি-খ্রিস্টানগণ জানতে পারে, আমাদের দীনে শরীরচর্চামূলক বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। আমি এমন একটি দীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, যা অন্যন্ত সহজ-সরল। এখানে অবেগ-অনুভূতি প্রকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’

বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে, হিজরতের পর সাহাবায়ে কেরাম যখন দেখতে পেলেন, মদীনার অধিবাসীগণ বছরের নির্দিষ্ট দিনে তাদের ঈদ উদযাপন করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইসলামি ঐতিহ্য-নির্দেশক দুটি ঈদের দিন নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি বলেন,
لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْدٌ، وَهَذَا عِيْدُنَا.

‘প্রত্যেক জাতির একটি ঈদ আছে। আর এটি হলো আমাদের ঈদ।’

একবার ঈদের দিনে আনসার এর দু’জন মুসলিম বালিকা হযরত আয়িশা (রাযি.)-এর ঘরে পূর্বপুরুষদের কীর্তি ও ঐতিহ্য-সংবলিত সঙ্গীত আবৃত্তি করতে লাগলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) একাজ শরীয়ত-বিরোধী মনে করে তাদের বাধা প্রদান করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.)-এর উদ্দেশ করে বললেন, ‘তাদেরকে ছেড়ে দাও এবং পূর্বের মতো গাইতে দাও।’
 
হাদীস ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত অনুভূতি প্রকাশে ইসলাম কখনো বাধা দেয়নি, বরং ক্ষেত্র-বিশেষে উৎসাহিত করা হয়েছে। সাহাবী কবি হাসসান ইবনে সাবিত (রাযি.)-এর জন্য কবিতা আবৃত্তির নিমিত্তে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নবভিতে মিম্বর স্থাপন করে এ কথার প্রমাণ দিয়েছেন যে, বৈধ আনন্দ-আহলাদ ইসলামে দোষনীয় নয়।

ইসলামে আনন্দ প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট পরিধি রয়েছে। এ গণ্ডি অতিক্রম করা এবং লাগামহীন ও বেসামাল আনন্দ-স্ফুর্তিতে মত্ত হওয়া শরীয়তে অনুমোদিত নয়। আনন্দ প্রকাশে শরীয়তের নীতিমালা অনুসরণ করা বাঞ্চনীয়। আনন্দ প্রকাশের লাগামহীন যাত্রা কী বিপদ ডেকে আনে, সে বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لِكُلِّ عَمَلٍ شِرَّةٌ، وَلِكُلِّ شِرَّةٍ فَتْرَةٌ، فَمَنْ كَانَتْ فَتْرَتُهُ إِلَىٰ سُنَّتِيْ، فَقَدْ أَفْلَحَ، وَمَنْ كَانَتْ إِلَىٰ غَيْرِ ذَلِكَ فَقَدْ هَلَكَ.

‘প্রত্যেক কাজের একটি বিনোদনমূলক দিক আছে। আবার প্রত্যেক আনন্দের একটি বিরতিমূলক সীমা রয়েছে। সুতরাং যার সীমা হবে আমার সুন্নাহ পর্যন্ত, সে সফলকাম হবে। আর যে এ সীমা অীতক্রম করবে, সে নিশ্চিত ধ্বংষ হয়ে যাবে।’

ফেরেশতা কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত (غسيل الـملائكة) সাহাবী হযরত হানযালা (রাযি.)-এর উপলব্ধিতে রয়েছে মুসলমানদের বিনোদন-বিষয়ক অনেক প্রশ্নের সদুত্তর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ট ও মর্যাদাবান সাহাবী হিসেবে পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে একবার এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল যে, স্ত্রী-পরিজনের সঙ্গে খোশ-গল্প ও হাস্য-কৌতুক ইবাদত এর পরিপন্থিই নয়; এটি মুনাফেকিরই একটি বিশেষ পরিচয়।

সহীহ আল-বুখারী বর্ণিত হাদীসে মূল ঘটনাটি হলো, একদিন হযরত আবু বকর (রাযি.) হযরত হানযালা (রাযি.)-কে প্রশ্ন করলেন, কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো মোনাফেক হয়ে গেছি। সিদ্দীকে আকবর অবাক বিস্ময়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেন। আপনি এ কী বলছেন! তিনি বিষয়টি খোলাসা করে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে যখন আমরা জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনায় মগ্ন থাকি, তখন আমাদের মনের অবস্থা থাকে এক রকম। আবার যখন স্ত্রী-পরিজন ও ধন-সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন মনের অবস্থা হয় অন্য রকম। হযরত আবু বকর (রাযি.) বললেন, আমারও তো ঠিক একই অবস্থা। তারা উভয়ে রাসূল এর নিকট গিয়ে তাদের মনের অবস্থা বর্ণনা দেয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إِنْ لَوْ تَدُوْمُوْنَ عَلَىٰ مَا تَكُوْنُوْنَ عِنْدِيْ، وَفِي الذِّكْرِ، لَصَافَحَتْكُمُ الْـمَلَائِكَةُ عَلَىٰ فُرُشِكُمْ وَفِيْ طُرُقِكُمْ، وَلَكِنْ يَا حَنْظَلَةُ سَاعَةً وَسَاعَةً ثَلَاثَ مَرَّاتٍ.

‘সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ। আমার নিকট থাকাবস্থায় তোমাদের মনের যে অবস্থা থাকে, যদি সর্বদা তোমাদের অবস্থা এমন হতো, তবে পথে-প্রান্তরে তোমাদের সঙ্গে ফেরেশতারা সাক্ষাত করতো। কিন্তু হে হানযালা! তুমি মাঝে-মধ্যে কিছু সময় বিনোদন ও আনন্দ-আহলাদে কাটাবে। তিনি এ কথাটি তিন বার বললেন।’

অবসর সময়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে হৃদয়ের জড়তা ও ক্লান্তি দূর হয়। মনে স্ফুর্তি ও প্রফুল্লতা আসে। কাজের শক্তিতে নতুন মাত্রা যোগায়। এ হাদীস দ্বারা এমন অর্থ গ্রহণ করা সমীচীন নয় যে, একজন মুসলমান পুরো দিন খেলা-ধুলায় মগ্ন থাকবে। অহেতুক কাজে সময় নষ্ট করবে। অথবা এমন বিনোদনে লিপ্ত থাকবে, যা মনের সুস্থ চিন্তাধারায় বিকৃতি ঘটায় এবং মন সর্বদা বিনোদনমুখী থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ রাত পর্যন্ত বিনয়ের সাথে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। অধিকহারে কান্নাকাটি করতেন।

তাঁর পবিত্র যবান থাকতো সর্বদা আল্লাহর যিকরে সিক্ত। তিনি থাকতেন প্রতিনিয়ত চিন্তামগ্ন। এতদসত্ত্বেও তিনি জীবনের প্রতিটি বস্তুর অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সদা সতর্ক করতেন। মানুষের মনের অধিকার ও চাওয়া-পাওয়াকে তিনি কখনো অবহেলা করেননি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.)-এর সীমাতিরিক্ত ইবাদত করার কথা জাতনে পেরে তিনি তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন,
إِنَّ لِرَبِّكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَلِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَلِأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، فَأَعْطِ كُلَّ ذِيْ حَقٍّ حَقَّهُ.

‘তুমি রোযা রাখবে, আবার মাঝে-মধ্যে তাতে বিরতি দেবে। কেননা তোমার ওপর তোমার রবের অনেক অধিকার আছে। তোমার ওপর তোমার মনেরও কিছু অধিকার আছে। তোমার পরিবারের ওপরও তোমার অধিকার আছে। সুতরাং প্রত্যেককে তাদের অধিকার দিয়ে দাও।’

সাহবায়ে কেরাম মুসলিম জীবন-দর্শন সম্পর্কে ছিলেন সর্বাধিক অবগত। মুসলমানের বিনোদনের সীমা-সরহদ সম্পর্কে তারা ছিলেন সম্যক অবগত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সার্বক্ষণিক খাদেম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন,
وَإِنِّيْ أَتَخَوَّلُكُمْ بِالْـمَوْعِظَةِ، كَمَا كَانَ النَّبِيُّ ﷺ يَتَخَوَّلُنَا بِهَا، مَخَافَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا.

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কল্যাণ কামনার মাধ্যমে আমাদের তত্ত্বাবধান করতেন, তেমনিভাবে আমিও তোমাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করি। তার কারণ হলো, সর্বদা একটি কাজে মনোনিবেশ করার কারণে তোমাদের যেনো একপেশে মানসিকতা ও বিরক্তিভাব না আসে।’

তিনি বিনোদনকে মুসলিম জীবনের একটি প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন,
أريحوا القلوب، فإن القلب إذا أكره عمى.

‘তোমরা মনকে সাহায্য করো। কেননা মনের ওপর জবরদস্তি করা হলে তা অন্ধ হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন,
إنّ للقلوب شهوةً وإقبالا، وفترة وإدبارا، فخذوها عند شهواتها وإقبالها، وذروها عند فترتها وإدبارها.

‘মনের কিছু চাহিদা আছে। হৃদয়েরও আছে উত্থান-পতন। অন্তরের বিরতি ও স্থিরতার একটা সময় থাকে, তখন হৃদয় থাকে আয়ত্বাধীন। মন যখন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার লক্ষে লাগামহীন হয়ে ওঠে, তখন তার লাগাম টেনে ধরো। আবার যখন মন পশ্চাদপদ বা বিরাম অবস্থায় থাকে, তখন তার লাগাম ছেড়ে দাও।’

নবী পরিবারে দীক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবী চতুর্থ খলীফা আলী (রাযি.) বলেন,
أَجِمُّوْا هَذِهِ الْقُلُوْبَ وَاطْلُبُوْا لَـهَا طَرَائِفَ الْـحِكْمَةِ؛ فَإِنَّهَا تَمَلُّ كَمَا تَمَلُّ الْأَبْدَانُ.

‘তোমরা অন্তরসমূহকে বিশ্রাম দাও। হৃদয়ের জন্য এমন কিছু বিষয় তালাশ করো, যা হবে চমৎকার ও প্রজ্ঞাপূর্ণ। কেননা শরীরের মতো মনও ক্লান্তি বোধ করে।’

ছয়জন সাহাবী ছিলেন সকল ইসলামি জ্ঞানের সমাহার। এ বিজ্ঞ সাহাবীদের অন্যতম আবু দারদা (রাযি.) বলেন,
إني لأستجمُّ قلبي بشيءٍ من اللهو، ليكون أقوى لي على الـحقّ.

‘আমি মনকে বৈধ খেলা-ধুলার জন্য সুযোগ দেয়াকে ভালো মনে করি। যেন সত্যের পক্ষে এটি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে।’

ইসলামের প্রথমিক যুগে খেলা-ধুলা বা বিনোদন মৌলিক কোনো বিষয় ছিল না। বরং এটা ছিল মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক শক্তি মাত্র। আবার কখনো এটা শরীরচর্চা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও প্রতিযোগিতামূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। যেভাবে অংশ নিয়েছেন হযরত আয়িশা (রাযি.)। এ ধরনের বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতা অনেক সময় দীনের প্রচারে সহযোগী ভূমিকা পালন করে। কুস্তি খেলায় ‘রুকানা’ নামক বীর পুরুষকে তিনি পরাস্ত করেছেন। যা ছিল তার ইসলাম গ্রহণের প্রধান কারণ।

خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، عَلَىٰ قَوْمٍ مِنْ أَسْلَمَ يَتَنَاضَلُوْنَ بِالسُّوْقِ، فَقَالَ: ্রارْمُوْا بَنِيْ إِسْمَاعِيْلَ فَإِنَّ أَبَاكُمْ كَانَ رَامِيًا.

‘একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আসলাম’ গোত্রের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, তারা বাজারে তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি বললেন, ‘হে ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর! তোমরা তীর আন্দাযী প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখো। কেননা তোমাদের পিতা ছিলেন একজন তীর আন্দায।’’

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) ছিলেন পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ। যিনি রাসূল প্রদর্শিত পদ্ধতিতে খিলাফত পরিচালনা করেন। বিনোদন বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের পর তিনি ছিলেন সর্বাধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বিনোদনের পরিধি বর্ণনা করতে তিনি গিয়ে বলেন,

لا بأس على  الـمسلم أن يلهو ويمرح ويتفكه، علىٰ أن لا يجعل ذلك عادته وخلقه، فيهزل في موضع الـجد، ويعبث ويلهو في وقت العمل.

‘আনন্দ-উল্লাস, খেলা-ধুলা বা বিনোদন করা মুসলমানের জন্য দোষনীয় হতে পারে না। কিন্তু এটাকে অভ্যাসে পরিনত করাই হলো নিন্দনীয়। বিনোদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর দিক হলো, বাস্তবতার ক্ষেত্রে ঠাট্টা করা এবং কাজের সময় খেলা- ধুলা করা।’

তিনি আরও বলেন,
تحدثوا بكتاب الله وتجالسوا عليه، وإذا مللتم فحديث من أحاديث الرجال حسنٌ جميل.

‘তোমরা আল কুরআনের আলোচনা করো। এতে গবেষণা করো। আর যখন এ বিষয়ে বিরক্তিভাব আসে, তখন ইতিহাসের সুন্দরতম অধ্যায়সমূহ আলোচনা করতে পারো।’

সাহাবায়ে কেরামের জীবনে বিনোদনের প্রকৃতি ও পরিধি বিষয়ে তাঁর এ উক্তিটি সবিশেষ উদাহরণযেগ্য।

‘সাহাবায়ে কেরাম কখনো একগুঁয়ে ও একপেশে আচার-আচরণ পছন্দ করতেন না। তারা বৈধ বিষয় বর্জনপূর্বক মৃত ব্যক্তির মতো জীবনযাপন করতেন না। তারা নিজেদের সভা-সমাবেশে কবিতা আবৃত্তি করতেন। জাহিলি যুগের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। যখন তাদের মধ্যে কেউ দীনী বিষয়ে কোনো আলোচনা শুরু করতেন, তখন তাতে খুব গুরুত্ব প্রদান করতেন।’

দ্বিতীয় শতাব্দির শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস ও জ্ঞানতাপস আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক। জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি তাঁর অবসর সময় কীভাবে কাটতো, তা নিম্নের উক্তি দ্বারা প্রতিভাত হয়।
كان عبد الله بن الـمبارك يكثر الـجلوس في بيته، فقيل له: ألا تستوحش؟ فَقَالَ: كيف أستوحش وأنا مع النَّبِيّ ﷺ وأصحابه.

‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক দীনী ইলম ও ব্যবসায়-বাণিজ্য থেকে অবসর গ্রহণের পর পূর্বপুরূষদের ঐতিহ্য নিয়ে পড়া-শোনা করতেন। তাকে প্রশ্ন করা হলো, এ বিষয়টির প্রতি আপনার অত্যধিক ঝোঁক ও আগ্রহের কারণে কি এ আশঙ্কা হয় না যে, আপনি দীনী ইলম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমি যখন যে অবস্থায় থাকি, রাসূল ও তার সাহাবীদের সাথে থাকি।


তথ্যসূত্রঃ 
►  আল-কুরআন, সূরা ইউসুফ, ১২:১২
►  আল-জাস্সাস, আহকামুল কুরআন, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৩ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ৩৮১
►  আবুল লাইস আস-সমরকন্দী, বাহরুল উলূম, খ. ২, পৃ. ১৮২
►  আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৪১, পৃ. ৩৪৯, হাদীস: ২৪৮৫৫
►  আল-বায়হাকী, আল-আদাব, মুআস্সাসাতুল কুতুব আস-সাকাফিয়া, বয়রুত, লেবনান, পৃ. ২৫৬, হাদীস: ৭৭৭
►  আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, খ. ১১, পৃ. ৩৭৫Ñ৩৭৬, হাদীস: ৬৭৬৪
►  মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২১০৬, হাদীস: ২৭৫০
►  আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৩৮, হাদীস: ১৯৬৮
►  আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ২৫, হাদীস: ৭০
►  ইবনে আবদুল র্বার, বাহজাতুল মাজালিস ওয়া আনাসুল মাজালিস, পৃ. ১১৫
►  ইবনে আবদুল র্বার, বাহজাতুল মাজালিস ওয়া আনাসুল মাজালিস, পৃ. ১১৫
►  ইবনে আবদুল র্বার, জামিউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফযলিহি, দারু ইবনিল জাওযী, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৪ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৪৩৩, হাদীস: ৬৫৯
►  ইবনে আবদুল র্বার, বাহজাতুল মাজালিস ওয়া আনাসুল মাজালিস, পৃ. ১১৫
►  আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৪, পৃ. ১৮০, হাদীস: ৩৫০৭
►  আল-খতীবুল বগদাদী, তারীখু বগদাদ, দারুল গারব আল-ইসলামী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০২ খ্রি.), খ. ১১, পৃ. ৩৮৮, হাদীস: ৫২৫৯

পঠিত : ১৩৫২ বার

মন্তব্য: ০