Alapon

সাবা মাহমুদঃ অধিকার, স্বাধীনতা এবং লিবারেলিজমের মোকাবিলা

প্রাক কথা

৯/১১ পরবর্তী দুনিয়ায় সাধারণ ভাবে ধর্ম এবং বিশেষ ভাবে ইসলাম প্রশ্ন সামনে চলে আসার কারনে একাডেমিক জগতে ধর্ম, দর্শন, রাষ্ট্র ইত্যাদি নতুন করে পর্যালোচনার অধীন হচ্ছে আবার, বিশেষত এদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার জরুরী হয়ে উঠেছে। এই তাগিদে নতুন উৎসাহে ইসলাম নিয়ে নতুন পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘স্বাধীনতা’, ‘অধিকার’ ইত্যাদি ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তার ছেদ ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গিয়ে সেক্যুলার, উদারনৈতিক এবং প্রগতিশীল ধারার যে চিন্তা জারি আছে, সেটাও বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রশ্নের কোন কার্যকর মীমাংসার প্রস্তাব করতে পারছেনা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশ্নের যেসব উত্তর তারা দিয়েছিলেন এতে নতুন করে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই সন্দেহ মূলত প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ইসলাম নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে।

ইসলাম নিয়ে পঠন পাঠনের ভিতরে এসব চিন্তার সংকটগুলো যারা ধরতে পেরেছেন, নতুন প্রশ্ন তুলেছেন তাদের অন্যতম পথিকৃৎ সাবা মাহমুদ (১৯৬১-২০১৮)। টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে উড়োজাহাজ হামলার পর থেকে ইসলাম এসব পঠন পাঠনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেও সাবা মাহমুদ এটি টের পেতে শুরু করেন আরো খানিকটা আগেই, যেখান থেকে তাঁর নৃতত্ত্বে পড়তে আসা। তিনি ছিলেন মূলত স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থী। আমেরিকায় পড়তে আসার আগে তিনি পাকিস্তানের সেক্যুলার প্রগতিশীল বলয়ের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন।

প্রগতিশীল বলয়ের অংশ হিসাবে সমসাময়িক ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং পাকিস্তানের জিয়াউল হকের স্বৈরাচারী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কৌশল আকারে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করার বিষয়টা তাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি কাজ করত। সেসময়ে জনগণের একটা বড় অংশের ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়কে সাধারনভাবে নাকচ করে দিয়ে তারা এর নানান ব্যাখ্যা দিতেন। কখনো মনে করতেন এসব জনগোষ্ঠীর মাঝে আধুনিক শিক্ষার ব্যাপক অভাব, অথবা ভাবতেন মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে আসা ‘‘রক্ষণশীল ধাঁচের’ ইসলামের প্রসারের ফলেই এই অবস্থা, আবার কখনোবা মনে করতেন সেনাশাসনের ইসলামিকীকরণ প্রজেক্টের ফল এইটা।

এছাড়া মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে প্রগতিশীল আন্দোলনগুলো দমানোর জন্য আমেরিকান পুঁজি এবং মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের গোপন আঁতাত এসব দেশগুলোতে একটা রক্ষণশীল ধাঁচের ইসলামকে বরাবর প্ররোচিত করার গল্পও ছিল তাদের চিন্তার অন্যতম খোরাক (Mahmood, 2005, p. ৫)।

আমেরিকায় স্থাপত্যবিদ্যা পড়াকালীন মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের উপর মার্কিনীদের হামলার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার সময় থেকেই ইসলাম নিয়ে গড়ে উঠা এসব ধারণায় মাহমুদের প্রথম সন্দেহ জেগে উঠে। স্থাপত্যচর্চা এবং রাজনৈতিক এক্টিভিজমের বাইরে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। কিছুকাল ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তালাল আসাদের ‘Anthropology of Islam’ আর্টিকেল পড়ার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছেড়ে নৃবিজ্ঞানে আসেন। যদিও সেসময়ে একাডেমিক জগতে এখনকার মত ইসলাম নিয়ে পড়াশোনার এত তাগাদা ছিলনা।

ফলে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় স্টানফোর্ডের লাইব্রেরীতে তালাল আসাদের বর্তমান বহুল পঠিত আর্টিকেলটারও তিনি হদিস পাননি। অন্য জায়গা থেকে ধার নিয়ে পড়া এই নিবন্ধ ধর্ম এবং ইসলাম প্রশ্ন নিয়ে তাঁর মনে গভীর চাপ তৈরি করে। এর সূত্র ধরেই তিনি আস্তে আস্তে সেক্যুলারিজম, ইসলাম, রাজনীতি, সংখালঘু, নারীবাদসহ নানান রেজিস্টারে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন (Mahmopod, 2011) । এই অনুসন্ধানের জন্যে প্রথমে আলজেরিয়া, পরে মরক্কো ঘুরাঘুরি করলেও মিশরে এসে থিতু হন তিনি। এখানে কাজ করতে করতেই তিনি নারীবাদ, এজেন্সি, অধিকার, বাক-স্বাধীনতার ধারণাগুলার তত্ত্ব-তালাশ করে একাডেমিক জগতে  একাডেমিক জগতে একটা বড় সড় ঝাঁকুনি দেন।   

এজেন্সি, অধিকার আর নারীবাদ

নারীর অধিকার প্রশ্নে সাবা মাহমুদের প্রথম প্রভাবশালী বই হচ্ছে ‘ধার্মিকতার রাজনীতি’। পর্দা এবং ইসলাম ধর্ম চর্চার ভিতরে লিবারেল নারীবাদী যে ধারণাটা আছে যে মেয়েদের এখানে কোন স্বাধীনসত্তা বা সাবজেক্ট নেই, মুসলিম মেয়েরা এখানে নিপীড়িত আর অধীনস্থ, এই বইতে এটাকে তিনি প্রশ্ন করেছেন। বইটি মূলত মিশরের নারীদের মসজিদ ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের উপর রিগোরাস এথনোগ্রাফিক গবেষণা, যেখানে মেয়েদের সাম্য আর সমানাধিকারের প্রশ্নে সেক্যুলার নারীবাদী ব্যাখ্যাকে তিনি খারিজ করেছেন। মসজিদ ভিত্তিক নারীদের এই আন্দোলনকে মোটাদাগে দুনিয়াব্যাপি ইসলামী পুনর্জাগরণের একটা ধারা আকারে গণ্য করা হয়।

এই কাজটা করতে গিয়ে মাহমুদ পরখ করে দেখছেন কিভাবে সেক্যুলার লিবারেল নারীবাদী চিন্তাকাঠামোতে ‘এজেন্সি’ ধারণাটাকে প্রধানত ‘রেসিস্ট্যান্স’ (resistence) আকারে পাঠ করা হয়, এবং নারীর মুক্তির সাধারণ মানদণ্ড আকারে এই রেসিস্ট্যান্সকেই বিবেচনা করা হয়। জুডিথ বাটলারের রেসিসট্যান্সের পর্যালোচনার সূত্র ধরে এই ধারণাটার ঘাটতির জায়গাটা তিনি সহজেই ধরেছেন।

সেক্যুলার লিবারেল  কাঠামোতে ধরে নেয়া হয় যে, মানুষ এমন এক সত্তা যার নিজের ভিতরেই একটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, এবং সমাজ,রাষ্ট্র, ধর্ম, রাজনীতি, পরিবার আর শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষমতার নানান বিন্যাস মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির প্রকাশকে বাইরে থেকে নানানভাবে বাধা দেয় (Mahmood, 2005, p. ২০)। ফলে মানুষ নিজের এই ইচ্ছাশক্তি খর্ব করার বাধাগুলো থেকে মুক্ত হতে চায়; এই মুক্ত হওয়ার লড়াইকেই বলা হচ্ছে রেসিসট্যান্স। যে অনুমানের উপর ভিত্তি করে মানুষের এই এজেন্সিকে ব্যাখ্যা করা হয়, মাহমুদ তাকেও প্রশ্ন করছেন। মানুষের ভিতর আপনা থেকেই খোদ যে ইচ্ছাশক্তির ধারণা উপস্থিত বলা হচ্ছে সাবা তা মানতে নারাজ, বরং তার মত হচ্ছে খোদ মানুষের যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কথা বলা হচ্ছে এই ইচ্ছাশক্তিটাও সমাজ,রাষ্ট্র, ধর্ম, রাজনীতি, পরিবার, শিক্ষা আর আর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর মিথষ্ক্রিয়ার দ্বারাই প্রভাবিত।

ফলে আধুনিক নারীবাদে নারীদের যে এজেন্সির কথা বলা হচ্ছে এই এজেন্সিটা যেমন আর্থ-সামাজিকসহ আর আর ক্ষমতা কাঠামোর মিথস্ক্রিয়ায় প্রভাবিত এবং শর্তযুক্ত, একই যুক্তি ধর্মীয় কাঠামোর ভিতরে গড়ে উঠা নারীর কর্তাসত্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

pietyনারীর অধিকার প্রশ্নে সাবা মাহমুদের প্রথম প্রভাবশালী বই হচ্ছে ‘ধার্মিকতার রাজনীতি’। পাশ্চাত্য লিবারেল চিন্তার ধারণা  হচ্ছে ইসলামে পর্দানশিন মেয়েদের কোন স্বাধীন কর্তাসত্তা বা সাবজেক্ট নাই, মুসলিম মেয়েরা  নিপীড়িত আর পুরুষের অধীনস্থ। পর্দা তার প্রমাণ। সাবা মাহমুদ এই বদ্ধমূল পাশ্চাত্য ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

বইটি মূলত মিশরের নারীদের মসজিদ ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের উপর ব্যাপক, গভীর ও সনিষ্ঠ গবেষণা। মসজিদ ভিত্তিক নারীদের এই আন্দোলনকে মোটাদাগে দুনিয়াব্যাপি ইসলামী পুনর্জাগরণের একটা ধারা হিশাবে শনাক্ত করা হয়। তালাল আসাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত নৃ-বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নজর দিয়ে পর্যালোচনা। সাবা মাহমুদ  সাম্য আর সমানাধিকার নিয়ে সেক্যুলার নারীবাদীদের অনুমান ও ব্যাখ্যাকে খারিজ করে দিয়ে গর্বিত মুসলিম নারীর কর্তাসত্তা সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবনাচিন্তার শর্ত তৈরি করে দিয়ে গেছেন। 


তো মিশরের মসজিদ আন্দোলনের মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান এযাবতকালের পুরুষশাসিত ধর্মীয় পরিসরের বাইরে অভূতপূর্বভাবে এই আন্দোলনে নানান শ্রেণী পেশার নারী মসজিদ কেন্দ্র করে একত্র হয়েছে। আবার তাদের এই রকম আলাদাভাবে একত্র হওয়াটা কোনভাবেই লিবারেল সেক্যুলার স্বাধীনতা, স্বকীয়তা বা সাম্যের ধারণার পাটাতনে পরিব্যপ্ত হয় নি, বরং উলটো ধর্মীয় আবহের মধ্য দিয়েই হয়েছে। এই আবহে নারীরা নিজেদের মধ্যে কোরান হাদিসের তাফসির আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করার মধ্য দিয়ে নৈতিক দায়-দায়িত্বের ব্যপারে সচেতন হচ্ছে।

নৈতিক দায়দায়িত্ব ছাড়াও তাদের এইসব আলাপে সামাজিক কল্যাণ , গরীব মানুষের সেবা যসমাজের অপরাপর বঞ্চিত মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতার উপর জোর দেয়া হয়। আর এভাবেই তারা নিজেদের মধ্যে এক ধরণের ধার্মিকতার চর্চা করে। আর এই চর্চাটাই তাদের নির্দিষ্ট এজেন্সি বা কর্তাসত্তার প্রমাণ করে। (Mahmood, Anthropologist and Author of ”The Politics of Piety”, N.A)

এই কাজটায় মূলত তিনি ধর্মীয় পরিসরে লিঙ্গ আর ক্ষমতা অবয়বের পরিবর্তনের হদিস করেছেন। যাইহোক, এই পরিবর্তনটা লিবারেল চিন্তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক ‘স্বাধীনতা’ আর এজেন্সির পাটাতনের বাইরে পুরোপুরি ধর্মীয় আর নৈতিক কার্যকলাপের উপর ভর করে সাধিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সুশীল সমাজের গণ্ডির বাইরে কিভাবে ধর্মীয় নৈতিকতা রাজনৈতিক রূপান্তর পরিব্যপ্ত করতে পারে মাহমুদের এই প্রভাবশালী এথনোগ্রাফি তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে।

পর্দা, নেকাব, এজেন্সি

সাবার মতে, সাম্প্রতিককালে পশ্চিম এবং ইসলামের মধ্যকার পারস্পরিক মোকাবেলায় হিজাব খুবই আলোচিত বিষয় হিসাবে সামনে চলে এসেছে। আসার মূল কারনটা আসলে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারসূত্র। ইসলাম নারীকে যে আকারে হাজির করে তার উপর ভর করে একসময়ের উপনিবেশিক শাসকেরা পর্দা এবং হিজাব প্রথাকে ইসলাম ধর্মের সাংস্কৃতিক অধঃস্তনতার চিহ্ন আকারে ঘোষণা করে। অন্য কথায়, ইসলামে নারীকে অধঃস্তন আকারে হাজির করা হয় আর এই অধঃস্তনতার সবচাইতে বড় দৃশ্যমান প্রতীক হচ্ছে পর্দা, আর এই আলাপটা পুরো উপনিবেশিক সময়ের লেখাজোখাগুলোতে বারংবার খুজে পাওয়া যায় (Mahmood 2010)।

পিতৃতন্ত্রের ছোবল থেকে নারীদের মুক্ত করার জন্যে আলজেরিয়াসহ দুনিয়ার অসংখ্য জায়গায় জনপরিসরে জোরপূর্বক পর্দা খোলার ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরুপ, ইরানে রাজা শাহ ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজটা করেন তা হচ্ছে পর্দা নিষিদ্ধ করা, তুরস্কেও একই অবস্থা ছিল। মিশরে নারীবাদী নেত্রী হাওদার নেতৃত্বে জনসমাগমে মেয়েরা পর্দা খুলে বলেছিল ‘এইটা আমাদের স্বাধীনতা’। আজব ব্যপার হচ্ছে, ঠিক এর বিপরীতে পরবর্তী প্রজন্মের অনেক নারীই আলাপ তুলেছে পর্দা নিপীড়নের প্রতীক নয়, এটা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রতীক। এমনকি অসংখ্য নারী এই পর্দাকে নিজেদের পরিচয় আকারে হাজির করেছে, এবং বলছে এটাই ইসলাম।

এর বাইরে এমন নারীও আছে যারা পর্দার বিষয়ে কোন অবস্থান না নিলেও নিজেরা মনে করে এটা খোদায়ী বিধান এবং ধার্মিকতার একটা পথ। আর সাবার মতে, এই অবস্থানটা পশ্চিমা সেক্যুলার চিন্তায় বোঝা অনেক কঠিন। কেননা পর্দা নিয়ে মুসলিম মেয়েদের এই ধারণাটা যৌনতার বিষয়ে ইসলামের ভিন্ন ধরণের একটা বোঝাপড়া নির্দেশ করে যেটা যৌনতার সাথে লিবারেল সমাজের যে সম্পর্ক তার থেকে আলাদা। এটা আবার এমন না যে, ইসলাম যৌনতার বিষয়টা ঢেকে রেখেছে, আর ইউরোপ এই বিষয়ে উদাসীন, বরং এই দুই চিন্তায় যৌনতার বোঝাপড়াটাই আসলে ভিন্ন ভিন্ন।

যাইহোক, কেবল গত কয়েক দশকেই ইসলামের পশ্চাদপদতার চিহ্ন আকারে যেভাবে পর্দাপ্রথাকে হাজির করা হয়েছে, এবং সমাজে সভ্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এই পর্দার বিরুদ্ধে লড়াই চলেছে, তার বিপরীতে অনেক মেয়েই এখন এভাবে দাড়াচ্ছেন যে ‘হিজাব ই আমাদের সভ্যতার মানদণ্ড’। সাবার মতে, ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক এই মুসলিম নারীরা যে বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা আর অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে পর্দাসহ ধার্মিকতা আর নৈতিকতা মেনে চলার চেষ্টা করে, তা তাদের একটা নিজস্ব স্বাধীনতা আর এজেন্সির অর্থই প্রকাশ করে (Mahmood, Feminist Theory, Embodiment, and the Docile Agent: Some Reflections on the Egyptian Islamic Revival. Cultural Anthropology 16(2):202–236., 2001, p. ২০৫) ।

বাক-স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তা

বাক-স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তার আলাপকে যেখানে অনেকেই সেক্যুলারিজমের সাথে জড়িয়ে দেন সাবা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

আসাদের আলাপের সূত্র ধরে তিনি দেখাচ্ছেন চিন্তা মাত্রেই শর্তযুক্ত। মানে একটা পরিবেশ পরিস্থিতিতে যা চিন্তা করতে এলাও করে এরই শর্তসাপেক্ষ। আসাদের মতে ধার্মিকতার বিপরীতে যে সেক্যুলারিজমকে যুক্তিবোধ, স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তার প্রতীক আকারে ভাবা হয় এটা ঠিক নয়। চরিত্রগতভাবে সেক্যুলারিজম আসলে লিবারেলিজম আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিকতার সাথে সংযুক্ত। তাই এখানে স্বাধীনতাকে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি (প্রপার্টি) আকারে হাজির করা হয়। কিন্তু এই স্বাধীনতা আদতে দু’টি উপায়ে শর্তসাপেক্ষ।

প্রথমতঃ যে আর্থ সামাজিক কাঠামোতে ব্যক্তি বাস করে তা সবসময় বিভিন্নভাবে ব্যক্তির কর্তাসত্তার স্বাধীনতাকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি খর্বও করে। দ্বিতীয়ত টিকে থাকার প্রয়োজনে স্বাধীনতা যে উপায়ে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠার উপর নির্ভর করে তা একটা সুনির্দিষ্ট মালিকানার ধারণা এবং মালিকানার স্বত্তের উপর নির্ভর করে, যেটাকে আইনিভাবে হাজির করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কপিরাইট আইন যেভাবে মুক্তচিন্তার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মুক্তচিন্তা আর স্বাধীনতা বলে লিবারেল সেক্যুলার চিন্তায় যা ভাবা হয় তা সব সময় ক্ষমতাকাঠামোর ভিতরে শর্তযুক্ত।

উদাহরণস্বরূপ, কপিরাইট আইন যেভাবে মুক্তিচিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মুক্তচিন্তা আর স্বাধীনতা বলে লিবারেল সেক্যুলার চিন্তায় যা ভাবা হয় তা সব সময় ক্ষমতাকাঠামোর ভিতরে শর্তযুক্ত। তো সেক্যুলার চিন্তায় স্বাধীনতা মাত্রই যেহেতু ক্ষমতাকাঠামোর ভিতরে শর্তযুক্ত, তো সাবা দাবি করছেন, ইসলাম ধর্মতত্ত্বের কাঠামোতে দাঁড়িয়ে যে স্বাধীনতা ধারণার আবির্ভাব ঘটে সেটাও ব্যতিক্রম নয়।

সাবার মতে ইসলাম ধর্মের ধার্মিকতা চর্চার ভিতর দিয়ে যে কেউই লিবারেল সেকুলার চিন্তার বাইরে একধরণের কর্তাসত্তা (সাব্জেক্টিভিটি), স্বাধীনতা (ফ্রিডম) এবং আঘাত/ব্লাসফেমির ধারণা পায়। এখানে তিনি ইসলাম বনাম পশ্চিমা লিবারেল চিন্তার বিভাজন ঘটাচ্ছেন না, বরং এই বিভাজনের শর্তকে প্রশ্ন করছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি আলাপ তুলছেন, ড্যানিশ কার্টুন বিতর্কে কিভাবে পশ্চিমা লিবারেল চিন্তায় কর্তাসত্তা, স্বাধীনতা আর আঘাত নিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট ধারনার অবতারণা করা হয়েছে।

নবী মুহাম্মদ (স) এর আইকন (প্রতিচ্ছবি) এবং ইমেজের (ভাবমূর্তির) সাথে ধার্মিক মুসলমানদের কিছু সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে । যদিও আইকনকে বাস্তবতার বাইরে একটা প্রতিকৃতি আকারে মনে করা হয়, সেখানে তারা নবীর আইকনকে স্রেফ একটা নবীর প্রতিকৃতি আকারে দেখে না। তারা বিশ্বাস করে যে নবীর আইকন মুমিন মুসলমানদের সাথে এমন এক সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে মনে হয় তাদের জীবন এই নবী ‘মুহাম্মদ’এর সাথেই আছে, অর্থাৎ এই সম্পর্কটা মুসলমানদের বাস্তবিক এবং দৈহিক জীবনের (material and bodily life) খুব গভীরে গ্রোথিত।

কাজেই নবীকে অপমান করার যেকোন আঘাত আদতে মুসলমানদের বাহ্যিক জীবনের সাথে মুহাম্মদের যে সম্পর্কটা জড়িয়ে আছে সেখানে একধরণের ছেদ তৈরি করে। নবীর জীবনের সাথে মিশে এসব মানুষের যে সম্পর্কটা দাঁড়িয়ে আছে সে মানুষের কর্তাসত্তার ধারণায় এই আঘাতটা একধরণের ‘লঙ্ঘনের অনুভূতি'ও তৈরি করে। এই লঙ্ঘন আবার আইনিভাবে মীমাংসাও খুব জটিল। কেননা আধুনিক আইন স্রেফ ধর্মকে একটা বিশ্বাস আকারে গণ্য করে, অন্যদিকে এসব মানুষদের কাছে ধর্মটা বিশ্বাসের বাইরেও দৈহিক ও জাগতিক (material and bodily life) কিছুও” (Mahmood, 2009, p. ৭৮)

অধিকার এবং সেক্যুলারিজম

সাবা মাহমুদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই, Minority Report: Religious Difference in a Secular Age। মুসলিম প্রধান দেশ সমূহ বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশে ধর্মীয় সহিংসতা আর সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রশ্নে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতাকে যেভাবে গতানুগতিক চিন্তাধারায় হাজির করা হয় এটাকে তিনি জোরালোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। মিশরের বাহাই ধর্মাবলম্বী আর কপ্টিক খ্রিস্টান এবং ফ্রান্সের মুসলিমদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন, খোদ আধুনিক রাষ্ট্রে সেক্যুলারিজম কিভাবে সংখ্যালঘু প্রশ্নের মীমাংসা না ঘটিয়ে বরং এটিকে আরো সমস্যা সংকুল করেছে।

এই প্রশ্নবিদ্ধতার জায়গায় তিনি তালাল আসাদের বোঝাপড়ার উপর ভর করে সেক্যুলারজিমকে স্রেফ রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার বিষয় আকারে পাঠ করেন নি, বরং পাঠ করেছেন কিভাবে সেক্যুলারিজম ধর্মকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত এবং নিয়ন্ত্রণ করতে আধুনিক রাষ্ট্রকে অভূতপুর্বভাবে এই প্রক্রিয়ায় শামিল করেছে। তার মতে, চরিত্রগতভাবে সেক্যুলারিজমের কিছু পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে। কেননা সাধারণত এটা ধরে নেয়া হয় যে, সেক্যুলারিজম ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবে, এবং রাষ্ট্র থেকে চার্চ আলাদা থাকবে এবং ধর্ম পালনটা ব্যক্তিগত পরিসরে সীমবাদ্ধ হবে।

কিন্তু ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ করতে গিয়ে এটা যে উপায়ে ধর্মের চৌহদ্দি ঠিক করে দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে, তাতে রাষ্ট্র আপনাই অনেকগুলো ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চর্চার বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে। একারণে সংখ্যসলঘু-সংখ্যাগুরুর পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে সেক্যুলারিজম ধর্মকে অনেক জটিল করে ফেলে।

ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর সাবা মাহমুদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

তার মতে, রাষ্ট্র সব সময়ই সংখ্যাগুরুদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক প্রতীককে জাতির নিরপেক্ষ পরিচয়ের চিহ্ন আকারে গ্রহণ করে। এবং সংখ্যালঘুদের আচার-চিহ্নকে জাতীয় পরিচয়ের জন্য হুমকি মনে করে, যার দরুন সংখ্যালঘুদের আচার চিহ্নকে সব জায়গাতেই নিয়ন্ত্রণ এবং দমন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে একদিকে বোরকাকে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতীক এবং নারীর দাসত্বের প্রতীক আকারে হাজির করে জনপরিসরে নিষিদ্ধ করা হয়, অন্যদিকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে সাম্য, স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবিক মর্যাদার চিহ্ন আকারে হাজির করা হয়। এটা প্রমাণ করে কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের আচার-আদর্শ রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নকে প্রভাবিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি এই পক্ষপাত, তুরস্ক আর ফ্রান্সের মত পরিপূর্ণ সেক্যুলার রাষ্ট্রে যেমন কাজ করে, মিশরের মত অপূর্ণ সেক্যুলার রাষ্ট্রেও কাজ করে।

মাহমুদ আলাপ তুলছেন, ধর্মীয় সমতা এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা যেটাকে সার্বজনীন এবং নিরপেক্ষ ভাবা হয়, তা উপনিবেশিক স্বার্থের অংশ আকারে একটা ঐতিহাসিক বাঁকপথের (trajectory) মধ্যে আকার লাভ করেছে। ওসমানীয় খেলাফতের খ্রিস্টান এবং মিশরের কপ্টিকদের মত সংখালঘুদের মানবাধিকারের নামে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বারবার যে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, তাও মুলত ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই। একই ধরণের উদ্বেগ উঠে এসেছে ধর্মীয় স্বাধীনতার সুরক্ষায় সার্বজনীন মানবাধিকারের ১৮ অনুচ্ছেদ প্রণয়নের সময়েও।

মূলত এই অনুচ্ছেদটা প্রণয়ন করা হয়েছে মুসলমান এবং কমিউনিস্ট বিশ্বে ধর্মান্তরকণ এবং নিজেদের ধর্মপ্রচারকে সহজতর করার জন্যে আমেরিকার ইভানজেলিক খ্রিস্টান এবং ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারীদের ক্রমবর্ধমান প্রচার –ক্যাম্পেইনের জন্যে। অতএব “এসব ক্যাম্পেইন আর প্রচার প্রচারণাগুলার ধর্মীয় উপাদানগুলাকে সেক্যুলার উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন করা খুব কঠিন” (Mahmood, 2015, pp. ৪৬-৪৭)

মিশরে সংখালঘু ধারণার বিতর্ককে ঘিরে তিনি দেখাচ্ছেন পুরো উপনিবেশিক শাসনের সময়ে সংখ্যালঘু ধারণার সংজ্ঞায়ন এবং আন্তর্জাতিক আইনে এর সংশ্লেষ কপ্ট এবং মিশর সরকারকে প্ররোচনা করেছে যাতে বিংশ শতকের বড় সময় জুড়ে তাদের সংখালঘু আকারে বিচার না করা হয়। অথচ আধুনিক মিশর রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে, সরকার আর কপ্ট উভয় সম্প্রদায় ক্রমবর্ধমানভাবে এখন মাইনরিটি শব্দের ব্যবহার করছে। বয়ানের এই বদলটা তিনটা কারণে হয়েছে, সুশাসন ধারণার আবির্ভাব , যেখানে ধর্মীয় সংলঘুদের মানবাধিকারের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ, দুনিয়াজুড়ে খ্রিস্ট চার্চসমূহকে রক্ষাকল্পে ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের প্রচার-প্রচারণা এবং ১৯৯৮সালে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার বিল পাস।

যাইহোক ওসমানীয় খেলাফতের সময়ে কপ্টিক খ্রিস্টানরা যে ধরণের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত, এবং সেখানে ওসমানীয়দের নিজস্ব ধাঁচের যে বহুত্ববাদের (প্লুরালিজম) চর্চা ছিল, আধুনিক মিশরে এসে তা অনেক জটিল হয়ে পড়েছে। তার মতে, খোদ সংখ্যালঘু ধারণার আভির্ভাব এবং সংখালঘুর অধিকার ধারণার বয়ান এমন কতক তর্ক-বিতর্কের ধারার সাথে সংযুক্ত যে রাষ্ট্র এটাকে ধর্মীয় ভিন্নতার বোঝাপড়া, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিশেষে সুরক্ষা করতে ব্যবহার করে। বিচারিক আমলা, সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রশ্নে সাংবিধানিক বিতর্ক, পারিবারিক আইন, এবং বাক স্বাধীনতার বিতর্ককে ঘিরে সাবা মাহমুদ দেখাচ্ছেন, ধর্মকে ব্যক্তিগতপরিসরে পাঠিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মীয় উপদানের উপর কিভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব দখল করেছে।

সেক্যুলারিজম এবং মরালিটির সাথে মানানসই না এমন অজুহাতে সাম্প্রতিক ফ্রান্সে বোরকা নিষিদ্ধকরণ, ইরাক সিরিয়ায় সংখালঘুদের উপর আইএস এর হামলা ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সেক্যুলারিজমের প্রশ্নকে যেভাবে সামনে নিয়ে আসছে, সাবা মাহমুদের একাজ নানান দিক থেকে তার হদিস দিতে সাহায্য করবে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এবং ইসলাম

নয় এগারোর ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ শুরু করে। এ যুদ্ধ কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, ফলে একটি রাষ্ট্রের পরাজয় স্বীকারের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবার কোন সুযোগ নেই। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাথমিক সময়ে জর্জ বুশ ‘ক্রুসেড’ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং ধর্ম হিসাবে ইসলাম এবং মুসলমানেরাই তার শত্রু। সারা দুনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাবার এই বয়ান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরে পিছিয়ে আসে। পেছানোর জন্য তারা মুসলমানদের দুই ভাগে ভাগ করে। একদিকে আছে জঙ্গী মুসলমান – যারা সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন আগ্রাসন ও নীতিনৈতিকতা বর্জিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়ছে ও লড়বে। আর আছে ভদ্রলোক মুসলমান যারা মার্কিনীদের ভাষায় ‘মডারেট’।

এরা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে মেনে নেয় এবং দাবি করে এই সভ্যতা, তার মানদণ্ড ও বয়ান মেনে নিয়ে মুসলামানদের চলতে হবে। মার্কিন মদদে যখন এই ‘ভদ্র মুসলিম’ প্রকল্প সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করা তুলা হচ্ছিল, মাহমুদ একে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর মতে এই ভদ্র মুসলিম প্রকল্প আসলে পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদের পক্ষে কিছু অনুগত মুসলিমদের জড়ো করার একটা উসিলা (মাহমুদ ২০০৬:৩২৩), কারণ পশ্চিম নিজের সুবিধার জন্যে ৯/১১ এর পর ইসলামের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক বিভাজনের রাজনীতি শুরু করে

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রভাব এত বিস্তৃত হয়ে পড়ে যে, খোদ একাডেমিক জগতেও এর ঢেউ এসে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম সংস্কার শীর্ষক গবেষণা করতে গিয়ে খ্যাতনামা নৃবিজ্ঞানী ক্যারোলিন ওজেলা লক্ষ্য করেন মুসলিম শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারি করার জন্য একাডেমিক লোকজনের উপর সরকারী সংস্থা আর ফান্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ দিন দিন বাড়ছে (Ossella, 2008) (ওসেলা, ২০০৮)। কেবল তাই নয়, র্যা ডিক্যাল ইসলামের মত কৃত্রিম ক্যাটাগরি করে ইসলামিক স্টাডিজের পাঠক্রম পর্যালোচনা করাসহ নানান নজরদারি নিত্য ঘটনা হয়ে পড়ে।

সাবা মাহমুদ সম্পর্কে তানজীন দোহার মূল্যায়ন ভেবে দেখার মতো। সাবার বইগুলো দোহার ভাষায় "মানহাজগতভাবে অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) হলেও, এগুলো এক প্রকার (এন্টি) সেক্যুলার সংশয়প্রবনতার (skepticism) উপর ভর করে দাড়িয়েছে যা তাঁর পূর্বোক্ত রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। ওনার এই সংশয় হালকা ধাঁচের ছিলোনা; যথেষ্ট গভীর ছিলো। যার ফলে অচিরেই স্বয়ং 'পলিটিকাল'-এর প্রশ্নটাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান তিনি। এই জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে উনি সেক্যুলাররা যেসব ব্যাপারকে 'অ-রাজনৈতিক' তকমা দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে সযত্ন অনুসন্ধান চালিয়ে যান। উনি পছন্দ করে থাকুক বা না থাকুক, অ-সেক্যুলারিতায় চুপষে যাওয়াদের নিয়ে তার আগ্রহভরা কাজগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে অনেক ইসলামপন্থী” (Doha, 2018)

এতকিছুর মধ্যেও সাবার ইসলাম পাঠ ছিল রিগোরাস। তিনি ইসলাম নিয়ে এসব ক্যাটাগরির রাজনীতিকে একটানা প্রশ্ন করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি প্রচলিত কনজারভেটিব ইসলাম এর বদলে একে বলছেন অর্থডক্স ইসলাম। তার মতে কনজারভেটিভ মানে হচ্ছে একটা বিশেষ ধরণের রাজনীতি। এক্ষেত্রে ধর্মীয় বা নৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা ভালো উদাহরণ। যদি জনগণ এই নৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশ হয় তবে ধরেই নেয়া হয় তারা গর্ভপাতবিরোধি, রিপাবলিকান পার্টির অংশ, এবং তারা পুরো রক্ষণশীল ঘরানার । কনজারভেটিজম বলতে এটাই বুঝানো হত।

এর বিপরীত দিকটা লিবারেল ইসলাম, যেটাকে লিবারেল রাজনীতির সাথে অধিক খাপখাওয়া আকারে ভাবা হয়। কিন্তু এটা আদতে মুসলিম বিশ্বে কাজ করেনা। এই জন্য করেনা কারন যারা এই অর্থডক্স আন্দোলনের অংশ তারা কিছু কিছু ইস্যুতে খুবই র্যা ডিকাল। উদাহরণস্বরুপ বর্তমানে সিরিয়া, তার্কি, মিশরে দেখা যায় সেখানে একটা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য শক্ত প্রতিবাদ জারি আছে। অতএব পুরান দুনিয়ায় লিবারেল বনাম কনজারভেটিভের যে বিভাজন ছিল যেখানে লিবারেলিজমকে গণতন্ত্র আর কনজারভেটিজমকে অগণতন্ত্র আকারে মাপা হত, এটা মোটেই এখন কাজ করেন না।

পঠিত : ৩৬৬৯৭৭ বার

মন্তব্য: ০