Alapon

কবরে, হসপিটালে কিংবা বিদেশে বসেও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে যেভাবে...

প্যারালাইজড রোগী, এমনকি মৃত ব্যক্তি যদি গাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করতে পারেন, তবে বিদেশে অবস্থান করেও জনসভায় ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ রাখতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ তাকেও মামলার আসামি করতে পারে। অবাক না হয়ে, আসুন গত কয়েকদিনের কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেই।

ঘটনাই ঘটেনি, মামলা করে রেখেছে পুলিশ: প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কেন এত ‘ভৌতিক মামলা’?: ডয়চে ভেলে, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
আজগুবি মামলায় ভুতুড়ে আসামি: যুগান্তর, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
গায়েবি মামলা এবার ফখরুলদের বিরুদ্ধে: প্রথম আলো, ২ অক্টোবর ২০১৮
লাখো মামলার জালে বিএনপি: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ অক্টোবর ২০১৮

এমন আরও অনেক শিরোনাম উল্লেখ করা যায়। সেদিকে না গিয়ে ‘যুগান্তর’র প্রতিবেদনটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক-

ক. নুরুল ইসলাম মারা গেছেন ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট। সেদিনই আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মারা যাওয়ার ৫ দিন পর, ৫ সেপ্টেম্বর নুরুল ইসলাম কামরাঙ্গীরচরে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। সেই অভিযোগে কামরাঙ্গীরচর থানায় ৫ সেপ্টেম্বর তার নামে মামলা হয়েছে।

অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে আজিজুল্লাহর নামে চকবাজার থানায় মামলা হয়েছে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮। আজিজুল্লাহ গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন মারা যাওয়ার প্রায় ২ বছর পর। তিনি মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে।

খুলনার যুবদল নেতা ফয়সল গাজী ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ বছরের ২৯ আগস্ট। ২ সেপ্টেম্বর দায়ের করা দাকোপ থানার নাশকতার মামলার আসামি ফয়সলও। মারা যাওয়ার তিন দিন পর তিনি নাশকতা করেছেন।

খ. কুমিল্লার মুরাদনগরের আহাদ খলিফা থাকেন বাহরাইনে। দেশে এসেছিলেন ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাহরাইনে ফিরে গেছেন। ফিরে যাওয়ার প্রায় ৮ মাস পরে মুরাদনগর থানায় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তার নামে মামলা হয়েছে।

গ. ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় চিকিৎসার জন্যে ছেলেকে নিয়ে সাইয়েদুল আলম সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন। তিনি গাজীপুর জেলার বিএনপি নেতা। ওইদিন সকাল ১১টায় বিএনপি একটি মানববন্ধন করে। নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগে পুলিশ একটি মামলা করে। সাইয়েদুল আলমও সেই মামলার আসামি। অর্থাৎ তিনি যখন উড়োজাহাজে আকাশে, সিঙ্গাপুরেও পৌঁছাননি সেই সময় তিনি গাজীপুরে যানবাহন ভাঙচুরে অংশ নিয়েছেন।

ঘ. ৮৬ বছরের প্যারালাইজড রোগী আবদুল খালেক সরকার। ৭ সেপ্টেম্বর বগুড়ার ধুনট থানায় পুলিশ একটি নাশকতার মামলা করেছে। সেই মামলার একজন আসামি খালেক সরকার।

ঙ. ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর তানোর থানায় পুলিশ একটি নাশকতার মামলা করে। সেই মামলার একজন আসামি জামালউদ্দিন। সেই সময় তিনি হজ পালনের জন্যে সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন।

২.  মৃত ব্যক্তি, বৃদ্ধ প্যারালাইজড রোগী, হজ বা চিকিৎসার জন্যে বিদেশে থাকা ব্যক্তি, প্রবাসীদের নামে নাশকতা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-পুলিশের উপর আক্রমণ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার আসামির তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকও আছেন। কোনো মামলায় ৩০ জন কোনো মামলায় ৯০ জনসহ অজ্ঞাতসংখ্যক আসামি। মামলাগুলোর প্রায় সবই বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

কয়েকদিন আগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের নামে মামলা হয়েছিল। সেই লেখার শিরোনাম করেছিলাম ‘বাদী কিছুই জানেন না, ভূত এসে মামলা করে গেল’!

এবার আর ভূতের ব্যাপার নেই। প্রায় সব মামলা করেছেন পুলিশ কর্তারা নিজেরা বাদী হয়ে। সারা দেশে এমন মামলার প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন’র ৩ অক্টোবরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দশ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ৯৫ হাজারেরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে এবং আসামির সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশ। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার, আসামির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ! গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত অল্প কিছু সংখ্যক মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে অভিযোগে মামলা হয়েছে, সেই ঘটনা সেসব এলাকায় ঘটেনি। অথচ মামলা হয়েছে।

৩.  গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। পুলিশ ২২টি শর্ত সাপেক্ষে জনসভার অনুমতি দিয়েছিল। শর্ত মেনেই বিএনপিকে জনসভা করতে দেখা গেছে।

জনসভায় দলীয় কর্মীদের আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে ‘সরকারবিরোধী উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। আসামি করা হয়েছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ,মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়দেরকে।

জনসভায় ‘উস্কানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ও মামলার আসামী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। রিজভী আহমেদ দেশে থাকলেও জনসভায় উপস্থিত ছিলেন না। ‘উস্কানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগের মামলায় পুলিশ তাকেও আসামি করেছে।

‘উস্কানিমূলক বক্তব্যে’ তারা কী বলেছেন, সুনির্দিষ্ট করে তা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, রোববার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাত সোয়া ৮টার দিকে মগবাজার এলাকায় বিএনপি সমর্থকরা হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, হত্যার উদ্দেশে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, যানবাহন ভাঙচুর করে এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশেই এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে পুলিশ। ভাঙচুরের শিকার গাড়িগুলো দ্রুত চলে যাওয়ায় গাড়ির নাম্বার সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ। আলামত হিসেবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি বাঁশের লাঠি, দেড় লিটার পেট্রোল, বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ জব্দ করেছে।

একাধিক গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী ঘটনাস্থলে গিয়ে দোকানদার, পথচারী, ফুটপাতের শরবত বিক্রেতা, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কেউ এই এলাকায় সেদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেখেননি। এমন কি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও ককটেল বিস্ফোরণ বা ভাঙচুরের কোনো ঘটনার কথা জানেন না।

গায়েবি মামলার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ‘অজ্ঞাতনামা’র তালিকায় যে কাউকে যে কোনো সময় আসামি করার পথ উন্মুক্ত থাকছে।

এখন পর্যন্ত বিএনপি মহাসচিবের নামে মামলার সংখ্যা ১০৬টি। অধিকাংশ নেতার নামে মামলা শতাধিক। কারো কারো নামে দুই’শ। সবার থেকে এগিয়ে আছেন হাবিবুন নবী খান সোহেল। তার নামে মামলার সংখ্যা ৪৫৩টি।

৪. রাজনীতি বা নির্বাচনী রাজনীতিতে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, অস্বাভাবিক বিষয় নয়। অস্বাভাবিক নয়, দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিবেশ তৈরি হওয়াও। তা নিয়ন্ত্রণের জন্যে জনগণের শেষ ভরসা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এমনিতেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনআস্থায় একটা ঘাটতি আছে। সেরকম অবস্থায়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় নির্বাচনের চার মাসেরও কম সময় আগে, গায়েবি মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশের প্রতি জনআস্থার বিষয়টি কেমন হবে বা হতে পারে? সবার জন্যে সমান সুযোগ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ- তা কী শুধু কথা এবং কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

পঠিত : ৭২৪ বার

মন্তব্য: ০